বিষয়ভিত্তিক মানচিত্র অঙ্কন কৌশল(Thematic Mapping Techniques)
বিষয়ভিত্তিক মানচিত্রের ধারণা (concept of thematic map)
মানচিত্রবিদ্যার (কার্টোগ্রাম) উদ্ভব এবং তার বর্তমান রূপরেখার মধ্যে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস এবং এই মানচিত্র অঙ্কন কোথায় আরম্ভ হয়েছিল সেই বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা না পাওয়া গেলেও গুহা মানবের কালে তাদের অঙ্কিত গুহাচিত্রগুলি মানচিত্রবিদ্যার আদি ইতিহাস বললে কিছু ভুল বলা হয় না। তবে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত মানচিত্রবিদ্যার সূচনা সপ্তদশ শতাব্দীতে যখন ফরাসীরা দ্রাঘিমা বরাবর দৈর্ঘ্য পরিমাপের মধ্যে দিয়ে ফ্রান্সের সঠিক সীমানা নির্ধারণ করে এবং পরবর্তী সময়ে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগের ফ্রান্সে স্থানীয় বৈচিত্র্যসূচক মানচিত্রের অবতারণার সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ হয় বিষয়ভিত্তিক মানচিত্রের (thematic map) অঙ্কন পদ্ধতি। ইংরেজিতে 'theme' শব্দের অর্থ 'মূল বিষয়বস্তু'। ভূগোলে যখন কোনো বিশেষ অঞ্চলের উপর কোনো একটি বা দুটি বিষয়কে পরিষ্কার করে দেখানো হয় তখন তাকে বিষয়ভিত্তিক মানচিত্র বা থিমেটিক ম্যাপ বলে। তবে থিম (theme) শব্দটির মূল অর্থ বিবেচনা করলে সমস্ত মানচিত্রই বিষয়ভিত্তিক বা কোনো না কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে অঙ্কন করা হয়। তাই সমস্ত মানচিত্রকেই বিষয়ভিত্তিক বললে কিছু ভুল বলা হয় না। প্রকৃতপক্ষে বিষয়ভিত্তিক মানচিত্র (থিয়েটিক ম্যাপ) বলতে আমরা একটি বিশেষ শ্রেণির মানচিত্রকে বুঝি যা একটিমাত্র বিশেষ প্রসঙ্গে অঙ্কিত হয় এবং অন্য কোনো বিষয় মানচিত্রটিতে দেখানো হলেও তা শুধু মুখ্য বিষয়টি যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে।
বিষয়ভিত্তিক মানচিত্রের সংজ্ঞা (definition of thematic map)
বিষয়ভিত্তিক মানচিত্রকে ইংরেজিতে থিমেটিক ম্যাপ (thematic map) বলা হয়। ইংরেজি 'theme' কথার অর্থ 'মূল বিষয়বস্তু'।
(1)কোনো বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করে সাধারণত যে মানচিত্র অঙ্কন করা হয় তাকে বিষয়ভিত্তিক মানচিত্র বা থিমেটিক ম্যপ বলে।
(2)কোনো বিশেষ পদ্ধতিতে যে মানচিত্রের মাধ্যমে কোনো স্থানের ভূ-প্রকৃতি, মৃত্তিকা, ভূ-তত্ত্ব, জলবায়ু, স্বাভাবিক উদ্ভিদ, বিভিন্ন অর্থনৈতিক বিষয়, জনসংখ্যা, কৃষি, বিভিন্ন শিল্প দ্রব্যের উৎপাদন, বণ্টন, আমদানি-রপ্তানি প্রভৃতি সুন্দর ও সহজ উপায়ে দেখানো সম্ভব হয় তাকে বিষয়ভিত্তিক মানচিত্র বলে।
(3)A map created to display information about a topic or theme. Themes can be shown with a choropleth (color), a scaled-symbol, charts or dot-densities.
