প্রবাহ মানচিত্র বা প্রবাহচিত্র (flow map or flow diagram)
ধারণা (introduction)
ব্রিটিশ ভৌগোলিক ডি. এ. গিলমর (D. A. Gillmor) আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্রে গবাদিপশুর পরিব্রাজন cattle movement in the republic of Ireland) দেখাতে প্রবাহ চিত্র বা প্রবাহ মানচিত্র ব্যবহার করেন। সামাজিক ভৌগোলিকরা এই চিত্রকে গতিশীল (dynamic) মানচিত্র রূপে গণ্য করেন। পণ্য আদান-প্রদান, যাত্রী পরিবহন প্রভৃতি গাড়ির সংখ্যা রেখা বা তাঁর চিহ্ন এঁকে যখন মানচিত্রে দেখানো হয় তখন তাকে ফ্রো-ম্যাপ বা প্রবাহ মানচিত্র বলে। কোনো অঞ্চলে যদি যানবাহন চলাচল বা যাত্রী গমনাগমন বেশি হয় তবে জানতে হবে যে, ওই অঞ্চল খুবই উন্নত এবং কর্মব্যস্ত। প্রবাহ চিত্রের বিস্তৃতি যানবাহন বা যাত্রী চলাচলের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে। চলাচল বেশি হলে প্রবাহের বিস্তৃতি বা মাত্রা বেশি হবে এবং চলাচল কম হলে প্রবাহের বিস্তৃতি বা মাত্রা কম হবে। এরূপ চলাচল প্রবাহরেখার সংখ্যা এবং প্রবাহ রেখা মোটা কিংবা সরু দ্বারা দেখানো যায়। যদি প্রবাহ বেশি হয় তবে রেখার সংখ্যা বেশি হবে এবং স্বাভাবিকভাবেই বিস্তৃতি বা মাত্রা বেড়ে যাবে। এবং প্রবাহ কম হলে রেখার সংখ্যাও কম হবে। আবার প্রবাহের মাত্রা তথা বিস্তৃতি মোটা এবং সবু রেখার দ্বারা দেখানো হয়। যেখানে প্রবাহ বেশি সেখানে মোটা এবং যেখানে প্রবাহ কম সেখানে সরু রেখার দ্বারা মাত্রা বা বিস্তৃতি দেখানো হয়।
সংজ্ঞা (definition):
① বিভিন্ন পথ, যেমন- সড়ক, রেল, জলপথ ও বিমানপথে যাত্রী, পণ্য ও যানবাহন চলাচলের পরিসংখ্যান যে চিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয় তাকে প্রবাহ চিত্র বা প্রবাহ মানচিত্র বলে।
② কোনো রাস্তায় গুরুত্ব বোঝাতে যখন যাত্রী, পণ্য ও যান চলাচল সংক্রান্ত পরিসংখ্যান দ্বারা যে চিত্র আঁকা হয়, তাকে প্রবাহ চিত্র (flow diagram) বলে।
প্রবাহ চিত্রের বৈশিষ্ট্য(characteristic of flow diagram)
(1)যানবাহন প্রবাহের দিক বা অভিমুখ (directions) এই মানচিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। যান, যাত্রী, পণ্য যেদিকে চলাচল করে সেইদিকে একটি তীর চিহ্নিত সরলরেখা আঁকা হয়। প্রবাহ একমুখী (uni-direction flow) হলে প্রবাহের দিকে সর্বদা রাস্তার উভয় পাশে একই দিকে এবং উভয়মুখী (bi-direction flow) হয়ে সর্বদা রাস্তার উভয় পাশে আপ ও ডাউন পথের দিক অনুসারে বিপরীত মুখে তীর চিহ্ন আঁকা হয়।
(2)যানবাহন, যাত্রী ও পণ্য চলাচলের পরিমাণ বা সংখ্যা (amount) প্রবাহচিত্রের অপর একটি বৈশিষ্ট্য যা তীর চিহ্নিত সরলরেখার প্রস্থের (width) সঙ্গে সমানুপাতিক হয়। অনেক ক্ষেত্রে তীরের সমান্তরালে অঙ্কিত সমান প্রস্থের রেখার সংখ্যার সঙ্গে সমানুপাতিক হয়। তীর বা সরলরেখাগুলি সর্বদা মূল রাস্তার সমান্তরাল হয়।
(3)অনেক ক্ষেত্রে, রাস্তার পরিবর্তে কোনো সংযুক্ত সরলরেখা বরাবর প্রবাহচিত্র অঙ্কনকালে, প্রথমে রেখাগুলিকে দৈর্ঘ্য ও কৌণিক মান অনুসারে আঁকার পর তীর বা রেখার সাহায্যে প্রবাহ দেখাতে হয়।
(4)পরিসংখ্যানের প্রকৃতি অনুসারে একটি উপযুক্ত স্কেল নির্বাচন করতে হয় যাতে তীর চিহ্নের প্রস্থ খুব মোটা বা সরু না হয়। মানচিত্রের বা খাতার ডানদিকের নীচে চিহ্নিত করা হয়।
(5)প্রবাহ নকশায় যাতাযাতের পথ তীর চিহ্নের মুখ-এর দ্বারা দেখানো হয়।
