ভাঁজের সংজ্ঞা ও ধারণা Definition and Concept of Fold
(•) ভাঁজের ধারণা ( Concept of Fold )
পৃথিবীতে অবস্থানরত বহু পুরোনো অর্থাৎ প্রায় 250 কোটি বছরেরও বেশি ভঙ্গিল পর্বতগুলি , যেমন– হিমালয় , আলস ও রকি এদের যে শিলাস্তর লক্ষ করা যায় সেগুলিতে ভাঁজ লক্ষ করা গেছে । ভাঁজ শিলাস্তর সৃষ্টির সময় বা শিলাস্তর উৎপত্তির সাথে সাথে তৈরি হয় না । জলাভাগে কিংবা মহাসাগর , নদী কিংবা হ্রদের তলদেশে যখন পলি , বালি , কাদা , নুড়ি প্রভৃতি সঞ্চিত হয় , তখন তারা অনুভূমিক বা প্রায় অনুভূমিকভাবে অবস্থান করে । পাত সংস্থান ( plate tectonic ) তত্ত্ব অনুযায়ী পৃথিবীর ভূত্বক ( crust ) স্থির নয় । ভূত্বকের এই অস্থিরতা বা সচলতাই শিলাস্তরের ভাঁজ সৃষ্টি করে । পৃথিবীতে যেসব ভূগঠনকারী প্রক্রিয়া ঘটে তাদের পার্থিব প্রক্রিয়া ( terrestrial processes ) বলে । এই পার্থিব প্রক্রিয়া দুটি ভাগে বিভক্ত , যথা — অন্তর্জাত এবং বহির্জাত প্রক্রিয়া । এই অন্তর্গত প্রক্রিয়ার ফলাফল হিসেবে ভূত্বকের অনেক পরিবর্তন ঘটে । অন্তর্গতি প্রক্রিয়ার প্রত্যক্ষ ফলরূপে শিলাস্তরে ভাঁজের সৃষ্টি হয় । পাললিক শিলান্তর অন্যান্য শিলাস্তর অপেক্ষা নরম ও দুর্বল । এই কারণে পাললিক শিলাস্তরে অনুভূমিক বা পার্শ্বচাপের ফলে সৃষ্ট সংকোচন আন্দোলনে ভাঁজের সৃষ্টি হয় । অনুভূমিক ভূ - আলোড়ন এক ধরনের ধীর ভূগাঠনিক আলোড়ন । ফলে ভাঁজের গঠনও ধীরে ধীরে হয় । ভূমিরূপ গঠনের সহায়ক শক্তি হিসেবে ভূ - আন্দোলনকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায় । যথা - সংকোচন আলোড়ন ( movement of contraction ) এবং সম্প্রসারণ আলোড়ন ( movement of expansion ) । এই দুটি আলোড়ন একে অন্যের সাথে সম্পর্ক যুক্ত । পৃথিবীপৃষ্ঠে কোনো স্থানে সঙ্কোচন আলোড়ন হলে অন্যস্থানে সম্প্রসারণ আলোড়ন সংঘটিত হয় । আবার বিপরীত ঘটনাও ঘটে থাকে । এই আলোড়নের ফলে ভূপৃষ্ঠের শিলাস্তরের মধ্যে যে পরিবর্তন লক্ষ করা যায় তাকে ভাঁজ বলে । সাধারণত সমান্তরালে উদ্ভূত পাললিক শিলায় ভাঁজ সুস্পষ্টভাবে দেখা যায় । অবশ্য আগ্নেয় ও রূপান্তরিত শিলার মধ্যে বিভিন্ন গণিত খনিজের প্রবাহ দেখা যায় । এই ধরনের প্রবাহগুলি ভাঁজ বা বলিরূপে অভিহিত হয় । পাললিক শিলাস্তরের ভাঁজগুলির প্রশ্ন প্রায় 10-100 কিনি । কিন্তু আগ্নেয় ও রূপান্তরিত শিলার ভাঁজগুলি কয়েক মিলিমিটার থেকে কয়েকশ মিটার প্রশ্ন ।
(•) ভাঁজের সংজ্ঞা ( Definition of Fold )
ভাঁজ বলতে আমরা একটি বক্তৃতলের সমষ্টিকে বুঝি । ভূগর্ভে ভূ - আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট অনুভূমিক চাপে ভূত্বকে ভাঁজের সৃষ্টি হয় । গিরিজনি আলোড়নের ( orogenic movement ) প্রভাবে শিলায় পার্শ্বচাপ পড়ে । এই পার্শ্বচাপের ফলে নমনীয় শিলাস্তরে সমান বা অসমানভাবে তরঙ্গের ন্যায় যে বক্তৃতা সৃষ্টি হয় তাকে ভাঁজ বলে । অনেকের মতে শিলাত্তরের বলি বা বিভিন্ন কৌণিকতায় শিলান্তরের বিন্যাস ও গঠনকে ভাঁজ বলে । কুণ্ঠনের ক্ষুদ্রতর রূপকেও ভাঁজ বা বলি বলে । ভাঁজ হল শিলান্তরে বিকশিত তরলায়িত একাধিক বক্তৃতল যা অত্যধিক পীড়ন বা পার্শ্বচাপের ফলে সৃষ্টি হয় । প্রকৃতপক্ষে ভাঁজ বা বলি বলতে বোঝায় যে কতকগুলি বরুতলের সমষ্টি যার আদি বক্তৃতা বিরুপণের ফলে সৃষ্টি হয়েছে । অর্থাৎ এককথায় শিলান্তরের তরঙ্গের আকৃতি প্রাপ্তিকে ভাঁজ বলে যা পর্যায়ক্রমিকভাবে শীর্ষদেশ ও পারবিন্দু গঠিত । A. Strahler- এর মতে ভূত্বতীয় সংগমনের ফলে স্তরীভূত শিলান্তরে সৃষ্ট তরঙ্গা সদৃশ বাঁক গঠনকে বলি বা ভাঁজ বলে । Majid Hossain- এর মতে " A flexure of bending of the rocks of the earth's crust owing to compressional forces is know as folding ' প্রবল ভূ - আলোড়নে ভূত্বকের কোমল পাললিক শিলাস্তরে অনুভূমিক চাপ বা পার্শ্বচাপ সৃষ্টি হওয়ায় সংনমনের ফলে শিলান্তর বিরূপিত হয়ে সংকুচিত হয় । শিলান্তরে সংকোচনের ফলে উৎপন্ন এক বা একাধিক বক্রতলের সমষ্টিকে বলা হয় । ( Fold ) | ভূত্বকের পাললিক শিলাস্তরে বা ভূ - অভ্যন্তরে নরম শিলাস্তরে সৃষ্ট অনুভূমিক ভূ - আলোড়ন বা পার্শ্বচাপের জন্য যে তরলসদৃশ দ্বিতীয় শ্রেণির বক্তৃতার সৃষ্টি হয় , তাকে ভাঁজ বা বলি বলে ( folds are the secondary curvature induced on a planner surface ) |