(4)A geographic-map that displays the spatial pattern of a theme or series of attributes.।
বিষয়ভিত্তিক মানচিত্র অঙ্কনের উদ্দেশ্য
(1)প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক এবং জনসংখ্যা সংক্রান্ত বিষয়াবলি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ।
(2)পরিসংখ্যানভিত্তি হওয়ায় চিত্রে এর বিজ্ঞান সম্মত উপস্থাপনা সম্ভব হয় (পরিসংখ্যানের শ্রেণিবিন্যাস ও চিত্রায়ণ)
(3)বিষয়মূলক মানচিত্র পাঠে প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক বিষয়ে জ্ঞানলাভ সহজ হয় অর্থাৎ এর একটি শিক্ষামূলক দিক আছে। বিষয়মূলক মানচিত্রের ব্যবহার গবেষণার বিষয় বস্তুটিকেও ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করে।।
A] প্রাকৃতিক মানচিত্র (Physical maps):
পাহাড়, পর্বত, মালভূমি প্রভৃতি ভূ-প্রাকৃতিক বিষয়সমূহ, নদী সংক্রান্ত, সাগর-মহাসাগর, ভূতত্ত্ব, মৃত্তিকা, জলবায়ু, আবহাওয়া, স্বাভাবিক উদ্ভিদ প্রভৃতি প্রদত্ত বিষয়সমূহ হল প্রাকৃতিক মানচিত্রের প্রতিপাদ্য বিষয়। প্রতিটি প্রাকৃতিক বিষয়ের আলাদা আলাদা মানচিত্র অঙ্কন করা হয়। প্রাকৃতিক মানচিত্রের অন্তর্গত প্রধান মানচিত্রগুলি নীচে আলোচনা করা হল।
ভূতাত্ত্বিক মানচিত্র (geological maps):
সংজ্ঞা: কোনো স্থানের ভূত্বকের, অভ্যন্তরের গঠন, মৃত্তিকার স্তর বিন্যাসের ধারা এবং বিভিন্ন প্রকার শিলার অবস্থান, গঠন প্রকৃতি, গভীরতা প্রভৃতি যেসব মানচিত্রে দেখানো হয় তাদের ভূ-তাত্ত্বিক মানচিত্র বলে।
গুরুত্ব: (i) ভূপৃষ্ঠের কোথায় কীরূপ শিলা রয়েছে তার ভৌগোলিক বন্টন এবং ভূত্বকের অভ্যন্তরের বিভিন্ন শিলাস্তরের বিন্যাস কিরূপ তা ভূতাত্ত্বিক মানচিত্র থেকে জানতে পারা যায়। (ii) ভূপৃষ্ঠের প্রাকৃতিক বিভাগগুলি ও মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্য, খনিজের বন্টন ও ভৌমজলের সরবরাহ সংক্রান্ত সমস্যা প্রভৃতি বোঝার জন্য এই প্রকার মানচিত্র আমাদের সাহায্য করে। (iii) ভূত্বকের উপরের অংশ যেসব শিলা দ্বারা গঠিত সেই সব শিলার প্রকৃতি, বয়স, গঠন ও বিভিন্ন শিলার মধ্যে সম্পর্ক সম্বন্ধে তথ্য পাওয়া যায় এই প্রকার মানচিত্র থেকে।
বন্ধুরতা মানচিত্র (relief maps):
সংজ্ঞা: যেসব মানচিত্রে ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানের উচ্চতা, গভীরতা, ভূমিরূপ তথা বিভিন্ন অঞ্চলের পাহাড়, পর্বত, মালভূমি, সমভূমি, উপত্যকা, নদনদী প্রভৃতি সম্পর্কিত বিষয়ের উল্লেখ থাকে তাদের বন্ধুরতা মানচিত্র বলে।
রীতি বা পদ্ধতি: মূলত সমোন্নতি রেখার সাহায্যে ভূমির বন্ধুরতা দেখানো হলেও ভূমির উচ্চতা বা বন্ধুরতা নির্দেশ করতে সচরাচর হালকা থেকে গাঢ় রং-এর মাধ্যমে দেখানোর রীতি প্রচলিত রয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে সমোন্নতি রেখার সঙ্গে মিলিয়ে ভূরেখা, স্পট-হাইট, বেঞ্চ মার্ক প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়।
