welcome to mygeo.in Indian no 1 geography based website in Bengali

সভ্যতার বিবর্তণে পরিবেশ সম্পর্কে উপলব্ধি পরিবর্তন (Perception of environment through civilization)

ঋকবেদে (খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২০০০) উল্লেখ আছে, 'যদি তুমি হাজার হাজার বছর ধরে জীবনে সুখ পেয়ে যেতে চাও তবে নিয়মিতভাবে বৃক্ষ সৃজন করে যেও'। অরণ্য নিধন..

               সভ্যতার বিবর্তণে পরিবেশ সম্পর্কে উপলব্ধি পরিবর্তন (Perception of environment through civilization)               


প্রাচীন যুগে পরিবেশ উপলব্ধি ঃ

 ঋকবেদে (খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২০০০) উল্লেখ আছে, 'যদি তুমি হাজার হাজার বছর ধরে জীবনে সুখ পেয়ে যেতে চাও তবে নিয়মিতভাবে বৃক্ষ সৃজন করে যেও'। অরণ্য নিধন এর বিরোধিতা করে ঋকবেদে বলা হয়েছে, জলভাগ এর ধারে ধারে বৃক্ষ সৃজন করলে পাড় ভাঙবে না এবং বন্যা বিপর্যয় থেকে বাঁচাবে, পরিবেশগত উপলব্ধির এ এক চমৎকার বক্তব্য।


বৈদিক যুগে বৈদিক সাহিত্য আরণ্যক বা অরণ্য গ্রন্থ প্রকৃতির সঙ্গে মানব জীবনের সম্পর্কটি উপলব্ধি করে বৃক্ষের উপযোগিতা বিষয়ে মানুষ বরাবরই বিশেষ সচেতন ছিলেন এবং বৃক্ষ তলদেশে পূজা-পার্বণ সনাতন ধর্মে বহু প্রচলিত। আজও বিভিন্ন আদিবাসী সমাজের মানুষজন যারা প্রকৃতির মধ্যেই জীবন যাপনে অভ্যস্ত, বৃক্ষকে দেবজ্ঞানেপূজা করেন। চতুর্বেদ-এ বিভিন্ন ঔষধি ফুল ও ফল সম্পর্কে মানুষের উন্নততর উপলব্ধির পরিচয় মেলে। অকারণে গাছপালা বিনষ্ট করা বা আঘাত করা অনুচিত বলা হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই তুলসী গাছ কে দেবী জ্ঞানে পূজা করা হয়। হিন্দু ধর্মে বেলপাতা পূজার নৈবেদ্যে দেওয়ার চল রয়েছে, ফুল-ফলাদির সঙ্গে। বৈদিক শাস্ত্রে উল্লিখিত হয়েছে, "মাতা ভূমিপুত্রাহম পৃথিবায়'। অর্থাৎ ধরিত্রী হলেন মাতা, আমি মানুষ তার সন্তান। মহাভারতে বলা হয়েছে বৃক্ষ ফুল ও ফল দ্বারা এই জগতের সন্তুষ্টি বিধান করে। যারা একটি বৃক্ষ প্রদান (সৃজন অর্থে) করেন। তারা উক্ত বৃক্ষ দাঁড়াই অন্য লোকে মুক্তি পান।


মুনি ঋষিগণ সাধনার জন্য বনের পবিত্র নিরালা পরিবেশকে বেছে নিতেন এবং বৃক্ষ তলে উপবেশন করে সাধনায় নিমগ্ন হতেন।


ভাগবত গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, 'একটি পত্র, ফুল, ফল বা জল যাহাই প্রদান করা হোক, তা নিষ্ঠার সঙ্গে গ্রহণ করো"। এখানেও প্রকৃতি ও পরিবেশের তাৎপর্য কতখানি অন্তর্নিহিত তা উপলব্ধি করা যায়।


রামায়ণ ও মহাভারতে যথাক্রমে দশরথ পুত্র ও পান্ডবদের বনবাস-এর বিবরণ দেওয়া আছে। এই বনবাসকালে তারা কেবল অরন্যের ওপর নির্ভর করেন নি, পশু, পাখি ও জঙ্গলের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন এবং প্রকৃতি ও পরিবেশের বিষয়ে সমৃদ্ধ হয়েছেন।


জৈন ধর্মে চব্বিশটি তীর্থঙ্করের সবকটি পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত। গৌতম বুদ্ধ (খ্রিস্টপূর্ব ৬--৫ শতকে যে উপদেশ বাণী দিয়েছেন তাতে বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্যের নির্দেশ পাওয়া যায়, যেখানে পশু বলির বিরুদ্ধে বলা হয়েছে। অহিংসা পালন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহে প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক প্রাণিকুলের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছে।