(★)ভাঁজ সৃষ্টির প্রক্রিয়া বা ভাঁজের গঠনতত্ত্ব Mechanism of Folding
সাধারণত যে সমস্ত শিলায় স্তর রয়েছে , সেই শিলায় ভাঁজ পড়ে । তাই পাললিক শিলায় ভাঁজ গঠিত হয় । ভূ - আলোড়নজনিত পরস্পর মুখোমুখি অনুভূমিকভাবে প্রযুক্ত বলের প্রভাবে পাললিক শিলাস্তরে সৃষ্ট একটি বক্তৃতল বা কতকগুলো বক্রতলের সমষ্টি যার আদি বক্তৃতা বিরূপণের ফলে সৃষ্টি হয়েছে , তাকে বলি বা ভাঁজ বলে । সাধারণত অবিকৃত অবস্থায় পাললিক ও লাভান্তরগুল ো অনুভূমিক থাকে ও বলিত হওয়ার পর এগুলো বেঁকে যায় । সাধারণত দুটি মুখ্য দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে ভাঁজ সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে ভাগ করা হয় । যথা — সরণজনিত প্রক্রিয়া এবং সংযুক্ত পীড়নজনিত প্রক্রিয়া । শিলাস্তরে আরোপিত বল যখন গতির সঞ্চার করে ভাঁজের উৎপত্তি ঘটায় তখন তাকে সরণজনিত প্রক্রিয়া বলে । শিলান্তরে এই বল দু'ভাগে আসে বলে এই প্রক্রিয়াকে পুনরায় দুটি উপবিভাগে ভাগ করা যায় । যথা-
( a ) আনত সরল ( flexural slip mechanism ) ,
( b ) বিষম সহজ কৃন্তন প্রক্রিয়া ( heterogeneous simple shear mechanism )
অনুভূমিক স্তরের সাপেক্ষে সংযুক্ত পীড়নজনিত প্রক্রিয়াকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায় যথা-
( a ) বাকলিং ( buck ling ) ও
( b ) বেল্ডিং ( bending )
পৃথিবীর অন্তঃজাত ভূ - আলোড়নে যে দুটি শক্তি বা বলের উদ্ভব হয় তার একটি হল সনেমন ( compression ) এবং অপরটি টান ( tension ) । এই সংনমন বা অনুভূমিক বল ( horizontal pressure ) যখন প্রবল হয়ে উঠে , তখন শিলাস্তরে ঢেউ - এর মতো কোথাও উঁচু কোথাও নীচু হয়ে ভাঁজ সৃষ্টি হয় । সাধারণত ভাঁজের অক্ষতলের সঙ্গে 90 ° কোণে এই বল কাজ করে । এই বলের পরিমাণের তীক্ষ্ণতা ও ব্যাপ্তির উপর ভাঁজের প্রকৃতি এবং বৈশিষ্ট্য নির্ভর করে । অধিকাংশ ভাঁজের উৎপত্তির ক্ষেত্রে শিলাস্তরের সমান্তরাল দিকে সংনমন বল বা পীড়ন ( stress ) কাজ করে । ভাঁজ গঠনে প্রধান তিনটি প্রক্রিয়া কাজ করে থাকে । অনেক ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়াগুলি পৃথকভাবে কাজ করে থাকলেও মূলত এরা মিলিতভাবে ভাঁজ সৃষ্টি করে থাকে । এগুলি নীচে আলোচনা করা হল ।
[১] বক্রকরন ( Flextural ) : এটি একটি ভাঁজ গঠনের প্রক্রিয়া । এই প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে অনুভূমিক গঠনের শিলাস্তর সমূহের উপর সংলমন বল ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে কার্যকর হয়ে থাকে । তাই শিলাস্তর বেঁকে যায় এবং এর উত্তল অংশে টানের ফলে। এবং অবস্থল আশে সনেমনের প্রভাবে কার্যকর হয়ে থাকে । এই দুই অংশের মধ্যে এক পীড়নহীন তল ( surface of no strain ) অবস্থান করে । এই ধরনের ভাজের উত্তল অংশের শিলান্তর প্রসারিত এবং অবতল অংশের শিলান্তর সংকুচিত হয়ে থাকে ।
[২]কৃন্তন ( Shear ) : কৃত্তন ভাঁজ গঠনের আরো একটি উল্লেখযোগ্য প্রক্রিয়া । এই প্রক্রিয়ায় শিলার মধ্যে পীড়নের জন্য অসংখ্য ক্ষুদ্র ফাটলের সৃষ্টি হয় এবং ঐ ফাটলে দুই পাশের শিলা স্থানচ্যুত হওয়ার কারণে শিলাস্তরটি ভাজের আকার ধারণ করে । এক্ষেত্রে শিলাস্তরের একাধিক পরপর তির্যক ফাটলের অংশ বেশি উত্থিত হয়ে ভাঁজ সৃষ্টি করে ।
[৩] প্রবাহ ( Flow ) : কৃত্তন ভাঁজের সংনমন বল যদি ধারাবাহিক প্রবাহের মধ্যে কাজ করে সেক্ষেত্রে শিলাস্তরের সমকোণীয় বেধ ( thickness ) সর্বত্র সমান থাকে না । একে প্রবাহ ভাঁজ বলে । কৃস্তন ভাঁজের মতোই প্রবাহ ভাজ প্রক্রিয়াতেও শিলার মধ্যে পীড়নের জন্য অসংখ্য ফাটলের সৃষ্টি হয়ে থাকে , কিন্তু এক্ষেত্রে ফাটলগুলি পরস্পরের প্রায় সংলগ্ন থাকে এবং এদের মধ্যে ব্যবধান বোঝা যায় না । এই প্রক্রিয়ায় শিলা তরল পদার্থের ধারার মতো স্থানচ্যুত হয় ।
(• )ভাঁজ সৃষ্টির কারণ ( Causes of Fold )