মৃত্তিকা বিন্যাস মানচিত্র (soil distribution maps):
সংজ্ঞা: যেসব মানচিত্রের মাধ্যমে পৃথিবীর কিংবা বিভিন্ন মহাদেশের বা দেশের এমনকি রাজ্য কিংবা জেলা বা অঞ্চলের মৃত্তিকার বন্টন দেখানো হয় তাদের মৃত্তিকা বিন্যাস মানচিত্র বলে।
পদ্ধতি: বিভিন্ন রং বা সাংকেতিক চিহ্নের সাহায্যে এই প্রকার মানচিত্র প্রস্তুত করা হয়।
জলবায়ু মানচিত্র (climatic maps): বহু বছরের আবহাওয়ার গড় অবস্থা যেসব মানচিত্রে দেখানো হয় তাদের জলবায়ু মানচিত্র বলে। পৃথিবীর জলবায়ুসমূহ প্রধানত অক্ষাংশ ভিত্তিক।
আবহাওয়া মানচিত্র (weather maps): আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদান, যথা- বায়ুর উয়তা, বায়ুচাপ, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত মেঘাচ্ছন্নতা, বায়ুপ্রবাহের দিক ও বেগ প্রভৃতি সম্পর্কিত মানচিত্রগুলিকে আবহাওয়া মানচিত্র বলে।ভারতে আবহাওয়া মানচিত্র তৈরি আরম্ভ হয় 1864 খ্রিস্টাব্দে। তখন এর অফিস ছিল বর্তমান হিমাচলপ্রদেশের রাজধানী সিমলা শহরে। 1914 খ্রিস্টাব্দে এই কেন্দ্রীয় আবহাওয়া অফিস মহারাষ্ট্রের পুনে শহরে স্থানান্তরিত হয়। এটিই বর্তমানে ভারতের বৃহত্তম আবহাওয়া অফিস এবং এখান থেকেই ভারতের যাবতীয় আবহাওয়া সংক্রান্ত মানচিত্র প্রকাশিত হয়। আবহাওয়া মানচিত্রে আবহাওয়ার উপাদান সাধারণত বিবেচিত হয়। যেমন- ক) তাপমাত্রা, খ) বায়ুচাপ, গ) বায়ুপ্রবাহ, ঘ) আর্দ্রতা, ঙ) মেঘ সণ্যরণ ④ ও চ) অধঃক্ষেপণ তথা বৃষ্টিপাত। এদের মধ্যে যে কোনো একটির পরিবর্তনেই আবহাওয়ার সামগ্রিক বা আংশিক পরিবর্তন ঘটতে পারে।
(6)উদ্ভিদ মানচিত্র (vegetation maps): পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের প্রাকৃতিক উদ্ভিদের বন্টন যেসব মানচিত্রে দেখানো হয় তাদের উদ্ভিদ মানচিত্র বলে।
(7)জ্যোতিষ্ক মানচিত্র (astronomical maps): আকাশের বিভিন্ন গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, ধূমকেতু, নীহারিকা প্রভৃতির অবস্থান ও পারস্পরিক দূরত্ব যেসব মানচিত্রে দেখানো হয় তাদের জ্যোতিষ্ক মানচিত্র বলে।
B] সাংস্কৃতিক মানচিত্র (cultural maps):
পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষের স্থানভেদে যেসব সাংস্কৃতিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় তার উপর ভিত্তি করে যেসব মানচিত্র অঙ্কিত হয় তাদের সাংস্কৃতিক মানচিত্র বলে। এইসব সাংস্কৃতিক মানচিত্র পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ধারার বণ্টন পরিলক্ষিত হয়। কৃষিজ, খনিজ, শিল্পজ উৎপাদন, বণ্টন মানচিত্র, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ঐতিহাসিক, সামরিক, ভূমির ব্যবহার প্রভৃতি সম্পর্কিত মানচিত্র; এছাড়া শহরের নকশা, বিমান চালনা সংক্রান্ত চার্ট, নৌবহনচার্ট প্রভৃতি মানচিত্র সাংস্কৃতিক মানচিত্রের অন্তর্গত। বিভিন্ন প্রকার সাংস্কৃতিক মানচিত্রের সংক্ষিপ্ত পরিচয় নীচে দেওয়া হল-