মনুসংহিতায় অরন্যের উপলব্ধি খুব সুন্দর প্রতিভাত হয়েছে। মনু বলেছেন জল কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, সর্বসাধারণের অধিকার রয়েছে এতে। তাই জলকে কেউ যেন দুষিত না করে। তিনি বায়ু দূষণের চিন্তাভাবনা 

থেকে বলেছেন, “অগ্নিতে কোন অবিশুদ্ধ বস্তু যেন নিক্ষেপ না করা হয় কারণ তাতে উৎপন্ন ধোয়া পরিবেশের পক্ষে বিষময় হয়। মনুসংহিতায় আরো বলা হয়েছে, 'নিজের সুখের জন্য যে নিরীহ জীবনের ক্ষতি করে সে জীবনে কখনো সুখ পাবেনা'।


খ্রীষ্টপূর্ব ২ শতকে লেখা 'চরক সংহিতা'য় পরিবেশ চিন্তার উল্লেখ পাওয়া গেছে। বলা হয়েছে 'বায়ুমন্ডল, ভূমি ও সময় জীবের আগ্রগতির মূল'।


গ্রিক দার্শনিক রুশো অষ্টাদশ শতকে নোবেল সার্ভেজ (Nobel Savage) নামে যাদের উল্লেখ করেছেন তারা প্রকৃতির সন্তান, প্রকৃতিকে উপলব্ধি করে প্রকৃতির মধ্যেই বাঁচার রসদ জুগিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে তারা অভিযোজন ঘটিয়ে তারা তাদের জীবন নির্বাহ করেন। অকৃত্রিম জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত এই মানুষগুলির সহজ সরল সুন্দর জীবনযাত্রায় রুশো মুগ্য হয়েছিলেন। শেতাঙ্গ ঔপনিবেশিকগণ উত্তর আমেরিকায় অরণ্যনির্ভর জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত রেড ইন্ডিয়ানদের তথাকথিত সভ্য জীবনযাত্রায় আনতে ব্যর্থ হলে তাদেরকে রুশো বর্ণিত নোবেল সার্ভেজ নামে চিহ্নিত করেছিলেন।


কৃষিকাজে এবং পশু পালনের মধ্য দিয়ে প্রাচীন সভ্য মানুষ প্রকৃতিকে তার প্রয়োজনে ব্যবহার করার উপলব্ধির সাহায্যে উক্ত ক্ষমতা আয়ত্ত করেছিলেন।


প্রাচীন কৃষিভিত্তিক সভ্যতা :

 প্রাচীনকালে কৃষিভিত্তিক সভ্যতা শুরু হলে মানুষ পরিবেশে প্রাপ্ত জল দিয়ে কৃষিক্ষেত্রে জলের ব্যবহারের প্রয়োজন উপলব্ধি করে। জলসেচের কাজে বৃষ্টির জল ধরে রেখেছে। নালী খনন করে নদীর সঙ্গে কৃষিক্ষেত্রকে যুক্ত করেছে। সিন্ধু সভ্যতায় মাহেরোদারো, হরপ্পায় এরূপ নালী মাধ্যমে জল সরবরাহের হদিশ পাওয়া গেছে। এভাবে মানুষ সেই প্রাচীন যুগেই যে পরিবেশকে উপলব্ধি করে কাজে লাগাতে শিখেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।


খ্রীষ্টপূর্ব ৬ শতক আগে আইসল্যান্ডের মানুষজন অতিরিক্ত পশুচারণ জনিত ভূমিক্ষয় রোধ কল্পে জমিতে চারণযোগ্য পশু সংখ্যার উর্ধ্বসীমা বেঁধে দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এইভাবে তৃণভূমি বাঁচানোর জন্য নিজ সম্প্রদায়ের পশুপালকে নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে দুর্গা, পশুলোম ও অন্যান্য পশুজাত দ্রব্য সংগ্রহ কাজকে তারা বহমান রাখতে পেরেছিলেন। পরিবেশ সম্পর্কে এই উপলব্ধি তাদের পরিবেশ সংরক্ষণের জ্ঞান ও চিন্তাভাবনার পরিচয় দেয়।


খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের আগে মেসোপোটেমিয়ায় সামারিয়ান সভ্যতায় এক চমৎকার জলসেচ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল যা কৃষি ফসল উৎপাদনে তখন উল্লেখযোগ্য সাফল্য এনেছিল। এটি পরিবেশ সম্পর্কে মেসোপোটেমিয়ার মানুষদের উপলব্ধির সুন্দর পরিচয় বহন করে।