ভূ - অভ্যন্তর ভাগে বিভিন্ন কারণে শিলাস্তরে ভাঁজ পড়ে । শিলাস্তরে ভাঁজ সৃষ্টির মূল কারণ হল গিরিজনি আলোড়নের প্রভাবে উদ্ভূত সনেমন বল । তবে অন্য যে কোনো কারণে সংনমনের জন্যও ভাঁজের সৃষ্টি হতে রে । যে সমস্ত শক্তির প্রভাবে শিলাস্তরে সনেমন বলের উদ্ভব হয়ে থাকে , তাদেরকে দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায় । যেমন- ভুগাঠনিক শক্তি ( tectonic force ) , এবং অ - ভূগাঠনিক শক্তি ( non - tectonic force ) । ভূগাঠনিক শক্তিসমূহ মূলত ভূত্বকের অভ্যন্তরে কার্যকর হয় এবং ভূগাঠনিক শক্তি দ্বারা ভাঁজ ( tectonic fold গঠন করে আবার আগাঠনিক শক্তি সাধারণত ভূত্বকের উপরে কার্যকর হয় এবং এই অভূগাঠনিক শক্তি দ্বারা ভাঁজ ( non - tectonic fold ) গঠিত হয় । ভূগাঠনিক শক্তির মাধ্যমে ভাঁজ সৃষ্টির সরলতম পদ্ধতিতে ভূতকের একটি স্থান অংশের বিরুদ্ধে শিলাস্তরসমূহ সংনমিত হয় । এই ধরনের ভাঁজ অন্যান্য পদ্ধতিতেও গঠিত হতে পারে । যেমন — স্তরীভূত শিলার মধ্যে ম্যাগমা অথবা লবণ সন্বয়ের জন্য উপরের শিলান্তর উত্থিত হয়ে ভাঁজের আকার ধারণ করে ভাঁজ গঠনকারী মুখ্য অ - ভূগাঠনিক শক্তি হল পৃথিবীর মহাকর্ষীয় বল ( gravitational force ) । এই বলের প্রভাবে খাড়া ঢালের উপরে অবস্থিত শিথিল শিলান্তর নীচের দিকে গড়িয়ে যায় । এই কারণে ঐ শিলাস্তর সনেমিত হয়ে ভাঁজ গঠন করে থাকে । এছাড়া হিমবাহের গতি , দ্রবণ প্রক্রিয়া এবং পলির অসমহারে সংবধকরণ প্রভৃতির জন্য সংনমন বলের উদ্ভব হয়ে ভাঁজ সৃষ্টি হতে পারে । এছাড়াও বিভিন্ন কারণে ভাঁজ সৃষ্টি হতে পারে সেগুলি নিম্নে আলোচনা করা হল
1 } মহাসাগরীয় ও মহাদেশীয় পাতের সংর্ঘষ :
যে অঞ্চলে ভারী মহাসাগরীয় পাতটি হালকা মহাদে শীয় পাড়ের তলায় অনুপ্রবেশ করে , সেই অঞ্চলে দুটি পাতের সংঘর্ষের ফলে জলভাগের পাললিক স্তর পার্শ্বচাপে কুণ্ঠিত হয়ে ভাঁজ প্রাপ্ত হয় । রকি ও আন্দিজ পর্বতমালায় এই ধরনের পার্শ্বচাপের প্রভাবে বহু ভাঁজের সৃষ্টি হয়েছে ।
2} মহাদেশীয় পাতগুলির অভিসারী চলনের ফলে :
মহাদেশীয় ভূত্বকগুলি অনেক সময় পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে সংঘর্ষের সৃষ্টি করে তখন এই মহাদেশগুলির প্রাক্ত দেশে সম্বিত পাললিক শিলাস্তরগুলি দুটি মহাদেশীয় ভূখণ্ডের মধ্যে উদ্ভুত চাপের প্রভাবে ভঙ্গিল হয় । ভারতীয় ভূখণ্ড ও তিব্বতের মধ্যে এই সংঘর্ষের ফলে মধ্য হিমালয় ও তিব্বতীয় হিমালয়ের পাললিক শিলাস্তরে বিশাল আকৃতির ভাঁজের উদ্ভব ঘটেছে । এই ধরনের ভাঁজের বিস্তার খুব বেশি হয় । আমর পর্বতমালায় এই ধরনের ডাঁজ লক্ষ করা গেছে । উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে — টেথিস মহীখাতের সম্বিত পলিরাশি উত্তরদিক থেকে আগত আপ্যারাল্যান্ড এবং দক্ষিণদিক থেকে আগত গন্ডোয়ানাল্যান্ড - এর অনুভূমিক চাপের ফলে হিমালয় পর্বত সৃষ্টি হয়েছে ।
3} ম্যাগমা ও কেলাসিত লবণের উর্ধ্বমুখী চলন :
অনেক সময় পাললিক শিলাস্তরের নীচে আগ্নেয়শিলার উপহ ঘটলে ম্যাগমার উর্ধ্বমুখী চলনের দ্বারা ভাঁজের সৃষ্টি হয় । ম্যাগমার স্তরগুলি উপরের দিকে চাপের সৃষ্টি করলে দুপৃষ্ঠের উপরে সঞ্চিত পাললিক শিলায় ভাঁজের উৎপত্তি ঘটে । আবার অতীতে ভূ - অভ্যন্তরে সঞ্চিত লবণকণা কেলাসে পরিণত হলে তা উপরের দিকে চাপ দেয় । তখন শিলাস্তর ডজেয়াপ্ত হয় ।
4} ভূত্বক ও ভূ - অভ্যন্তর ভাগে শীতলীভবন ও সংকোচনজনিত তারতম্য :
পৃথিবীর ভূত্বক এবং তার অভ্যন্তর ভাগের মধ্যে সমান হারে শীতলীভবন এবং সংকোচন হয় না । ফলে শিলাস্তরে ভাঁজ পড়ে । অর্থাৎ ভূত্বকের উপরি অংশ শীতল এবং সংকুচিত হয়ে কঠিন অবস্থায় প্রাপ্ত হয়েছে । পরবর্তী সময়ে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ ভাগ শীতল এবং সংকুচিত হয়েছে । কিন্তু উভয়ের মধ্যে শীতল ও সংকোচনের মাত্রা এক না হওয়ায় উভয় ত্বকের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার জন্য সনেমনের ফলে শিলার স্তর ভাঁজ প্রাপ্ত হয় ।
5} মহীখাত অঞ্চলে পলির অবক্ষেপ :