(1)সামাজিক মানচিত্র (social maps): মানবধারা, সামাজিক সংঘ, সম্প্রদায়, গোত্র, জাতি, উপজাতি তাদের। ভারতের সামাজিক রীতিনীতি প্রভৃতি সম্পর্কিত তথ্য সরবরাহ করা হয় সামাজিক মানচিত্রে।
(2)রাজনৈতিক মানচিত্র (political maps): পৃথিবীর মানচিত্রে বিভিন্ন দেশের অবস্থান, সীমানা, বিভিন্ন দেশের স্বতন্ত্র মানচিত্রে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক এককের সীমানা, রাজনৈতিক মানচিত্রে দেখানো হয়। এই প্রকার মানচিত্রগুলি সাধারণ 1: 16,500,000 এবং 1: 33,000,000 স্কেলে অঙ্কন করা হয়।
(3)আঞ্চলিক মানচিত্র (regional maps): ব্যাপক অর্থে এবং সুবিধামতো যথেচ্ছভাবে অঞ্চল শব্দটি ব্যবহৃত হলে প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব আকার, সীমানা ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং প্রতিটি অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য স্বতন্ত্র। স্কেলের পার্থক্য অনুসারে এই সব আঞ্চলিক মানচিত্রের আকার বিভিন্ন প্রকারের হয়।
(4)জনসংখ্যা মানচিত্র (population maps): জনসংখ্যা বণ্টন (population distribution), জনগনত্ব (population density), জনসংখ্যা বৃদ্ধি (population growth), বয়ঃ ও লিঙ্গা জনবিন্যাস ধর্ম, ভাষ্য ও সামাজিক বিভাগ, পেশাভিত্তিক গঠন প্রভৃতি সংক্রান্ত মানচিত্রকে জনসংখ্যা মানচিত্র বলা হয়। এই প্রকার মানচিত্র বিভিন্ন প্রকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ণ পরিকল্পনা ও অন্যান্য অনেক কাজে দরকার হয়।
(5)অর্থনৈতিক মানচিত্র (Economic maps): অর্থ উপার্জনের উৎসগুলিকে ভিত্তি করে যেসব মানচিত্র অঙ্কন করা হয় তাদের অর্থনৈতিক মানচিত্র বলে, কৃষিজ খনিজ, শিল্পজ, বনজ প্রভৃতি দ্রব্যের বন্টন, তাদের উৎপাদন কেন্দ্রের অবস্থান এবং পারস্পরিক সম্পর্ক এবং ওইসব দ্রব্যের শিল্প কেন্দ্রে আনয়ন ও ভোগকারীদের মধ্যে প্রেরণের জন্য সড়কপথ, রেলপথ, নদীপথ, সামুদ্রিক পথ প্রভৃতি এই প্রকার মানচিত্রে দেখানো হয়।
(6)ভূমি ব্যবহার মানচিত্র (Land use maps): যেসব মানচিত্রে কোনো দেশ বা অঞ্চলের ভূমির ব্যবহার সম্পর্কিত তথ্য পরিবেশন করা হয় সেগুলিকে ভূমি ব্যবহার মানচিত্র বলে।
(7)প্রশাসনিক মানচিত্র (administrative maps): যে কোনো দেশের প্রশাসনিক কাজের সুবিধা জন্য প্রশাসনিক এলাকার সীমানা নির্দেশের জন্য এই প্রকার মানচিত্র প্রস্তুত করা হয়। রাজ্য, জেলা, প্রভৃতি প্রশাসনিক বিষয়ে তথ্য এই প্রকার মানচিত্র থেকে পাওয়া যায় । বৃহৎ স্কেলের প্রশাসনিক মানচিত্র আঁকার ছোট হওয়ার সেইগুলির বিস্তারিত তথ্য পরিবেশ করা সম্ভব হয় না।
(8) ঐতিহাসিক মানচিত্র( historical maps): ইতিহাস সম্পর্কিত ঘটনা বলি উল্লেখিত মানচিত্র কে ঐতিহাসিক মানচিত্র বলে।
(9) সামরিক মানচিত্র (military maps): সামরিক কাজে ব্যবহৃত ও কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থান, যুদ্ধক্ষেত্র, প্রতিরক্ষা শিবির প্রভৃতি সংক্রান্ত তথ্য সম্বলিত মানচিত্রকে সামরিক মানচিত্র বলে।