জিয়ড (geoid)
জিয়ড-এর ধারণা (concept of geoid)
কৃত্রিম উপগ্রহ প্রেরিত দূরসংবেদন চিত্র (remote sensing image) ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন-
① পৃথিবীর শুধুমাত্র দক্ষিণ মেরু সামান্য চাপা।
② দক্ষিণ মেরু 20 মিটার অতি নীচু এবং উত্তর মেরু 20 মিটার অতি উঁচু।
③ দক্ষিণ গোলার্ধের মধ্য অক্ষাংশ ৪ মিটার ফুলে উঠেছে; আর উত্তর গোলার্ধের মধ্য অক্ষাংশ ৪ মিটার বসে গিয়েছে।
④ পৃথিবীপৃষ্ঠের রূপ ও পদার্থের ঘনত্ব সর্বত্র সমান না হওযায় অভিকর্ষজ বলের পার্থক্য হয়। উত্তর গোলার্ধে স্থলভাগ বেশি ও দক্ষিণ গোলার্ধে জলভাগ বেশি। অর্থাৎ উত্তর গোলার্ধ দক্ষিণ গোলার্ধের তুলনায় পদার্থের পরিমাণ বেশি। অন্যদিকে পদার্থের ঘনত্বের তারতম্যে অভিকর্ষজ বলের তারতম্য ঘটে। এজন্য সব জায়গায় সমান অভিকর্ষজ বল অনুযায়ী যদি একটি রেখা কল্পনা করা যায় তখন জিয়ড পৃষ্ঠ দেখতে অনিয়মিত হয়।
⑤ পৃথিবীর আকৃতি অনেকটা কমলালেবু বা ন্যাস্পাতির মতো। পৃথিবীর এই বিশিষ্ট আকৃতিটি আমাদের পরিচিত কোনো বস্তুর সঙ্গেঙ্গ সঠিকভাবে তুলনীয় নয়, তাই বলা যায় যে, পৃথিবীর প্রকৃত আকৃতি পৃথিবীরই মতো (the earth is earth shaped) যাকে ইংরেজিতে বলা হয় "জিয়ড' (GEOID = Earth Shaped)। পৃথিবী পুরোপুরি গোলাকার নয়। পৃথিবীর মধ্যভাগ খানিকটা স্ফীত প্রায় 43 কিমি।
জিয়ড' শব্দের অর্থ(meaning of the word 'geoid')
বিজ্ঞানী জোহান বেনডিক্ট লিসটিং প্রথম 'Geoid' শব্দটি ব্যবহার করেন। গ্রিক শব্দ 'Geoeides' থেকে 'Geoid' শব্দটি এসেছে, যার অর্থ হল 'পৃথিবী সদৃশ্য'। অর্থাৎ গ্রিক শব্দ 'geo' ও 'eidos' মিলে 'Geoid' শব্দের উৎপত্তি। 'geo' এর অর্থ 'পৃথিবী' এবং 'eidos'-এর অর্থ 'দর্শন' বা 'দেখতে'। অর্থাৎ 'Geoid' শব্দের অর্থ 'পৃথিবীর মতো দেখতে' বা 'পৃথিবীর সদৃশা' (earth shaped)। পৃথিবীর প্রকৃত আকৃতি কোনো বস্তুর সঙ্গে তুলনা করা যায় না বলে বলা হয় পৃথিবীর আকৃতি 'পৃথিবীর সদৃশা' বা 'জিয়ড' (Geoid)।
জিয়ড সৃষ্টির কারণ
① পৃথিবী নিজের অক্ষের চারিদিকে অনেক দ্রুত ঘোরে বলে ওপর নীচ কিছুটা চাপা, আর মাঝ বরাবর কিছুটা স্ফীত। তাই পৃথিবীর পুরোপুরি গোলাকার নয়। কমলালেবু বা ন্যাসপাতির সঙ্গে পৃথিবীর আকৃতির কিছুটা মিল থাকলেও আসলে 'পৃথিবীর প্রকৃত আকৃতি পৃথিবীরই মতো ।মতো'। যাকে ইংরাজিতে বলা হয় 'জিয়ড' (GEOID = Earth Shaped)।
② পৃথিবীর ঘূর্ণন ছাড়াও বিভিন্ন প্রকার ভূ-গাঠনিক প্রক্রিয়া পৃথিবীর ওপর ক্রিয়াশীল হওয়ায় এর পৃষ্ঠদেশ অনিয়মিতভাবে বিস্তৃত হয়েছে। পৃথিবীর গড় অবস্থা বা আকৃতি বোঝাতে 'জিয়ড' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
জিয়ড-এর ব্যাখ্যা (interpretation of geoid)