মায়া সভ্যতা ষ্ট জন্মের শতক বছর আগে থেকে ষ্টের পর কয়েক শতক বছর পর্যন্ত তার সুবর্ণ যুগে ছিল। উন্নততর জলসেচ প্রণালী বেষ্টনকারী কৃষিজমির উৎপাদিকা শক্তির ব্যবহার দ্বারা খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করে মায়া সভ্যতার মানুষজন তাদের পরিবেশ সংক্রান্ত উপলব্ধির পরিচয় দেন সেই যুগেই। তবে মায়া সভ্যতা আরো দীর্ঘস্থায়ী হতো যদি জমির উৎপাদিকা শক্তি কেন কমে আসছে সেই সমস্যাগুলি তারা উপলব্ধি করতে পারতেন। সামারিয়ান ও মায়া সভ্যতা পতনের কারণ ছিল সময় মত জমির উৎপাদিকা শক্তি কমে আসার কারণ নির্ধারণ না করতে পারাও। কিন্তু আইসল্যান্ডের অধিবাসীগণ প্রকৃতির বহন ক্ষমতা সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি করেছিলেন বলে তাদের পশম বাণিজ্যনির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেছেন যুগ যুগ ধরে।


মধ্যযুগে পরিবেশ উপলব্ধি ঃ

 মধ্যযুগে পরিবেশ উপলব্ধি কৌটিল্যকৃত অর্থশাস্ত্রে (১২ শতাব্দী পর্যন্ত প্রচলন ছিল) পরিবেশের সার্বজনীন রক্ষণাবেক্ষণ বা পরিবেশ সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। এই শাস্ত্র অনুযায়ী সমাজের প্রতিটি ব্যক্তির ধর্ম বা নৈতিক দায়িত্ব হলো প্রকৃতি তথা পরিবেশকে রক্ষা করা। তিনি অকারণে বৃক্ষছেদন, ডাল ভাঙ্গা বা বৃক্ষের অন্য কোনো ক্ষতি করার জন্য বিভিন্ন পরিমাপ এর জরিমানা নির্দেশ করেছিলেন। তিনি জলভাগকে রক্ষায় জলপ্রবাহে বাধা দেওয়া, প্রবাহপথ ঘুরিয়ে দেওয়া বা নদীপাড়ের ক্ষতিসাধন করলেও জরিমানার সংস্থান রেখেছিলেন। প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ মাধ্যমে ভবিষ্যতে এর সরবরাহ বজায় রাখার পরামর্শও তার অর্থ শাস্ত্রে নির্দেশ করেছিলেন। ঔষধি বৃক্ষ সৃজন ও তার রক্ষণাবেক্ষণের গুরুত্বের কথাও অর্থশাস্ত্রে উল্লেখিত ছিল।


মৌর্য যুগের কিছু কিছু বনাঞ্চল কে অভয়ারণ্য রূপে ঘোষণা করা হয়েছিল। এই সকল অরণ্যে বেআইনি স্বীকার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ ছিল।


সম্রাট অশোক তার শাসনকালে পরিবেশ সম্পর্কে যত্নবান ছিলেন। সড়ক নির্মাণ, সড়ক নির্মানকালে সড়কের ধারে ধারে বটবৃক্ষ সৃজন করার উদ্দেশ্য ছিল পথিকের বিশ্রামের জন্য ছায়া প্রদান। অশোকের বিভিন্ন স্থাপত্যে বিভিন্ন গাছপালার নিদর্শন রয়েছে।


মুঘল যুগে বাবরনামাতে বাবর ভারতের বন্য জন্তুর বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। বিভিন্ন ধরনের পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী, জলচর এর উল্লেখ যেমন আছে তেমনি, আছে গোলাপ, চাঁপা প্রভৃতি ফুলের বর্ণনা তার গ্রন্থে। জাহাঙ্গীরও একজন প্রকৃতি প্রেমিক ছিলেন। তিনি বিভিন্ন পশু, পাখি ও বৃক্ষ বিশেষত কাশ্মীরের প্রকৃতিতে মুগ্ধ হয়ে সেখানকার বৃক্ষ ও পুষ্পাদি চিত্রাংকন করিয়েছিলেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের দ্বারা।