মহাসাগরে প্রাকৃতিক শক্তির দ্বারা ক্ষয়জাত পলি ক্রমাগত সঞ্চিত হয়ে থাকে । এই বিপুল পলিরাশির চাপে ও ভারে মহাসাগরের তলদেশে অগভীর মহীখাত অঞ্চল ক্রমশ নীচের দিকে বসে যায় । ফলে বিপরীত দিক থেকে পার্শ্বচাপে শিলাস্তর ভাঁজ প্রাপ্ত হয় ।
6 } পরিচলন স্রোত :
অ্যাসথেনোস্ফিয়ারের তরল পদার্থ তাপ পরিবহনের মাধ্যম হিসাবে পরিচলন স্রোত গঠন করে । ভূ - বিজ্ঞানী আর্থার হোমস্ - এর পরিচলন স্রোেত মতবাদ অনুসারে ভূগর্ভে যেখানে দুদিক থেকে আসা দুটি বিপরীতগামী নিম্নমুখী স্রোতের মিলন হয় , সেখানে প্রবল চাপে ভূত্বকে ভাঁজ সৃষ্টি হয় । এই সমস্ত কারণ ছাড়াও অবনমন এবং চ্যুতির প্রভাবেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে নানা ধরনের ভাঁজের সৃষ্টি হয় ।
(★) ভাঁজের গঠনগত উপাদানসমূহ Structural Elements of Fold
ভাঁজ বলতে আমরা একটি বক্রতলের সমষ্টিকে বুঝি । শিলার এই বক্রতল শিলার আকৃতিগত পরিবর্তনের ( deformation ) ফলে সৃষ্টি হয় । আকৃতিগত পরিবর্তন ছাড়া অন্য কোনো ভাবে শিলাস্তরের বক্তৃতাকে ভাঁজ বলা যায় না । একটি ভাঁজের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন নাম রয়েছ । একটি ভাঁজের বিভিন্ন গাঠনিক উপাদান বা অংশ থাকে , সেগুলিকে নীচে আলোচনা করা হল ।
[১] অক্ষ ( Axis ) ভাঁজের মাঝবরাবর কোনো রেখা টানলে তাকে অক্ষ বলে । ভাঁজ প্রাপ্ত শিলাস্তরের মধ্যে অক্ষতল যে রেখা বরাবর মিলিত হয় অর্থাৎ শিলার সবচেয়ে বেশি বক্তৃতাযুক্ত বিন্দুগুলিকে যোগ করলে যে রেখা পাওয়া যায় তাকে ভাঁজ অক্ষ বলে । ভাঁজ অর্থাৎ অনুভূমিক , উল্লস্থ বা হেলানো প্রকৃতির হয়
[2] অক্ষতল ( Plane of Axis ) যে তল বরাবর ভাঁজকে দুটি অংশে পৃথক করা যায় তাকে অক্ষতল বলে । গ্রন্থিরেখাগুলি যোগ করলে যে তল পড়ে যায় তাকে অক্ষতল বলে । আবার অন্যভাবে বলা যায় যে ভাঁজপ্রাপ্ত শিলাস্তরের সবচেয়ে বেশি বক্তৃতাযুক্ত বিন্দুগুলিকে লক্ষ করে শিলাস্তরের ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত প্রস্থচ্ছেদ করলে যে পৃষ্ঠ পাওয়া যায় তাকে অক্ষতল বলে । সাধারণত অক্ষতল রৈখিকা বা আঁকাবাঁকা হতে পারে । আবার অক্ষতলের দুই পাশের দুটি বাহু দেখতে একইরকম হয় ।
[ 3] বাহু ( Limb ) : ভাঁজ অক্ষের দুই পার্শ্বকে ভাঁজের বাহু বলে । গ্রন্থিবিন্দু একটি ভাঁজকে দুটি ভাগে ভাগ করে । এই প্রত্যেকটি ভাগকে বাহু বলে , অর্থাৎ একটি ভাঁজ সবসময় দুটি বাহু দ্বারা গঠিত হয় ।
[4] বাহুর নতি ( Limb Dip ) : শিলান্তর বা ভাঁজের বাহু অনুভূমিক তলের সাপেক্ষে যে কোণে হেলে থাকে তাকে শিলান্তরে নতি বা বাহুর নতি বলে ।
[5] গ্রন্থি বিন্দু ( Hinge ) : একটি তলের বক্তৃতা সর্বত্র সমান নয় । যে বিন্দুতে এই বক্তৃতা সর্বাধিক তাকেই আমরা গ্রন্থিবিন্দু বলি ।
[6] গ্রন্থি রেখা ( Hinge Line ) : একটি ভাজের প্রন্থিবিদুগুলিকে যোগ করলে যে রেখা পাওয়া যায় তাকে গ্রন্থিরেখা বলে । অর্থাৎ অঞ্চল যে রেখা বরাবর বেঁকে যায় , সেই রেখা হল গ্রন্থিরেখা ।
[7] গ্রন্থিবলয় ( Hing Area ) : কোনো বক্তৃতলের বক্তৃতা সর্বাধিক কোনো বিন্দুতে না হয়ে তা একটি বলয়ও সৃষ্টি করতে পারে । তখন সেই বলয়কে গ্রন্থিবলয় বলে । অর্থাৎ গ্রন্থি সংলগ্ন অঞ্চলকে গ্রন্থি অঞ্চল বলে ।
[৪] আয়াম ( Strike ) : শিলার স্তরায়ণ তল ও অনুভূমিকতল যে রেখা বরাবর পরস্পরকে ছেদ করে , তাকে আয়াম বলে অনুভূমিক তলের সমান্তরালে যে কোনো উচ্চতায় আয়াম রেখা কল্পনা করা যায় । এটি সর্বদা নতি অভিমুখের সঙ্গে অর্থাৎ শিলান্তর যেদিকে হেলে থাকে তার সঙ্গে সমকোণে অবস্থান করে ।
[9] স্তরায়ণ তল ( Bedding Plane ) : পাললিক শিলান্তরে একটি স্তর অপর একটি স্তরের সঙ্গে যে তলে পৃথক থাকে তাকে স্তরায়ণ তল বলে । প্রতিটি শিলাস্তরের দুটি করে তল থাকে এবং দুটি শিলাস্তর একটি সাধারণ তল দ্বারা পৃথক হয় ।
[ 10 ] ঊর্ধ্ব ( Anticline ) : যে ভাজে শিলান্তর ওপরের দিকে বাঁক নিয়ে উত্তল ভাঁজ তৈরি হয় , তাকে উর্ধ্বভা বলে । ঊর্ধ্বভঙ্গো বাহুদ্বয়ের নতি পরস্পর বিপরীতমুখী হয়ে অবস্থান করে ।
[11] অধোভঙ্গ ( Syncline ) : অনুভূমিক চাপের প্রভাবে ভাঁজের কোনো অংশ নীচের দিকে অবতল হয়ে অবস্থান অধোভঙ্গের ক্ষেত্রে দুটি বাহু পরস্পরের দিকে থাকে ।
