বাস্তুতন্ত্রে শক্তিপ্রবাহ(Energy Flow in Ecosystem)
বাস্তুতন্ত্রে শক্তিপ্রবাহের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Energy Flow in Ecosystem)
পৃথিবীর উপর অবস্থানকারী সমগ্র উৎপাদক শ্রেণি সৌররশ্মি থেকে শক্তি সংগ্রহ করে। সেই সংগৃহীত সৌরশক্তি রূপান্তরিত হয়ে এক জীবদেহ থেকে অন্য জীবদেহে স্থানান্তরকে শক্তিপ্রবাহ (energy flow) বলে। এদের বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ:
পরিবেশ বিনষ্ট শক্তি
1. শক্তিপ্রবাহে শক্তির মূল উৎস হল সৌরশক্তি। বাস্তবে একমাত্র উৎপাদকেরা সৌরশক্তিকে গ্রহণ করে এবং তা থেকে ক্রমশ অন্যান্য জীবদেহে খাদ্য-খাদকের সম্পর্কের ভিত্তিতে ছড়িয়ে পড়ে।
2. প্রকৃতিতে কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, ফসফরাস ইত্যাদি মৌলের যেভাবে চক কারে আবর্তন সংঘটিত হয় শক্তির সেই রকম আবর্তন হয় না।
3. শক্তিপ্রবাহ একমুখী (unidirectional) অর্থাৎ উৎপাদক দ্বারা আবদ্ধ সৌরশক্তি বিভিন্ন খাদক স্তরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় কিন্তু কখনোই উল্টো অভিমুখে উৎপাদকের দিকে প্রবাহিত হয় না।
4. শক্তিপ্রবাহ পর্যায়ক্রমে পুষ্টিস্তর বরাবর হ্রাস পায়। অর্থাৎ উৎপাদক যত শক্তি আহরণ করে তার সবটাই প্রাথমিক স্তরে যায় না। শক্তির কিছু অংশ অব্যবহৃত থাকে, কিছু ব্যয়িত হয় ও কিছু বিয়োজিত হয়ে যায়।
5. বাস্তুতন্ত্রে শক্তিপ্রবাহ তাপগতিবিদ্যার (thermodynamics) প্রথম ও দ্বিতীয় সূত্র মেনে চলে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ধরা যায় যে, (i) শক্তির সৃষ্টি বা বিনাশ নেই, কেবল এক শক্তি অন্য শক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে (প্রথম সূত্র) এবং (ii) এক প্রকার শক্তি যখন অন্য শক্তিতে রূপান্তরিত হয় তখন কিছু শক্তির অপচয় ঘটে (দ্বিতীয় সূত্র)।
শক্তিই বাস্তুতন্ত্র সচল রাখার মূল চাবিকাঠি। শক্তির মূল উৎস হল সৌরশক্তি (solar energy)। বাস্তুতন্ত্রে এই সৌরশক্তি উৎপাদক দ্বারা আবদ্ধ হয় এবং তারপর বিভিন্ন পুষ্টিস্তরে অবস্থিত পরভোজীদের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়। রূপান্তরিত সৌরশক্তির এক জীবদেহ থেকে অন্য জীবদেহে স্থানান্তরকে শক্তিপ্রবাহ (energy flow) বলে।
শক্তিপ্রবাহের পর্যায় (Stage of Energy Flow): বাস্তুতন্ত্রে শক্তিপ্রবাহ তিনটি পর্যায়ে ঘটে। যথা-
1. শক্তি অর্জন (Energy Capture): পৃথিবীতে আগত সৌরশক্তির মাত্র 0.02 ভাগ উদ্ভিদের ক্লোরোফিল দ্বারা শোষিত হয় এবং শর্করা খাদ্যে আবদ্ধ হয়। এই আবদ্ধ শক্তির কিছুটা উদ্ভিদের নিজস্ব শারীরবৃত্তীয় কার্যের জন্য শ্বসনের মাধ্যমে তাপশক্তি হিসাবে মুক্ত হয়। তবে এক্ষেত্রে শক্তির মোট উৎপাদন এবং প্রকৃত উৎপাদন এক নয়।
∎ মোট উৎপাদন (Gross Production): সালোকসংশ্লেষ দ্বারা যে পরিমাণ শক্তি কোনো বাস্তুতন্ত্রে আবদ্ধ হয় তাকে মোট উৎপাদন (GP) বলে।
∎ প্রকৃত উৎপাদন (Net Production): শ্বসনে ব্যবহৃত (R) হবার পর যে পরিমাণ শক্তি উদ্ভিদদেহে অবশিষ্ট খায়ে তাকে প্রকৃত উৎপাদন (NP) বলে।
অর্থাৎ
GPR NP
GP = মোট উৎপাদন
R = শ্বসনে ব্যবহৃত শক্তি
NP = প্রকৃত উৎপাদন
2. শস্তির ব্যবহার (Energy Use): প্রকৃত উৎপাদনের অংশবিশেষ প্রাথমিক খাদক দ্বারা গৃহীত হয়। প্রাথমিক খাদকের অর্জিত শক্তির অংশবিশেষ তাদের নিজস্ব জৈবিক কাজে ব্যবহার করে এবং বাকি শক্তি সঞ্চিত করে। এভাবে প্রতিটি পুষ্টিস্তরে শক্তির ব্যবহার ও সঞ্চয় হয়। এই শক্তিকে প্রকৃত অর্জিত শক্তি (Net Energy Intake) বলে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বাস্তুরীতিতে পর্যায়ক্রমিক পুষ্টিস্তরে শক্তির স্থানান্তরণ কখনও সম্পূর্ণভাবে অর্থাৎ শতকরা 100 ভাগ ঘটে না। জীব যে পরিমাণ শক্তি গ্রহণ করে তার বেশিরভাগ দেহের তাপ উৎপাদন এবং নানান শারীরবৃত্তীয় কাজে ব্যয়িত হয়। এইভাবে যে পরিমাণ শক্তি ব্যয়িত হয় তাকে শাসন শক্তি (respiratory energy) বলে।
3. শক্তির স্থানান্তর (Energy Transfer): কোনো খাদকের প্রকৃত অর্জিত শক্তির অংশবিশেষ পরবর্তী পুষ্টিস্তরে খাদক দ্বারা গৃহীত হয়। এভাবে বাস্তুতন্ত্রে একটি পুষ্টিস্তর থেকে পরবর্তী পুষ্টিস্তরে মাত্র 10 শতাংশ শক্তি স্থানান্তরিত হয়, বাকি 90 শতাংশ শক্তির অপচয় হয়, একে লিন্ডেম্যানের 10 শতাংশ সূত্র (10% Law) বলে। কোনো বাস্তুরীতিতে উৎপাদক থেকে প্রথম শ্রেণির খাদকে শরি স্থানান্তরিত হয়। একইভাবে প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় এবং দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণির খাদকেও শক্তির স্থানান্তর ঘটে। শক্তির এই স্থানান্তর যেকোনো খাদ্য শৃংখলের পরিলক্ষিত হয়।