সম্রাট আকবর সামাজিক বনসৃজন এবং জলাশয় সংরক্ষনে উৎসাহ দিতেন। তিনি পশু হত্যার বিরোধী ছিলেন। মুঘল যুগে বিভিন্ন সম্রাটের আমলে প্রজাদের জন্য প্রাকৃতিক বিশ্রামস্থল, বড় বড় ফুল বাগিচা গড়ে উঠেছিল যেগুলি কেবল নান্দনিক নয়, তার অর্থনৈতিক গুরুত্বও ছিল। সমসাময়িককালে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক আব্দুল কাদির বাদায়ুনি তিনটি পাপকার্যকে খুব খারাপ বলেছিলেন। এই তিনটি হলো ছায়া প্রদান করে এরূপ বৃক্ষ কেটে ফেলা, পশু হত্যাকে পেশা হিসেবে নেয়া এবং মানুষ বিক্রয় করা।

আধুনিক যুগে পরিবেশ উপলব্ধি :

 বিশ্বায়ন (Globalisation)-এর যুগে প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্রমশই সম্পদ আহরণের ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। অর্থনৈতিক কার্যকলাপ দেশে দেশে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সঙ্গে পৃথিবী জুড়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বৃদ্ধির গতি কোথাও চিন্তাজনকভাবে বেশি (উ (উন্নয়নশীল দেশগুলিতে) কোথাও কম (উন্নত দেশগুলোতে)। এই জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে, জীবনযাত্রার মানে উন্নয়ন ঘটাতে গিয়ে প্রাকৃতিক উপাদানের সাহায্যে সম্পদ সৃষ্টি করতে হয়। এই সম্পদ সৃষ্টি করতে গিয়ে পরিবেশের ওপর নির্দিষ্ট ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। তবে উপযুক্ত প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ব্যবস্থা নিলে পরিবেশে-এর ক্ষতি ন্যূনতম করা যায়। এরূপ উন্নয়নের পথকে বলে স্থিতিশীল উন্নয়ন বা সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট।


সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট বা স্থিতিশীল উন্নয়নের উপলব্ধি : 

রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিবেশ সংক্রান্ত ব্রান্টল্যান্ড রিপোর্ট (Brandtland Report)-এ বলা হয়েছে যে, অর্থনৈতিক উন্নতি ও পরিবেশের সুরক্ষা এক সঙ্গে চলতে পারে। কিন্তু পৃথিবী জুড়ে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ধরন পালটাতে হবে। যদি সমাজ মনে করে, গচ্ছিত সম্পদ পর্যাপ্ত পাওয়া যাবে, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছুই রাখা যাবে না।


মানুষের যে কোনো কার্যকলাপে সর্বপ্রথম হস্তক্ষেপ পড়ে পরিবেশে। প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রতিটি কার্যকলাপেই পরিবেশ কম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অরণ্য সংহার করে বসতিবিস্তার, অরণ্য ও তৃণভূমি পরিষ্কার করে কৃষিকাজের সম্প্রসারণ, খনিজ উত্তোলন করে ভূগর্ভের ক্ষতিসাধন ও ধসপ্রবণতা সৃষ্টি, শিল্প দ্রব্যের কাঁচামাল সংগ্রহ থেকে শুরু করে কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করণ পরিবেশে সম্পদের হ্রাস এবং পরিবেশে জল, বায়ু ও মৃত্তিকা দূষণের কারণ হয়।


১৯৯২ সালে রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত Earth Summit বা বসুন্ধরা সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী স্থিতিশীল উন্নয়ন বা সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট (Sustainable Development) ধারণাটির রূপায়ণই হল একমাত্র পথ পরিবেশের সুরক্ষা প্রদানে এবং একই সঙ্গে সম্পদ সংগ্রহে।


রাষ্ট্রপুরের রান্টল্যান্ড রিপোর্ট (Brandland Report) এ পরিবেশ বিষয়ে বলা হয়েছে যে অর্থনৈতিক উন্নতি ও পরিবেশের সংরক্ষণ একসঙ্গে চলতে পারে। কিন্তু পৃথিবী জুড়ে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ধরন পাল্টাতে হবে। যদি সমাজ মনে করে গচ্ছিত সম্পদ পর্যাপ্ত পাওয়া যাবে তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছুই রাখা যাবে না। এটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ এই কারণে যে পরিবেশ এমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে যে সম্পদের অভাবে এই পৃথিবী আর মানুষের বাসযোগ্যই থাকবে না। তাই প্রয়োজন প্রকৃতিকে রক্ষা করা এবং রক্ষা করার জন্য প্রকৃতির পরিচর্যা।