[12 ]বিস্তার ( Extension ): আচ্ছাদন তল দুটির মধ্যে যে ব্যবধান থাকে তার অর্ধাংশকে বলে বিস্তার ।
[13 ] তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ( Wave Length ) :ভাঁজ শান্তরে যে তরঙ্গ তৈরি করে তার দুটি গ্রন্থিবিন্দুর মধ্যের দূরত্বকে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বলে ।
[ 14] আন্তবাহু কোণ ( Included Angle ) : ভাঁজের বাহু দুটিকে প্রসারিত করলে তারা একদিকে একটি কোণ তৈরি করে । এই কোণকে আস্তবাহু কোণ বলা হয় ।
(★) ভাঁজের শ্রেণিবিভাগ Classification of Fold
ভূপ্রকৃতিগত অবস্থা , শিলার প্রকৃতি , শিলাত্তরের বিন্যাস , ভূ - আলোড়নের তীব্রতা , ভূ - আলোড়নের স্থায়িত্ব , ভূমিরূপের গঠন অনুভূমিক চাপের ধরন ও মাত্রা প্রভৃতির তারতম্যের উপর ভিত্তি করে ভাঁজের সৃষ্টি হয় । নিম্নে ভাঁজের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ভিত্তি অনুসারে ভাঁজের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা করা হল ।
∆ ভাঁজের অবতলতা ও উত্তলতা অনুসারে শ্রেণিবিভাগ ( Classification of Fold based on Concavity and Convexity )
ভাঁজের বাহুর বক্তৃতা অর্থাৎ উত্তলতা ও অবতলতা অনুসারে ভাঁজকে কতকগুলি ভাগে ভাগ করা যায় । সেগুলি হল
( 1 ) ঊর্ধ্বভঙ্গ ( Anticline ) : গ্রিক শব্দ Anti শব্দের অর্থ বিপরীত এবং Cline শব্দের অর্থ হেলানো গিরিজনি আলোড়নের ফলে সৃষ্ট ভাঁজের যে অংশ উপরের দিকে উত্তল হয়ে অবস্থান করে তাকে উর্ধ্বভা বলে । অর্থাৎ যখন ভাজের আকৃতি উত্তল খিলানের মতো হয় , তখন তাকে ঊর্ধ্বভঙ্গ বলে । শিলাস্তর বেঁকে ভাঁজ সৃষ্টি করে । এই ভাঁজের ওপরের দিকে নবীন শিলান্তর এবং ভিতরের দিকে প্রাচীন শিলাস্তর অবস্থান করে । উত্তর আমেরিকার মধ্যে কলোরাডো অঞ্চলে এই ভাঁজ লক্ষ করা যায় ।
( 2 ) অধোভঙ্গ ( Syncline ) : গ্রিক ভাষায় Syncline এই শব্দের অর্থ হল একই দিকে আনত । যে ভাঁজে শিলান্তর নীচের দিকে বাঁক নিয়ে অবতল ভাজ সৃষ্টি করে , তাকে অধোভঙ্গ বলে । এই ভাঁজের ওপরের দিকে প্রাচীন শিলান্তর এবং ভিতরের দিকে নবীন শিলান্তর অবস্থান করে । স্তরবিন্যাস উল্টে গেলে অধোভল্যের ওপরের দিকে নবীন শিলাস্তর থাকতে পারে । অধোভলো বাহু দুটি নীচের দিকে আনত হয় এবং নীচু হয়ে যায় । আবার উপরের দিকে উঁচু হয়ে যায় । কানাডার হাডসন ও ফ্লেকিকো উপসাগরে এই ভাঁজ লক্ষ করা যায় ।
(3) ঊর্ধ্বভঙ্গ ধারা ( Anticiinorium ) বৃহৎ আকৃতির ঊর্ধ্বভলোর ওপর তখনো কখনো অসংখ্য ছোটো ছোটো ঊর্ধ্ব ভাঁজ সৃষ্টি হতে পারে । ঊর্ধ্বগুলোর ওপর অবস্থিত এরূপ ভালকে ঊর্ধ্বভঙ্গ ধারা বলে । অর্থাৎ বহু ক্ষুদ্রাকার গৌণ ভাঁজের সমন্বয়ে গঠিত একটি বিশাল উর্ধ্বভা ভাঁজকে উর্ধ্বভা ধারা বলে । কোনো বৃহৎ আয়তনের ঊর্ধ্বভল্যের মধ্যে অনুভূমিক সংনমনজনিত স্পর্শক সংক্রান্ত বল নিয়মিত ও নিবিড়ভাবে কাজ না করলে একাধিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাঁজের সৃষ্টি হয় ।
(৪) অধোভঙ্গ ধারা ( Synclinorium ) : বৃহৎ আকৃতির অধোভঙ্গের ওপর কখনো কখনো অসংখ্য ছোটো ছোটো অধোভাজ সৃষ্টি হতে পারে । অধোভলোর ওপর অবস্থিত এরূপ ভাজকে অধোভলা ধারা বলে । অর্থাৎ অসংখ্য ক্ষুদ্রাকার গৌণ ভাঁজের সমন্বয়ে গঠিত একটি বিশাল অধোভলা ভাঁজকে অধোভঙ্গ ধারা বলে । গঠনগতভাবে আরাবল্লী পর্বত এক ধরনের কুণ্ঠিত অধোভলা ধারা ।। অবস্থান করে তাকে অ্যান্টিফর্মের দুই বাহুর
( 5) অ্যান্টিফর্ম ( Antiform ) যে পাললিক শিলাস্তরে ভাজের বাঁক ওপরের দিকে মুখ করে অ্যান্টিফর্ম বলে । অ্যান্টিফর্মের ভাজটি দেখতে উত্তলাকৃতির হয় । শিলান্তর বেঁকে ভাঁজ সৃষ্টি করে । গতির দিক নির্দেশ সাধারণত বিপরীতমুখী হয় । অবশ্য সবসময় তা নাও হতে পারে ।
(6 ) সিনোফর্ম ( Synform ) যে ভাঁজের বাঁক নীচের দিকে অবস্থান করে , তাকে সিনফর্ম বলে । এরূপ ভাঁজের আকৃতি অবতলের মতো হয় । এদের দুই বাহু সাধারণত উভয়ই উভয়ের দিকে নতির দিক নির্দেশ করে । তবে অবশ্য বিশেষ ক্ষেত্রে তা নাও হতে পারে ।
