খনিজ শনাক্তকরণের পদ্ধতি (method of mineral identification)
যেভাবে কোনো মানুষকে তার গায়ের রং, গড়ন, উচ্চতা, মুখাকৃতি প্রভৃতি বাহ্যিক গুণাবলীর সাহায্যে চেনা যায়, ঠিক সেভাবেই সাধারণত বাহ্যিক ও ভৌত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে একটি নিজ থেকে অপর একটি খনিজকে পৃথক করা যায়। বাহ্যিক, ভৌত এবং আপাত বৈশিষ্ট্য যথা- রং (colour), চকচকে ভাব (lustre), গঠন (structure), কাঠিন্য (hardness), সন্ধেদ (cleavage), ফাটল (fracture), কেলাসের আকৃতি (crystal shape), আপেক্ষিক গুরুত্ব (specific gravity) প্রভৃতির সাহায্যে যেকোনো খনিজ চিহ্নিত করা যায়। এছাড়া চৌম্বক বৈশিষ্টা (magnetism), বিদ্যুৎ-পরিবাহিতা ( condutivity), স্বাদ (taste), আকৃতি (form) প্রভৃতি গুণাবলির সাহায্যে নেওয়া হয়। নীচে খনিজের এসব গুণাবলি সম্পর্কে আলোচনা করা হল-
electrical③
রং (colour): কিছু কিছু খনিজ পদার্থ বৈশিষ্ট্যযুক্ত রং-এর জন্য বিখ্যাত এবং এই রং-এর সাহায্যে তাদের সহজে চেনা যায়। আবার কিছু খনিজ বিশুদ্ধ অবস্থায় যে রং ধারণ করে, অবিশুদ্ধ হলে সেই রং-এর পরিবর্তন হয়। যেমন-ক্লোরাইট খনিজের রং সবুজ, কোয়ার্টজ বিশুদ্ধ অবস্থায় রং বিহীন, কিন্তু অনিশূন্য অবস্থায় কখনো এটি ধূসর, কখনো গোলাপি, আবার কখনো হলুদাভ।
স্ট্রিক প্লেটে ডোরা চিহ্নের রং বা কম (streak colour): খনিজের গুঁড়োর রং খনিজগুলি সম্পর্কে নির্ভুল তথ্য দেয়। সাধারণত শক্ত পোর্সেলিনের অমসৃণ প্লেটের ওপর কোনো খনিজকে সজোরে ঘষলে ওই খনিজের গুঁড়ো অংশগুলি বিচ্ছিন্ন হয়ে পোর্সেলিনের প্লেটের ওপর ডোরা চিহ্নের আকারে লেগে যায় এবং এই রং দেখে খনিজটিকে সহজে চেনা যায়। যেমন- লোহার বিভিন্ন অক্সাইডকে স্ট্রিক রং দেখে নিম্নরূপে চিহ্নিত করা যায়।
খনিজ
স্ট্রিক দাগের রং হেমাটাইট (Fe,O₂)
ম্যাগনেটাইট (Fe,O₂) কালচে ধূসর
লিমোনাইট (hydrated)Fe,O বাদামি
দ্যুতি বা লাস্টার বা প্রতিফলিত আলোকে চকচকে প্রভা (lustre): আলোক প্রতিফলিত হলে কোনো খনিজ কেমন দেখতে হয় তাকে তার প্রভা (lustre) বলে। এটি কখনো ধাতব (metallic) যেমন- গ্যালেনা বা পাইরাইটের ক্ষেত্রে; কখনো কাচের মতো (glassy/vitreous) যেমন- কোয়ার্টজের ক্ষেত্রে কখনো রেজিন বা গ্রিজের মতো (resinous/greasy) যেমন, ওপালের ক্ষেত্রে; কখনো মুক্তোর মতো (pearly) যেমন, ট্যাঙ্ক-এর ক্ষেত্রে: আবার কখনো সিল্কের মতো (silky) যেমন, অ্যাজবেসটসের ক্ষেত্রে। যেসব খনিজের কোনো চক্চকে প্রভা নেই তাদের প্রভাহীন (dull) বলে।
কেলাস গঠন (crystal form/structure): যখন কোনো খনিজ গলিত বা দ্রবীভূত অবস্থা থেকে অথবা গ্যাসীয় অবস্থা থেকে সরাসরি কঠিন অবস্থায় স্বাধীনভাবে রূপান্তরের সময় একটি নির্দিষ্ট কেলাস আকৃতি গঠন করে।
একটি নির্দিষ্ট খনিজের একইরকম কেলাসগুলি ক্ষেত্রে দুটি পরস্পর সন্নিহিত কেলাস তলের মধ্যেকার কোণটি (angle) সবসময় সমান থাকে। সুতরাং খনিজের অভ্যন্তরীণ পারমাণবিক গঠনের (atomic structure) সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে খনিজতলগুলি পরস্পরের সাথে যেরকম জ্যামিতিক আকৃতির বন্ধন তৈরি করে তাকে কেলাস গঠন (cristalline structure) বলে। নীচে (Fig. 9.2 দেখো) খনিজের বিভিন্নরকম কেলাস গঠন, তাদের অক্ষগুলির পারস্পরিক অবস্থান (arrangement of major axis) এবং সংশ্লিষ্ট খনিজের উদাহরণ দেওয়া হল।