অঙ্কন প্রণালী (method of drawing)
প্রবাহচিত্র আঁকা হয় তীরের বেধ ও রেখার সংখ্যার দ্বারা। তাই তীরের বেধ ও রেখার সংখ্যা পরিবহনের পরিমাণ ও সংখ্যার সঙ্গে সমানুপাতিক হবে। তাই নিম্নলিখিত পদ্ধতি বা প্রণালীর মাধ্যমে প্রবাহচিত্র অঙ্কন করা হয়। যথা-
① সর্বপ্রথম, প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুসারে যদি সড়ক বা রেল বা জলপথ না দেওয়া থাকে তবে সাদা কাগজে সংযুক্ত রেখার দৈর্ঘ্য ও কৌণিক মানের ভিত্তিতে (নির্দিষ্ট স্কেল অনুসারে) প্রবাহ পথটিকে অঙ্কন করো।
② মানচিত্রের বা সাদা কাগজের ডানপাশের নীচে উপযুক্ত লৈখিক স্কেল চিহ্নিত কর। যথা- 1 সেমি প্রস্থযুক্ত রেখা = 40 টি বাস, 1 সেমি= 50 কিমি দূরত্ব।
③ প্রদত্ত পরিসংখ্যা অনুসারে রাস্তার উভয় পাশে ওই নির্দিষ্ট স্কেল অনুসারে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সমান্তরাল রেখা বা নির্দিষ্ট প্রস্থের এলাকা রং বা রেখাপাত দ্বারা চিহ্নিত করে যান, যাত্রী ও পণ্য চলাচলের পরিমাণ নির্দিষ্ট করো।
④ প্রবাহচিত্র আঁকার জন্য রাশি তথ্যের প্রকৃতি অনুযায়ী একটি উপযুক্ত স্কেল নির্বাচন করো। স্কেল সঠিক না হলে চিত্র অঙ্কনে জটিলতা দেখা দিতে পারে।
⑤ সবশেষে, অঙ্কিত চিত্রের চারপাশে সরু ও মোটা রেখার সীমানা ও শিরোনাম দাও।
প্রবাহচিত্রের সুবিধা (merit) বাগুরুত্ব (importance)
(1)বাস, লরি, ট্যাক্সি, জিপ, মোটর গাড়ি, মোটর সাইকেল, রেলগাড়ি, মালগাড়ি, বিমান, জাহাজ, স্টিমার ও লঞ্চ প্রভৃতি যে-কোনো প্রকার পরিবহন যানের যাত্রী ও পণ্য চলাচলের পরিমাণকে সহজে প্রদর্শন করা যায়।
(2)প্রবাহচিত্রে রাস্তার বেধ দেখে রাস্তার ওপর যানবাহনের চাপ বোঝা যায়।
(3)এর সাহায্যে শহরের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রস্থল, বাণিজ্য, শিল্পকেন্দ্রও স্থানগুলিকে সহজে চিহ্নিত করা যায়।
(4)কম, বেশি বা মাঝারি মাত্রায় পরিবহন ও যোগাযোগ সুবিধাযুক্ত স্থান বা এলাকা নির্দিষ্ট করা যায়।
(5)কোনো অঞ্চলের অর্থনৈতিক কাজকর্ম, জনবসতির পরিমাণ সম্পর্কে সুস্পষ্ট রূপরেখা পাওয়া যায়।
(6)সর্বোপরি, পরিসংখ্যার হিসেব ও অঙ্কনের কোনোরূপ জটিলতা নেই।
(7)এই চিত্রে খুটি খানবে একটি রেখামায়া যুক্ত করা হয় যা বক্ররেখা বা সরলরেখা উভয়ই হতে পারে। এই রেখাটি হল পণ্য/মানুষ/তথ্য/যানবাহন পরিবহন বা প্রবাহের পথ। এরপর তথ্য অনুসারে প্রগাহের তীব্রতাকে লক্ষ্য রেখে ওই প্রবাহণনের প্রস্য বড় বা ছোট করা হয়। এটি একটি যুগগত পদ্ধতি।
(8)অনেক সমায়, প্রবাহলম্বের প্রশ্ন এক রেখে প্রবাহের তীব্রতা একাধিক সাগ্যক রেখার দ্বারা প্রকাশ করা হয় অথনি যেখানে বেশি প্রবাহ সেখানে বেশি সংখ্যক রেখা দেখানো হয়। এটি একটি পরিমাণগত পদ্ধতি।
প্রবাহচিত্রের অসুবিধা (demerit of flow diagram)
① প্রবাখচিত্র থেকে দৈনিক গড় বা সারা বছরের গড় যান চলাচলের চিত্র পাওয়া গেলেও যান চলাচলের ঋতুগত বা দৈনিক সময়গত হ্রাস-বৃদ্ধি বোঝায় না।
② ঘন জালিকার মতো রাস্তাঘাটের বিন্যাস ঘটলে প্রবাহচিত্র অঙ্কন ও প্রদর্শন খুবই জটিলাকার ধারণ করে।
প্রবাহচিত্র অঙ্কনের মূলনীতি
প্রবাহচিত্র আঁকা হয় তীরের বেধ (width) বা রেখার সাহায্যে। অর্থাৎ-
① প্রবাহচিত্র তীরের বেধ পরিবহনের পরিমাণ ও সংখ্যার সঙ্গে সমানুপাতিক হয়।
② রেখার সংখ্যা পরিবহনের পরিমাণ বা যানবাহনের সংখ্যার সঙ্গে সমানুপাতিক হয়।