∆ ভাঁজের বাহু ও নতির দিক এবং নতির পরিমাণ অনুসারে শ্রেণিবিভাগ ( Classification of Fold based on Direction of Limbs and Amount of Inclination of Dip )
ভাঁজের বাহু ও নতির দিক এবং নতির পরিমাণ অনুসারে ভাঁজকে কতকগুলি ভাগে ভাগ করা হয়েছে ।
( i ) প্রতিসম ভাজ ( Symmetrical Fold ) যেসব ভাঁজের উভয়দিকের বাহুদ্বয় একই কোণে বিপরীত দিকে প্রসারিত থাকে । এবং দুটি বাহু সমান দৈর্ঘ্যের হয় , তাকে প্রতিসম ভাঁজ বলে । এ ধরনের ভাঁজে ঊর্ধ্বভঙ্গের অক্ষরেখা অনুভূমিক সমতলের সঙ্গে সমকোণে অবস্থান করে । এই ধরনের ভাঁজ সৃষ্টির ক্ষেত্রে দুদিকের সংকোচনকারী বল সমান ও বিপরীতমুখী তীব্রতা কম হওয়ার জন্য কোনো ঊর্ধ্বভা বা অধোভঙ্গের উভয় পার্শ্বের বাহু দুটি পরস্পর বিপরীত দিকে কিন্তু সমান কোণে হেলে থাকে।
( II ) অপ্রতিসম ভাজ ( Asymmetrical Fold ) যেসব ভাঁজের দুই পাশের বাহু সমানভাবে ঢালু না হয়ে অসমকোণে বুনিকে হেলে অবস্থান করে তখন তাকে অপ্রতিসম ভাজ বলে । এই প্রকার ভাঁজের ভাঁজ অন্যটি হেলে অবস্থান করে এবং একটি বাহু অপর বাহুর তুলনায় বেশি খাড়াই হয় , এই অবস্থায় একদিকের বাহু বড়ো হয় ও অন্যদিকের বাহু ছোটো সেইসঙ্গে বাহু দুটির গতি ও গতির অভিমুখ ভিন্ন ভিন্ন হয় । এক্ষেত্রে উর্দ্ধতাগুলো সাধারণত পর্বতশীর্ষে এবং অধোলাগুলো উপত্যকায় অবস্থান করে । ভারতের শিবালিক পর্বত এবং সুইজারল্যান্ডের জুরা পর্বতে এই ধরনের তুমিরূপ লক্ষ করা গেছে ।
( ii ) সমনত ৰা সমপ্রবণ ভাঁজ ( Isoclinal Fold ) : যে ভাঁজের উভয়দিকের বাহু দুটি সমান কোণে এবং একই দিকে পরস্পরের সমান্তরালে হেলে থাকে , তখন তাকে সমপ্রবণ ভাঁজ বলে । অর্থাৎ যখন কোনো বিপর্যস্ত ভাঁজের উভয়দিকের বাহুল্য একই কোণে একই দিকে হেলে অবস্থান করে , তখন তাকে সমনত বা সমগ্রবণ ভাঁজ বলে । কোনো শিলাস্তরে একদিক থেকে ক্রমাগত চাপের ফলে শিলাস্তর থেকে উপরে উত্থিত হয়ে এই প্রকার ভাঁজের সৃষ্টি হয় । এই ধরনের তাজের অন্ত্যবাহুর কোণ 10 ° এর মধ্যে অবস্থান করে । সমপ্রবণ ভাঁজ দুই ধরনের যথা উল্ল সমগ্রবণ ভাঁজ ( vertical isoclinal fold ) , যেখানে অক্ষতল উল্লম্বভাবে অবস্থান করে এবং হেলান সমস্রবণ ভাঁজ ( inclined isoclind fold ) যেখানে অক্ষতলটি হেলে অবস্থান করে ।
( iv ) পাখা ভাঁজ ( Fan Fold ) : পাললিক শিলাস্তবে উভয়দিকে পার্শ্বচাপের প্রভাবে শিলান্তর কুণ্ঠিত হয়ে এক বা একাধিক বড়ো ভাঁজের সৃষ্টি করে । এরূপ ভাঁজের ঊর্ধ্বভল্যের দুটি বাহুর নতি একে অন্যের কাছাকাছি এবং অধোভঙ্গের দুটি বাহু একে অন্যের থেকে দূরে অবস্থান করে । বলে , একে পাখা ভাঁজ বলে । অর্থাৎ যে তাঁজের ঊর্ধ্বভঙ্গে ও অধোগুলো গোলাকার বাহু আবৃতভাবে ( overturned ) অবস্থান করে , ঊর্ধ্বতলা ও অধোভা যথেষ্ট প্রশস্ত ও প্রসারিত হয় উভয় বাহুই ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে এবং নীচের বাহু দুটি পরস্পরের কাছাকাছি অবস্থান করায় দেখতে অনেকটা ছাতার আকৃতি বিশিষ্ট হয় , তাকে ছত্রাকার বা পাখা ভাঁজ বলে । ভূমি সংলগ্ন অংশে দুপাশে চাপ সমান ও অধিক হলে ভাঁজের নিম্নাংশ সংকুচিত এবং ঊর্ধ্বাংশ স্ফীত হয়ে এটি সৃষ্টি করে । এই ধরনের ভাঁজ আল্পস পর্বতে দেখা যায় ।
( v ) একনত ভাঁজ ( Monoclinal Fold ) যেখানে শিলাস্তরগুলো সমতল আকারে পরস্পরের সমান্তরালে অবস্থান করে , সেখানে ভূ - আন্দোলনের ফলে শিলান্তরের ওপরের অংশ এবং নীচের অংশের মধ্যবর্তী শিলাস্তরে বাঁকের সৃষ্টি হয় এবং খুব খাড়াভাবে নত থাকে । এই জাতীয় ভাঁজকে একনত ভাঁজ বলে । এই ধরনের ভাঁজ ভূমিভাগের ওপরে অবস্থান করে ।
∆ ভাঁজের বাহুর সাদৃশ্য ও অক্ষতলের অবস্থান অনুসারে শ্রেণিবিভাগ ( Classification of Fold based on Similarity of Limbs and Alignement of Axial Plane )