প্রকৃত জিয়ডের ধারণাটি সামান্য জটিল। খুব সহজভাবে বললে সমুদ্রের গড় পৃষ্ঠতল (MSL) অনুযায়ী কল্পিত পৃথিবীর আকৃতিকে 'জিয়ড' (geoid) বলে। এই আকৃতির উপরিভাগ জিয়ড পৃষ্ঠ (geoid surface) নামে পরিচিত। জিয়ড পৃষ্ঠের প্রত্যেক বিন্দু অভিকর্ষজ (gravity) বলের দিকের সঙ্গেঙ্গ লম্বভাবে অবস্থান করায় অভিকর্ষজ বলের দিক খুব সহজেই নির্ণয় করা যায়। একটি সুতোর নীচে কিছুটা ভারী বস্তু বেঁধে ঝুলিয়ে দিলে টান অবস্থায় সুতোটি যে দিক (direction) নির্দেশ করে তাই হল অভিকর্ষজ বলের দিক। যা প্লাম্বরেখা (plumb line) নামে পরিচিত। অপরদিকে পৃথিবীর কেন্দ্র ও ভূ-পৃষ্ঠের ওপর সংযোগকারী রেখার বর্ধিত অংশ উল্লম্বরেখা (vertical line) নামে পরিচিত। প্রকৃতপক্ষে প্লাম্বরেখা ও উল্লম্বরেখা এক অবস্থানে থাকে না। প্লাম্বরেখা উল্লম্বরেখা থেকে সামান্য বিচ্যুত হয়। যেমন-
① সমুদ্রের কাছাকাছি স্থানে 'অভিকর্ষজ বলের দিক উল্লম্বরেখা থেকে সমুদ্রের দিকে কিছুটা হেলে থাকে। ফলে জিয়ডপৃষ্ঠে সামান্য নেমে যায়।
② পর্বতের কাছাকাছি অঞ্চলে অভিকর্ষজ বলের দিক উল্লম্বরেখা থেকে পর্বতের দিকে কিছুটা হেলে থাকে। ফলে জিয়ডপৃষ্ঠ সামান্য ওঠে যায়। অর্থাৎ জিওডের উপরিভাগ অমসৃণ। এর কারণ সম্ভবত পৃথিবীপৃষ্ঠের প্রতিটি বিন্দুর ভর (mass) বিভিন্ন। সেই কারণে প্রতিটি বিন্দুর অভিকর্ষের দিকের সঙ্গে লম্বভাবে অবস্থান করে। ফলে বিন্দুগুলি অসমানভাবে অবস্থান করে এবং এক অমসৃণ পৃথিবীপৃষ্ঠ তৈরি করে। সাধারণভাবে বলা যায় সমুদ্রতলের ওপর GEOID ও MSL পরস্পরের সঙ্গেঙ্গ সামঞ্জস্যভাবে থাকে এবং তা পৃথিবীর বেশিরভাগ স্থান জুড়ে রয়েছে। মহাদেশগুলির ওপর দিয়ে খাল কেটে মহাসাগরগুলি যুক্ত করলে সারা পৃথিবীব্যাপী একটি গড় সমুদ্রতল বা পৃষ্ঠদেশ বিশিষ্ট পৃথিবীর অবয়ব পাওয়া যায়। এইরূপ গোলাকার সম অভিকর্ষজ পৃষ্ঠদেশ বিশিষ্ট পৃথিবী 'জিয়ড' নামে পরিচিত। অর্থাৎ সমুদ্রের গড় পৃষ্ঠতল অনুযায়ী কল্পিত পৃথিবীর আকৃতিকে জিয়ড (geiod) বলে।
জিয়ড-এর বৈশিষ্ট্য (characteristics of geoid)
(1)জিয়য়েড প্রতিটি বিন্দুতে অভিকর্ষজ টানের অভিমুখের সাথে স্পর্শকগুলি সমকোণে অবস্থান করে।
(2)জিয়ডের পৃষ্ঠদেশ সম অভিকর্ষজ তল হিসাবে অবস্থান করে।
(3জিয়য়েড হল একটি কাল্পনিক তল যার সব জায়গায় অভিকর্ষজ বল বা মাধ্যাকর্ষণ বল সমান হয়, তাই পৃথিবীর এই কাল্পনিক তলটি বাস্তবে অনিয়মিত হয় ।
পৃথিবীকে 'জিয়ড' বলার কারণ বা প্রমাণ
পৃথিবীতে 'জিয়ড' (geoid) বা পৃথিবীর আকৃতি পৃথিবীর মতো বলা হয়। এরূপ বলার কারণ হল-
① পৃথিবীপৃষ্ঠে সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টের উচ্চতা ৪,848 মিটার এবং প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত পৃথিবীর গভীরতম সমূদ্রখাত মারিয়ানার চ্যালেঞ্জার ডিপের গভীরতা 10,915 মিটার। সুতরাং পৃথিবীপৃষ্ঠের বশুরতার বিস্তার প্রায় 20,000 মিটার (8,848 মিটার 10,915 মিটার= 19,763 মিটার) বা 20 কিমি।
② পৃথিবীর আকৃতি অভিগত গোলক হলেও দক্ষিণ মেরু প্রায় 20 মিটার নীচু এবং পৃথিবীর উত্তর মেরু প্রায় 20 মিটার
③ উত্তর গোলার্ধের মধ্যভাগ প্রায় ৪ মিটার নীচু এবং দক্ষিণ গোলার্ধের মধ্যভাগ প্রায় ৪ মিটার উঁচু।
সুতরাং পৃথিবীর প্রকৃত আকৃতি হল উঁচুনীচু পৃষ্ঠযুক্ত এক অভিগত গোলক। পৃথিবীর এই বিশেষ ধরনের আকৃতির সঙ্গে মহাবিশ্বের অন্য কোনো বস্তুর আকৃতির মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এই কারণেই বলা হয় পৃথিবীর আকৃতি পৃথিবীর মতো বা জিয়ড (geoid)।