অতএব, প্রকৃতিকে কেবল সম্পদ আহরণের ক্ষেত্র বলেই বিবেচনা করলে চলবে না। প্রকৃতিকে পরিচর্যাও করতে হবে তার সংরক্ষণের জন্য । তবেই একদিকে যেমন প্রকৃতি রক্ষা পাবে, প্রাকৃতিক উপকরণের ভারসাম্য রক্ষিত হবে, তেমনি এই পৃথিবীর মানুষের বাসযোগ্য হয়েই থাকবে। লিন্ডা স্টার্ক তার 'Signs of Hope' বইয়ে মস্তবা করেছেন, ‘পরিবেশে অনেক আশার চিহ্ন রয়েছে ("There are many signs of hope on the environment side" - Linda Starke)। সম্পদ সংগ্রহকালে পরিবেশের যে ক্ষতি হয় অথবা প্রাকৃতিক নিয়মে পরিবেশের যে ক্ষতি হয় তা পরিপূরণের জন্য প্রকৃতির পরিচর্যা প্রয়োজন।


ওয়ার্ল্ড কমিশন অন এনভায়রনমেন্ট এন্ড ডেভেলমেন্ট (World Commission on Environment and Development) স্থিতিশীল উন্নয়ন বা সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্টের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তা হল : 'এটি হল সেই উন্নতি যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রয়োজনে ঘাটতি না ঘটিয়ে বর্তমান প্রজন্মের প্রয়োজন পূরণকরবে' (Development that meets the needs of the present generation without compromising the ebility of future generation to meet their own needs).


বিশ্বের সহস্রাধিক বিজ্ঞানী চার বৎসর ব্যাপী এক সমীক্ষায় দেখেছেন যে বর্তমান সহস্রাব্দে বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে যে ২৪ টি প্রাথমিক বাস্তুতান্ত্রিক পরিষেবা বা ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস পাওয়া যায় তার মধ্যে ১৫ টি চিন্তাজনক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেমন স্থলভাগের অরণ্য সম্পদ, খনিজ সম্পদ, জলভাগের মৎস্য সম্পদ তাদের যোগানের চেয়ে অধিক হারে ব্যবহৃত হচ্ছে যা এই সম্পদ গুলিকে ক্রম হ্রাস করছে।


পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ বনজ সম্পদের সংরক্ষণের গুরুত্ব ভালভাবে উপলব্ধি করতে না পারায় দীর্ঘকালব্যাপী এই সম্পদের অতিরিক্ত ব্যবহারে বনভূমিভাগ চিন্তাজনক ভাবে হ্রাস পেয়েছে। পশ্চিম ইউরোপের জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশ, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বহু স্থানে অরণ্য বিলুপ্তির পথে চলে গেছে। ব্রাজিলের আমাজন অরণ্য নিধনের কাজটি সাম্প্রতিককালে চিন্তাজনক ভাবে ত্বরান্বিত হয়েছে, কেবল মাত্র তাৎক্ষণিক লাভের আশায় ভবিষ্যতকে বাজি রেখে, যেখানে পরিবেশকে উপযুক্ত ভাবে উপলব্ধি করার অভাব লক্ষ্য করা গেছে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও।


বুফোঁ (১৯৫৬) তাঁর ন্যাচারাল হিস্ট্রি বইতে মানুষ, পশুপাখি ও উদ্ভিদের মধ্যে পরিবেশগত সম্পর্ক প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন।


১৮৬৯ সালে আর্নস্ট হেল্ প্রথম 'ইকোলজি' (ecology) শব্দটি ব্যবহার করেন (গ্রীক শব্দ OIKOS অর্থ 'বসবাসের স্থান থেকে ‘Eco' কথাটি এসেছে) পরিবেশগত চিন্তা ভাবনা নিয়েই।


'পরিবেশ' বর্তমানে 'সম্পদ' সংক্রান্ত চিন্তাভাবনায়ও স্থান পেয়েছে। সম্পদের সংজ্ঞা দিতে 'বস্তুর কার্যকারিতাকেই একমাত্র গুণ বলে ধরা হয় না। মনে রাখতে হয়, সম্পদ উৎপাদন প্রক্রিয়া যেন পরিবেশের ক্ষতি না করে।' ১৯৯২-এর রিও ডি জেনিরোতে পরিবেশ সংক্রান্ত শীর্ষ সম্মেলনে (Earth Summit, 1992) এই মত গৃহীত হয়েছে তা পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে।


মহাত্মা গান্ধী বলেছেন যে 'ধরিত্রী প্রত্যেকের প্রয়োজন পূরণের জন্য যথেষ্ট দিয়েছেন, কিন্তু কারো লোভ চরিতার্থ করার জন্য দেননি'। এই কথাটি বর্তমান মানুষের সম্পদ সংগ্রহের নেশা নিবারণে উপযুক্ত উপলব্ধি হিসেবে বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Middle post ad 01