( ১ ) শায়িত ভাঁজ ( Recumbent Fold ) : পাললিক শিলাস্তরে অনুভূমিক চাপ একদিক অপেক্ষা অন্যদিকে বেশি হলে ভাজের একটি বাহু অপর একটি বাহুর ওপরে উঠে যায় । এরূপ ভাঁজের অক্ষরেখা যদি ভূমিভাগের সঙ্গে প্রায় সমান্তরালে অবস্থান করে তাহলে তাকে শায়িত ভাজ বলে । অর্থাৎ একদিকে পার্শ্বচাপ , অত্যধিক বেশি হলে যে ভাজের অঞ্চতল অনুভূমিক তলের সঙ্গে যায় । সমান্তরালে অবস্থান করে , এবং ভাঁজের একদিকের বাহু অন্যদিকের বাহুর ওপর পুরোপুরি উঠে যায় , তাকে শায়িত ভাঁজ বলে । এক্ষেত্রে অক্ষতলের নতি 0-10 ডিগ্রির মধ্যে অবস্থান করে । শায়িত ভাঁজের দৈর্ঘ্য 30-40 কিমি হয় । শায়িত ভাঁজের মধ্যভাগে অনেক সময় কেলাসযুক্ত আগ্নেয় বা রূপান্তরিত শিলার অংশ অবস্থান করে । এই কেলাসযুক্ত স্তরের চারপাশে পাললিক শিলার আবরণ গড়ে ওঠে । এই ভাঁজের ওপরের শিলান্তরে বেশ কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তীজের সৃষ্টি হয় । এই ভাঁজের সামনের অংশকে খিলান বাঁক বা Archbend বলে । আঙুলের মতো দেখতে এই ছোটো ছোটো ভাজকে প্রক্ষিপ্ত ভাঁজ বা Digitations বলে । দার্জিলিং হিমালয় একটি শায়িত ভাঁজের উদাহরণ ।
( ২ ) উদ্ঘট ভাঁজ ( Overthrust ) শায়িত ভাঁজে অনুভূমিক ঢাপের পরিমাণ বেড়ে গেলে , প্রবল পার্শ্বচাপের ফলে কোনো ভাঁজের মাঝ বরাবর শিলান্তর ফেটে গিয়ে তাঁজের পার্শ্ব বা অংশ অন্য পার্শ্ব বা অংশ থেকে কিছুটা দূরে সরে যায় বা বিচ্যুত হয় । এই ধরনের ভাজকে উদ্ঘাট ভাঁজ বলে ।
( ৩ ) ন্যাপ ভাজ ( Nappe ) অত্যধিক পার্শ্বচাপের জন্য ভাঁজের দুটি বাহু বিচ্ছিন্ন হয়ে । বেশ কিছুটা দূরে অবস্থান করলে ন্যাপ ভাঁজ বলে । আবার অন্যভাবে বিশাল আকৃতির শায়িত ভাজ , দুই বাহুই অনুভূমিক থাকে , তাকে ন্যাপ বলে । এদের দুটি বাহুর দূরত্ব 1.5 কিমি বা তার বেশি হবে । কাশ্মীর উপত্যকায় এই ধরনের ভাঁজ লক্ষ করা যায় ।
( ৪ ) আবৃত ভাজ ( Over Fold বা Overturned Fold ) এটি এক ধরনের অপ্রতিসম ভাজ যেখানে একদিক থেকে অধিক চাপের ফলে ভাঁজটির অঙ্ক কাত হয়ে যায় এবং দুটি বাহু একদিকে নষ্ট হয়ে যে ভাঁজ সৃষ্টি করে তাকে আবৃত বা উল্টানো ভাঁজ বলে । অর্থাৎ শিলাস্তরের উপর অনুভূমিক চাপের মাত্রা খুব তাঁর হলে কোনো বাহু স্বাভাবিক অবস্থানে থাকলেও অপর বাহুটি উল্লম্ব রেখা অতিক্রম করে প্রথম বাহুটির দিকে বেঁকে যায় অর্থাৎ এই প্রকার তাঁজে বাহু দুটি একইনিকে কিন্তু ভিন্ন কোণে অবস্থান করে । একে আবৃত ভাঁজ বলে । এই ভাঁজ ঊর্ধ্বভা ও অধোভলা দুই ধরনের হতে পারে । এক্ষেত্রে দুই বাহুর নতির দিক এক হয় ।
∆ ভাঁজের দুই বাহুর অন্তবর্তী কোণের ভিত্তিতে ভাঁজের শ্রেণিবিভাগ ( Classification of Fold based on Internal Angle between two Limbs of Folds )
ভাঁজের দুই বাহুর অন্তবর্তী কোণের ভিত্তিতে ভাঁজকে কতকগুলি ভাগে ভাগ করা যায় । যা নিম্নে আলোচনা করা হল ।
( I ) সংকীর্ণ ভাঁজ ( Tight Fold ) : যে ভাজের বাহুদ্বয়ের অন্তবর্তী কোণের পরিমাণ 30 ° -এর কম হয়ে থাকে , তাকে সংকীর্ণ বলে ।
( II) বদ্ধ ভাঁজ ( Closed Fold ) : যে সমস্ত ভাঁজের দুই বাহুর অন্তবর্তী কোণ 30 ° -60 ° -এর মধ্যে অবস্থান করে তাকে বন্ধ ভাঁজ বলে । কখনো কখনো অত্যধিক চাপের ফলে শিলান্তর ওপরের দিকে উত্থিত হয়ে উর্ধ্বভাজের নতি ( dip ) গুলো প্রায় খাড়াভাবে অবস্থান করে । এই ভাঁজগুলি অঙ্ক জায়গার মধ্যে কাছাকাছি খাড়াভাবে অবস্থান করে ।
( III ) মুক্ত ভাঁজ ( Open Fold ) : যে সমস্ত ভাঁজের দুটি বাহুর অন্তবর্তী কোণের মান 60 ° 120 ° এর মধ্যে অবস্থান করে , তখন তাকে মুখ ভাঁজ বলে অর্থাৎ কোনো শিলাস্তরে সঙ্কোচনের গতি যদি একদিক থেকেই চাপ দেয় তাহলে অতি সাধারণ ভাঁজের সৃষ্টি হবে । একে খোলা ভাজও বলে । এই ধরনের ভাঁজগুলো বেশ নীচু এবং প্রশস্ত হয় ।
( iv ) মৃদু ভাঁজ ( Gentle Fold ) : যে সকল ভাঁজের দুই বাহুর অন্তবর্তী কোণের পরিমাণ 120 ° এর বেশি কিছূ 180 ° কম হয়ে থাকে তাকে মৃদু ভাজ বলে
∆ ভাঁজের শীর্ষদেশের তীক্ষ্ণতা ও গঠন অনুসারে ভাঁজের শ্রেণিবিন্যাস ( Classification of Folds based on Sharpness of Hinge and Structure )
ভাঁজের শীর্ষদেশের তীক্ষ্ণতা ও গঠন অনুসারে ভাঁজকে কতকগুলি ভাগে ভাগ করা যায় । নিম্নে সেগুলি সম্বন্ধে আলোচনা করা হল --
( I ) তীক্ষ্ণ ভাঁজ ( Chevron Fold ) এই ধরনের ভাজ দেখতে অনেকটা সেনা বিভাগে কর্মরত ব্যক্তির পদমর্যাদায় ব্যবহৃত সূচক V আকারের বা ফিতার মতো । যে ভাঁজের উর্ধ্বভগের শীর্ষ অঞ্চল ( crest ) ও অধোভলোর নিম্ন অঞ্চল ( troughs ) গোলাকার না হয়ে তীক্ষ্ণ কোণে অবস্থান করে তাকে তীক্ষ্ণ ভাল বলে
