পরিবহন জালিকা বিশ্লেষণ(Transport Network Analysis)
দূরত্বের ধারণা (concept of distance)
পরিবহনের ক্ষেত্রে দূরত্বের ধারণা একান্ত জরুরী। দূরত্ব বলতে দুটি বস্তুর মধ্যবর্তী দেশকে বোঝায়। অর্থাৎ distance is a space or interval between two things আবার, দূরত্ব হল যেকোনো দুটি নির্দিষ্ট বিন্দুর (fixed points) মধ্যবর্তী আপেক্ষিক অবস্থান (relative position)। দূরত্বকে সম্পর্কের (relationship) দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখা যায়। সেক্ষেত্রে দূরত্ব (distance) হল দুটি বস্তুর মধ্যে এক বিশেষ ধরনের সম্পর্ক বা সম্বন্ধ, যাকে পরিমাপ করা যায় এবং প্রকাশ করা যায়। এই সম্পর্ক অর্থনৈতিক, সময়ভিত্তিক, জ্যামিতিক ইত্যাদি নানা রকমের হতে পারে।
বিভিন্ন ধরনের দূরত্ব (types of distance)
চরম দূরত্ব বা সুনিশ্চিত দূরত্ব (absolute distance):
আলোচ্য দূরত্ব হল দুটি নির্দিষ্ট স্থানের মধ্যবর্তী পরিমাপযোগ্য দূরত্ব, যাকে যেকোনো দূরত্ববোধক এককের সাহায্যে প্রকাশ করা যায়, যেমন কিলোমিটার-মিটার-সেন্টিমিটার এককে মাপা দূরত্ব অথবা মাইল-গজ-ফুট-ইঞ্চির ভিত্তিতে পরিমাপ করা দূরত্ব। কোনো ব্যাপক প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছাড়া চরম দূরত্বকে পরিবর্তন করা যায় না।
আপেক্ষিক দূরত্ব (relative distance):
আলোচ্য দূরত্বের ধারণা পরিবর্তনযোগ্য। যখন কোন দুটি নির্দিষ্ট স্থানের মধ্যবর্তী দূরত্বকে ব্যয় বা খরচ (cost), সময় (time), সুবিধা (convenience) প্রভৃতি চলক (variable) বা গুণগত চলকের (attribute) সাহায্যে প্রকাশ করা হয়, তখন তাকে আপেক্ষিক দূরত্ব বলে। যেমন-
① ব্যয়ভিত্তিক দূরত্ব বা কস্ট ডিসট্যান্স (cost distance):কোনো দেশ বা অঞ্চলে প্রচলিত মুদ্রা (currency). পরিবহনের মাধ্যম (mode), পরিবহনযোগ্য পণ্য বা যাত্রীদের পরিমাণ ও সংখ্যা, পণ্যের চরিত্র, গন্তব্যের অবস্থান ইত্যাদির দ্বারা নির্ধারিত দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য খরচকে ব্যয়ভিত্তিক দূরত্ব বা কস্ট ডিসট্যান্স বলে। যেমন, ট্রেনপথে কোনো স্থানের ব্যয়ভিত্তিক দূরত্ব 1000 টাকা, কিন্তু আকাশপথে ৪০০০ টাকা।
② সময় দূরত্ব বা টাইম ডিসট্যান্স (time distance): দুটি স্থানের মধ্যবর্তী দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য যে সময় লাগে তাকে সময় দূরত্ব বা টাইম ডিসট্যান্স বলে। এক্ষেত্রে পরিবহন পথের সুগমতা (accessibility), পরিবহনযোগ্যতা (transportability), পরিবহন মাধ্যমে (mode) বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি বিষয়ের উপর সময় দূরত্বের পরিমাপ নির্ভর করে। যেমন, ট্রেনপথে কোন স্থানের সময় দূরত্ব 2 দিন কিন্তু আকাশপথে 2 ঘন্টা।
③স্বাচ্ছন্দ্য দূরত্ব বা কনভিনিয়েন্স ডিসট্যান্স (convenience distance): সুযোগ, সুবিধা, বা আয়াসহীনভাবে কোনো দূরত্ব অতিক্রম করার সহজতা বা সাবলীলতাকে স্বাচ্ছন্দ্য দূরত্ব বা কনভিনিয়েন্স ডিসট্যান্স বলে। যাত্রী ও মান পরিবহনের কাজ কোথায় কতটা সহজ, সেটি প্রকাশ করার জন্য স্বাচ্ছন্দ্য দূরত্ব বা কনভিনিয়েন্স ডিসট্যান্সের সাহায্য নেওয়া হয়। আলোচ্য স্বাচ্ছন্দ্যের মাত্রা অনুসারে কোনো জায়গায় জমির দাম বাড়ে বা কমে, শিল্প স্থাপিত হয়, শিল্প সমাবেশ ঘটে, ভ্রমণার্থী বা ট্যুরিস্টের সংখ্যা কমে বা বাড়ে ইত্যাদি।
জ্যামিতিক দূরত্ব (geometric distance):
দুটি মিডিয় স্প্যানের মধ্যবর্তী পরিসরের জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত দূরত্বকে জ্যামিতিক দূরত্ব বলে। জ্যামিতিক দূরত্ব নানা ধরনের হতে পারে। যেমন-