আপেক্ষিক গুরুত্ব (specific gravity): কোনো খনিজের আপেক্ষিক গুরুত্ব পরিমাপের জন্য ওয়াকার ব্যালান্স ব্যবহার করা হয়। নিচের সূত্রের সাহায্যে এর পরিমাপ করা হয়।
ক্রিভেজ প্লেন বা সদ্ভেদ তল (cleavage plane): কোনো কোনো খনিজের একটি নির্দিষ্ট দিকে ভাঙার প্রবণতা থাকে এবং ভাঙার পরে একটি নির্দিষ্ট মসৃণ তলের সৃষ্টি করে, একে সম্ভেদ তল বলে। এই ধরনের সদ্ভেদ তল খনিজটির পারমাণবিক গঠন এবং কেলাস গঠনের ওপর নির্ভর করে। এই প্রবণতার ওপর ভিত্তি করে খনিজকে সুস্পষ্ট, ভাল, নির্দিষ্ট এবং অনির্দিষ্ট সদ্ভেদ তলের অধিকারীরূপে চিহ্নিত করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, অভ্র খনিজটি সুস্পষ্ট সঙেদ তলে ভাঙে, আবার ফেল্সপার খনিজটি পরস্পর সমকোণে অবস্থিত দুটি নির্দিষ্ট সন্তেদ তলে ভাঙে। ক্যালাসাইট খনিজটি তিনটি নির্দিষ্ট সঙেদ তলে ভাঙে।
W specific gravity=W1-W2
(W₁= বায়ুমন্ডলে কোনো খনিজের ওজন)
(W.= জলের মধ্যে কোনো খনিজের ওজন)
মৃত্তিকা বা বালির মিশ্রণ থেকে কোনো খনিজের পৃথকীকরণের জন্য একটি বিশেষ তরল নেওয়া হয় যার আপেক্ষিক গুরুত্ব সংশ্লিষ্ট খনিজের আপেক্ষিক গুরুত্বের সমান। এবার যেসব খনিজ তরলটি থেকে ভারি, তারা ডুববে এবং হাল্কা খনিজগুলি ভাসতে থাকবে। এভাবে দূধরনের খনিজের পৃথকীকরণ সম্ভব। আবার যেসব খনিজের চৌম্বকধর্ম আছে তাদের তড়িৎ-চুম্বকের সাহায্যে পৃথক করা হয়।
পৃথিবীতে প্রাপ্ত খনিজগুলির আপেক্ষিক গুরুত্ব 1 থেকে 21 পর্যন্ত হলেও (প্লাটিনাম 21.46) বেশিরভাব খনিজের আপেক্ষিক গুরুত্ব 1.5 থেকে 10-এর মধ্যে থাকে।
কাঠিন্য (hardness): কোনো খনিজ তার ক্ষয়কে কতটা প্রতিরোধ করতে পারে সেই শক্তিই হল তার কাঠিন্য। খনিজের ক্ষয় প্রতিরোধ ক্ষমতাকেই কাঠিন্য বলে। এই কাঠিন্য 10টি প্রমাণ মানের কাঠিন্য সূচক (standard hardness scale), খনিজের সাপেক্ষে করা হয়। এই সূচক স্কেলটিকে মোহ কাঠিন্য সূচক (Mohs' hardness scale) বলে।
ক্রিভেজ প্লেন বা সদ্ভেদ তল (cleavage plane): কোনো কোনো খনিজের একটি নির্দিষ্ট দিকে ভাঙার প্রবণতা থাকে এবং ভাঙার পরে একটি নির্দিষ্ট মসৃণ তলের সৃষ্টি করে, একে সম্ভেদ তল বলে। এই ধরনের সদ্ভেদ তল খনিজটির পারমাণবিক গঠন এবং কেলাস গঠনের ওপর নির্ভর করে। এই প্রবণতার ওপর ভিত্তি করে খনিজকে সুস্পষ্ট, ভাল, নির্দিষ্ট এবং অনির্দিষ্ট সদ্ভেদ তলের অধিকারীরূপে চিহ্নিত করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, অভ্র খনিজটি সুস্পষ্ট সঙেদ তলে ভাঙে, আবার ফেল্সপার খনিজটি পরস্পর সমকোণে অবস্থিত দুটি নির্দিষ্ট সন্তেদ তলে ভাঙে। ক্যালাসাইট খনিজটি তিনটি নির্দিষ্ট সঙেদ তলে ভাঙে।
ফাটল (fracture): সম্ভেদ তল ছাড়া খনিজগুলি স্বাভাবিকভাবে ভাঙলে যে তলের সৃষ্টি হয় তাকে ফাটল (fracture) বলে। এই ফাটলগুলিকে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয় (Fig. 9.2 দেখো)।