( II ) পশ্চাদবর্ষণ ভাঁজ ( Drag Fold ) দুটি কঠিন ও দৃঢ় শিলাস্তরের মধ্যে একটি নমনীয় ও দুর্বল শিলাস্তর অবস্থান করলে ভূ - আলোড়নের ফলে কঠিন শিলাত্তর সঞ্চালিত হলে , এদের মধ্যবর্তী নমনীয় ও দুর্বল শিলাস্তরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অপ্রতিসম যে ভাঁজের সৃষ্টি হয় একে পশ্চাদকর্ষণ ভাঁজ বলে । এই ভাজ অনেকটা মাটির ওপর দাগ কেটে হেঁচড়িয়ে চলার মতো হয় ।
∆ অক্ষের অবস্থান অনুসারে ডাজের শ্রেণিবিভাগ ( Classification of Fold based on Location of Axis )
অক্ষের অবস্থান অনুসারে ভাঁজের শ্রেণিবিভাগ নিম্নে আলোচনা করা হল--
( I ) প্লাঞ্জ ভাঁজ ( Plunge Fold ) কোনো তাঁজের অক্ষ ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে সমান্তরালে না থেকে কৌণিকভাগে থাকলে যে ভাঁজ সৃষ্টি হয় । তাকে গ্লান্ত ভাঁজ বলে । শিলাস্তরে উভয় পার্শ্বস্থ চাপের তীব্রতা সর্বত্র সমভাবে না এলে এই ধরনের ভাঁজের সৃষ্টি হয় । এই ধরনের ভাঁজে ভাঁজ অক্ষের নতির দিক ও পরিমাণ উন্নস্বতল অক্ষ বরাবর প্রসারিত হওয়ার মাধ্যমে পরিমাপ করা হয়
( II ) অ-প্লাঞ্জ ভাঁজ ( Non - Plunge Fold ) যখন কোনো ভাঁজের অক্ষ অনুভূমিকভাবে অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে অবস্থান করে , তখন তাকে অ - গ্লাপ্ত ভাঁজ বলে । অধিকাংশ ভাঁজ এই প্রকৃতির ।
( II ) হেলানো ভাঁজ ( Reclined Fold ) ভীজের অঙ্ক শিলাস্তরের নতি বরাবর হেলে অবস্থান করলে তাকে হেলানো ভজ বলে ।
( iv )দ্বি - অবনত ভাঁজ ( Double Plunge Fold ) দুটি হেলানো ভাজের অক্ষ পরস্পরের বিপরীত দিকে হেলে অবস্থান করলে দ্বি - অবনত ভাঁজ তৈরি হয় ।
( v ) আঁ এঁশেলো ভাঁজ ( En Echelon Fold ) যখন একই জায়গার মধ্যে ভাঁজের হেলানো অক্ষগুলি ও ভাঁজগুলি একে অন্যের ওপর ন্যস্ত হয় , তখন তাকে আঁ এঁশেলো ভাজ বলে ।
∆ ভাঁজের স্থূলতা অনুসারে ভাঁজের শ্রেণিবিভাগ ( Classification of Folds based on Thickness )
ভাঁজের স্থূলতা অনুসারে ভাঁজকে কতকগুলি ভাগে ভাগ করা যায় যা নিম্নে আলোচনা করা হল
( I ) সমৰূপী বা সমজাতীয় ( Similar Fold ) : যেসব ভাঁজে একটি স্তরের মধ্যে অক্ষতলীয় বেধ সর্বত্র সমান থাকে তাকে সমজাতীয় বা সমরূপী ভাঁজ বলে । এই ধরনের ভাঁজে গ্রন্থির কাছে পুরু শিলাস্তর এবং বাহুতে সরু শিলাস্তর অবস্থান করে । এই ভাঁজে অপেক্ষাকৃত শত শিলাস্তরগুলি একইরকম পুরু থাকে , কিন্তু কোমল শিলান্তর প্রবাহের মাধ্যমে কঠিন স্তরগুলির সঙ্গে সামন্তস্য তৈরি করে ।
( II ) সমান্তরাল ভাঁজ ( Parallel Fold ) : যে সমস্ত ভাজে স্তরায়ণ তলগুলি পরস্পর সমান্তরাল এবং ভূত্বকের গভীরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঊর্ধ্বভলাগুলি ক্রমশ তীক্ষ্ণ এবং অধোলাগুলি বিস্তৃত হয়ে পড়ে তাদের সমান্তরাল ভাঁজ বলে । অর্থাৎ যে ভাঁজে সমকোণীয় বেধ বিভিন্ন স্তরে সর্বত্র সমান এবং ভাজের উপর ও নীচের দিক একই রকমভাবে মসৃণ হয় তাকে সমান্তরাল ভাঁজ বলে ।
( II ) ক্ষীণশীর্ষ ভাঁজ ( Supratenuous Fold ) : অনেক সময় পলি সঞ্চয় ও ভাঁজ প্রক্রিয়া একইসঙ্গে চলতে থাকে । ভাঁজ পড়ার সময় যখন সামগ্রিকভাবে ভূমির উত্থান হতে থাকে , তখন উর্ধ্বতলা অঞ্চলে কোনো স্তরের সময় কম গভীর ও ভেলোর তলদেশে ঐ স্তরের সঞ্জয় গভীর হয় । এ ধরনের ভাজকে ক্ষীণশীর্ষ তাঁজ বলে । এর ফলে ঊর্ধ্বভাগ অঞ্চল সরু ও সংকীর্ণ এবং অধোভঙ্গের অঞ্চ প্রশস্ত হয়ে থাকে ।
( iv ) বিসদৃশ ভাজ ( Disharmonic Fold ) ভাঁজ উৎপত্তির পূর্বস্তরে পলি সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে দৃঢ় ও নরম শিলা পরস্পর সম্বিত হলে চাপের প্রভাবে সব শিলান্তরে সমানভাবে ভাঁজের সৃষ্টি হয় না নরম শিলাস্তরে যেরূপ ভাঁজ পড়ে কঠিন শিলাস্তরে তার থেকে কম ভাঁজ পড়ে । ফলে অনেক সময় উত্তল অংশের নীচের স্তরে উত্তল অংশে সৃষ্টি না হয়ে অবতল বা উত্তল অংশের নীচে ঊর্ধ্বভঙ্গ ধারার সৃষ্টি হয় । এ ধরনের ভাঁজকে বিসদৃশ ভাঁজ বলে ।