① সরলরৈখিক দূরত্ব বা ন্যূনতম দূরত্ব (straight-line distance or minimum distance): দুটি বিন্দুর মধ্যবর্তী দূরত্ব যখন সরলরেখাকে অনুসরণ করে তখন ওই দূরত্বকে সরলরৈখিক দূরত্ব বা স্ট্রেট লাইন ডিসট্যান্স বলে। এটি সর্বদা দুটি নির্দিষ্ট বিন্দুর মধ্যে। ন্যূনতম দূরত্ব। ইউক্রেন্ডীয় জ্যামিতি অনুসারে সরলরৈখিক দূরত্বের পরিমাপ করা যায়। ধরা যাক, একটি দ্বিমাত্রিক সমতলে P ও Q. দুটি নির্দিষ্ট বিন্দু। ৪ বিন্দুর স্থানাঙ্ক (x, ৮) এবং ৫ বিন্দুর স্থানাঙ্ক। তাহলে ও বিন্দুর মধ্যে সরলরৈখিক দূরত্ব (d <= 0) নির্ধারণের সমীকরণ হবে।
অথবা,
s' = sqrt((x - x') ^ 2 + (y - y') ^ 2) d' = [(x - x') ^ 2 + (y - y') ^ 2] ^ (2/2)
② ম্যানহাটন দূরত্ব বা ট্যাক্সিক্যাব দূরত্ব (manhattan distance or taxicab distance): আলোচ্য দূরত্বট একটি বিশেষ ধরনের জ্যামিতিক দূরত্ব। একটি দ্বিমাত্রিক সমতলে ৪ ও ৫ দুটি নির্দিষ্ট বিন্দুর মধ্যে দূরত্ব একটি সমকোণী ত্রিভুজ দ্বন্দ্ব-এর অতিভুজের দৈর্য্যের সাপেক্ষে নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ সমীকরণ অনুসারে
PQ = √PR ²+ QR²)
কিন্তু P বিন্দু থেকে Q বিন্দুতে পৌঁছাতে হলে অঙ্গ অতিভুজ বরাবরই যে যেতে হবে, তার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। এক্ষেত্রে PQ-PR+QR
সুতরাং একটি সমকোণী ত্রিভুজের সাপেক্ষে অতিভুজের প্রান্ত হয়ে অবস্থিত দুটি বিন্দুর মধ্যবর্তী দূরত্ব যখন ওই ত্রিভুজের ভূমি ও লম্বের দৈর্ঘ্যের যোগফলের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়, তখন সেই দৈর্ঘ্যকে ম্যানহাটন দূরত্ব বা ট্যাক্সিক্যাব দূরত্ব বলে। আলোচ্য দূরত্বের দৈর্ঘা অতিভুজের দৈর্ঘ্যের তুলনায় সর্বদা বেশি। ম্যানহাটন বা ট্যাক্সিক্যাব দূরত্ব পৃথিবীর যেকোনো বড় শহরের যানবাহনকে জ্যামজট এড়াবার জন্য অতিক্রম করতে হয়। নগর প্রশাসন এবং ট্রাফিক পুলিশ কর্তৃপক্ষ বহুক্ষেত্রে যানবাহন চলাচলে গতি অনার জন্য ম্যানহাটন দূরত্ব বা ট্যাক্সিক্যাব দূরত্ব লাগু করেন।
দূরত্বের ভৌগোলিক গুরুত্ব (geographical significance of distance)
* বিভিন্ন খানের মধ্যে সুগমত্য বা অ্যাকসেসিবিলিটি (accessibility) পরিমাপের অন্যতম সূচক হল দূরত্ব।
* দূরত্ব অর্থনৈতিক কাজকর্মের মাত্রা ও প্রগাঢ়তা (intensity) কে প্রভাবিত করে।
* দূরত্ব বৃদ্ধি পেলে পরিবহন ক্ষেত্রে প্রচলিত লাইন হল কষ্ট (line haul cost) বৃদ্ধি পায়। প্রসঙ্গাত, কোন অঞ্চল বা এলাকায় পরিবহন ব্যায় ব্ল্যাংকেট (blariket) বা পোস্টেজ স্ট্যাম্প রেট (postage stamp rate) অনুসারে নির্ধারিত হলে, দূরত্ব পরিবহন ব্যয়কে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করে না।
* ভন খুনেন বা ফন ঘুনেন (Von Thunen)-এর মডেল অনুসারে শহর বা বাজার থেকে দূরত্ব (d >= 0) বাড়লে জমির ব্যবহারিক (land use) চরিত্র বদলে যায়।
* ওয়েবারের (Weber) শিল্প স্থানিকতার ন্যূনতম বায় তত্ত্ব অনুসারে বাজার (M) এবং কাঁচামালের বিভিন্ন অবস্থান (ধরা যাক R_{1} otimes R 2 ) এর সাপেক্ষে বায়ারে যোগান দেওয়ার জন্য উৎপাদিত পণ্যের পরিমাণ এবং ওই লণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের পরিমাণ শিল্পের অবস্থান P-কে নিয়ন্ত্রণ করে। এমতাবস্থায় একটি দ্বিমাত্রিক সমতলে P-র অবস্থান P_{1}, P_{2}, P_{3} ,...,P n * Phi সরে যেতে পারে। ফলে দূরত্বের হ্রাসবৃদ্ধি হয়।
* অগাস্ট ল্যশের (August Losch) মুনাফা সর্বাধিকীকরণ তত্ত্ব অনুসারে উৎপাদন কেন্দ্র থেকে দূরত্ব যত বৃদ্ধি পায় দাম তত বৃদ্ধি পায় এবং চাহিদা তত কমে। অর্থাৎ স্থানগত চাহিদা শঙ্কু (spatial demand cone)-এর ঢাল কমতে থাকে। ফলে মুনাফা হ্রাস পায়।