এল নিনো ও লা নিনা(El Nino and La Nina)
এল নিনো (EI Nino)
স্প্যানিশ ভাষায় এল নিনো (el nino) শব্দের অর্থ হল শিশু যিশুখ্রিস্ট (Christ Child)। এই বিপর্যয় ডিসেম্বর মাসে বড়োদিনের সময় (around christmas) হয় বলে এরূপ নামকরণ করা হয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরের চিলি-পেরু সংলগ্ন উপকূল বরাবর মাঝে মাঝে অস্থির ও অনির্দিষ্ট প্রকৃতির দক্ষিণমুখী উয় সমুদ্রস্রোতের আগমনই এল নিনো নামে পরিচিত। এই উদ্বু স্রোত কখন শুরু হবে, কখন শেষ হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব-পশ্চিমে উদ্বৃতা ও স্রোতের যথেষ্ট পার্থক্য লক্ষ করা যায়। পশ্চিমদিকে অর্থাৎ পাপুয়া, নিউগিনি ও অস্ট্রেলিয়ার দিকে জল বেশ গরম থাকে, অপরপক্ষে পূর্ব দিকে ইকুয়েডর পেরু, চিলি প্রভৃতি অঞ্চলের দিকে প্রশান্ত মহাসাগরের জল বেশ শীতল থাকে। এর কারণ সম্ভবত এই অংশে সারাবছর উত্তরগামী শীতল পেরু স্রোত বয়। ফলস্বরূপ পশ্চিম অংশের তুলনায় পূর্ব অংশে তাপমাত্রা অন্তত 5° সেন্টিগ্রেড কম থাকে। স্বাভাবিকভাবে নিরক্ষীয় অঞ্চল বরাবর উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু পশ্চিমে অপেক্ষাকৃত নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠেও উত্তর নিরক্ষীয় স্রোত ও দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোত নামে দুটি স্রোত নিরক্ষরেখার দুদিকে বহিঃস্রোত (surface current)রূপে পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হয়। একই সঙ্গে ফাঁকা স্থানের কারণে পূর্বদিকের সমুদ্রের গভীর থেকে ঠান্ডা জল উপরিতলে উঠে আসে। এই নীচ থেকে উঠে আসা ঠান্ডা জলের সলো থাকে প্রচুর প্ল্যাঙ্কটন, যা মাছের একমাত্র খাদ্য। তাই এই উপকূলে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। পেরু, চিলি প্রভৃতি দেশ তাই সামুদ্রিক মৎস্য বাণিজ্যে যথেষ্ট উন্নত।
এই স্বাভাবিক ঘটনার পরিবর্তন হলে এল নিনো বিপর্যয় দেখা যায়। কোনো কোনো বছর পূর্বদিক থেকে পশ্চিম দিকে বয়ে যাওয়া আয়ন বায়ুর গতি কমে আসে এবং প্রচন্ড গতিতে উল্টোদিকে অর্থাৎ পশ্চিমদিকের উয় জল পূর্বদিকে বইতে শুরু করে। ফলে দক্ষিণ আমেরিকার পূর্ব উপকূলের জল শীতল হওয়ার বদলে বেশ গরম হয়ে ওঠে। এই স্রোতের তাপমাত্রা বেশি থাকে বলে তখন আর প্ল্যাঙ্কটন সহ পুষ্টিকর পদার্থ নীচ থেকে উপরে আসে না, ফলে জলজ বাস্তুতন্ত্রে দেখা যায় গভীর বিপর্যয় এবং অধিক তাপমাত্রা ও খাদ্যের অভাবে প্রচুর পরিমাণ মাছ মারা যায়। কখনো কখনো এই ঘটনা একবৎসর কাল পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং এই অঞ্চলের মৎস্যচাষকেন্দ্রিক অর্থনীতির প্রচন্ড ক্ষতি হয়।
গরম এই সমুদ্রস্রোত নিম্ন বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রারও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটায় এবং অস্থায়ী নিম্নচাপ কেন্দ্রের সৃষ্টি করে। ফলে উপকূল অঞ্চলে ঝোড়ো হাওয়ার গতি বেড়েই চলে যা উত্তর আমেরিকার উপকূল অঞ্চলকেও আঘাত করে। এর সাথে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও বাড়ে। এই ঘটনা বায়ুমণ্ডলীয় আবহাওয়ার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটায় বলে বিজ্ঞানীরা একে এল নিনো দক্ষিণি ওঠাপড়া (El Nino-Southern Oscillation বা ENSO) বলেন। দক্ষিণি ওঠানামা বা ENSO হলেই ইন্দোনেশিয়া অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলে বায়ুচাপ বাড়ে এবং বৃষ্টিপাত কমে। কখনো-কখনো এই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এতই কমে যে উত্তর অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অস্বাভাবিক খরা সৃষ্টি হয়। ভারতের মৌসুমি বায়ুপ্রবাহও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বৃষ্টিপাত কমে। তবে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের ঊর্ধ্বাকাশে জেট বায়ুপ্রবাহ শক্তিশালী হয়। সেই কারণে ENSO অবস্থায় সারা পৃথিবী জুড়ে আবহাওয়ার (বিশেষত বৃষ্টিপাতের) এক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।
সাম্প্রতিক কালে 1982-83, 1986-87 এবং 1997-98 সালে প্রবলভাবে এল নিনো দেখা দিয়েছিল। ঠিক কত বছর অন্তর এই স্রোত দেখা যায় তা সঠিকভাবে বিজ্ঞানীরা বলতে পারেননি, তবে তথ্য অনুসারে প্রতি 3-10 বছরে এক একটি ভয়াবহ ENSO অবস্থা আসে। গত 1979-তে ENSO শুরু হয়েছিল এপ্রিল-মে মাসে এবং জুন মাসে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থায় পৌঁছেছিল। এটি প্রায় 1998-এর এপ্রিল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। তবে 1982-83-এর ENSO অবস্থা বিংশ শতাব্দীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রবল ছিল।
লা লিনা (La Lina)
এল নিনোর ঠিক বিপরীত অবস্থাকে লা নিনো বলে। স্প্যানিশ শব্দ লা লিনার (la lina) অর্থ হল ছোট্ট বালিকা (young girl)। পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে শীতল বায়ুপ্রবাহ হবার ঘটনা লা নিনো নামে পরিচিত। প্রশান্ত মহাসাগরের নিরক্ষীয় অঞ্চলে আয়ন বায়ু শক্তিশালী হলে পেরু ও ইকুয়েডর উপকূলে নীচ থেকে শীতল প্ল্যাঙ্কটন মিশ্রিত সমুদ্র জলস্রোত উপরে আসে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা কমিয়ে দেয়। এই ঘটনাকে ENSO শীতল অবস্থা (cold phase) বলে। লা নিনো হল উল্টোভাবে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল তথা ইন্দোনেশিয়া, উত্তর অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে ভালো বৃষ্টি হয়। ভারতের মৌসুমি বায়ুপ্রবাহও স্বাভাবিক থাকে।
প্রকৃতপক্ষে এল নিনো-লা লিনা হল ENSO চক্রের দুটি চরম অবস্থা। নিরক্ষীয় অঞ্চলে বিকিরণ জনিত তাপ সমতার বিঘ্ন ঘটালে (variation of radiational heat budget) এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞানী গিলবার্ট ওয়াকার (Gilbert Walker) প্রথম এই পেন্ডুলিয়ামের দোলনসম তাপমাত্রার চরম অবস্থার চক্রাকার প্রবাহের পরিচিতি ঘটান। তাই একে ওয়াকার প্রবহন (walker circulation) বলে।