প্রচলিত অর্থনৈতিক ভূগোল Proper Economic Geography বা conventional Economic Geography (PEG) ও নব অর্থনৈতিক ভূগোস New Economic Geography (NEG)-এর মধ্যে পার্থক্য:
প্রচলিত অর্থনৈতিক ভূগোল (PEG) এবং নব অর্থনৈতিক ভূগোল (NEG)-এর মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গী ও বিশ্লেষণের পার্থক্যকে কয়েকটি সূচকের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা যায়।
(1) লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (Aims and Objectives):
প্রচলিত অর্থনৈতিক ভূগোলের (PEG) মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কাজকর্মের সমাবেশ ঘটেছে তার কারণ ব্যাখ্যা করা। যেমন- ভারতে চা বাগিচা, উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে মিশ্র কৃষিকাজ, জার্মানির রূঢ় অঞ্চলে ভারি শিল্পের বন্টন ইত্যাদির প্রত্যেকটির অবস্থান ও উন্নতির কারণ আলাদা আলাদা ভাবে বিশ্লেষণ করা।
পক্ষান্তরে
নব অর্থনৈতিক ভূগোলের (NEG) প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল এমন একটি তাত্ত্বিক গাণিতিক মজে তৈরি করা যার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক কাজকর্মের অবস্থান ও কারণ সম্পর্কে ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে এবং মডেলটি সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। ফলে প্রচলিত অর্থনৈতিক ভূগোলের মতো প্রতিটি অঞ্চলের অবস্থানের জন্য আলাদা ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। নব অর্থনৈতিক ভূগোলের প্রবক্তারা এই প্রস্তাবিত মডেল-এর নাম দিয়েছেন জেনেরাল ইকুইলিব্রিয়াম মডেল (Gener Equilibrium Model)। এই মডেলটিকে তাঁরা অর্থনৈতিক কাজকর্মের অবস্থান সংক্রান্ত ব্যাকরণ (universal grammar হিসাবে গড়ে তুলতে চাইছেন।
(2) তাত্ত্বিক গঠন (Theoretical framework):
প্রচলিত অর্থনৈতিক ভূগোলের (PEG) "দেশ" বিভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে (eclectic)। এছাড়া সমাজ ও অর্থনীতির বিভিন্ন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ থেকেও প্রচলিত অর্থনৈতি ভূগোল (PEG) সমৃদ্ধ হয়। যেমন- একদেশিকতার অর্থনীতি (Localisation economics), সামাজিক সংযোগের ত (Social network Theory), বিবর্তনমূলক অর্থনীতি (Evolutionary economics) ইত্যাদি।
পক্ষান্তরে
নব অর্থনৈতিক ভূগোলের (NEG) "দেশ" অর্থনীতির সূত্রকে মেনে চলে। "অর্থনৈতিক দেশে এই ব্যাখ্যা মূলত উৎপাদন অপেক্ষক (production function) ও উপযোগ অপেক্ষকের (utility function) ব্যাখা অপূর্ণাঙ্গ প্রতিযোগিতার (imperfect competition) ধরন, লাভের উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক কাজগুলি জোটবদ্ধ হয়েছে এময় ধারণা প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
(3) অর্থনৈতিক "দেশ" বা ইকনমিক স্পেস-এর ধরন (Form of economic space):
প্রচলিত অর্থনৈতিক ভূগোলে (PEG) অর্থনৈতিক "দেশ" বা ইকনমিক স্পেস একাধিক বলে মনে করা হয়। যেমন- শিল্পের অবস্থান ব্যাখা করার জন্য ধরে নেওয়া হয় যে কাঁচামাল, বাজার ও শ্রমিকের আলাদা প্রভাব ক্ষেত্র আছে। এই "দেশ" বা "স্পেস"গুলিকে তার অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনুসারে কতকগুলি মান ও নম্বর দেওয়া যায়। ফলে PEG-এর প্রত্যেকটি ইকনমিক স্পেস হল "স্ক্যালার ক্ষেত্র" (520 (scalar field)। প্রসঙ্গত "স্ক্যালার ক্ষেত্র" মানে স্থির মানের ভিত্তিতে গঠিত কোনো কাল্পনিক ক্ষেত্র। আলোচ্য "দেশ" বা ক্ষেত্রগুলির ঐতিহাসিক ও সামাজিক বিবর্তন আছে।
পক্ষান্তরে
NEG মনে করে যে অর্থনৈতিক দেশ হল চরম, পূর্ব-নির্দিষ্ট, আদর্শ এবং জ্যামিতিক চরিত্রে (absolute, pre-given, idealized and geometric)। কারণ এই অর্থনৈতিক দেশ বা ইকনমিক স্পেস হল জেনেরাল ইকুইলিব্রিয়াম মডেল অনুসারে গঠিত আদর্শ ক্ষেত্র।
(4) গবেষণা পদ্ধতি ও জ্ঞানের প্রকৃতি (Methodology and Epistemology):
PEG-এর প্রচলিত আলোচন পদ্ধতি অভিজ্ঞতা ও গবেষণা লব্ধ (empirical) এবং স্থানীয় ও আঞ্চলিক ঘটনার (case studies) ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই পদ্ধতি বাস্তব অবস্থাকে অনুসরণ করে (realist and pragmatic)।
পক্ষান্তর
NEG-এর গবেষণা পদ্ধতি গণিতিক মডেল নির্মাণকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। এর যুক্তি অবরোহী (deductive), স্বতঃসিদ্ধ (axiomatic), বিমূর্ত (abstract) ও তাত্ত্বিক প্রকৃতির। এখানে বাস্তব অবস্থার বিশ্লেষণের তুলনায় সংখ্যাভিত্তিক "সিমিউলেশন" (numerical simulations) প্রাধান্য পায়। প্রসঙ্গত ইংরেজি "সিমিউলেশন" কথাটির অর্থ
হল বাস্তবে যা ঘটে তার নকল। বিভিন্ন ধরনের প্রস্তুতির জন্য "সিমিউলেশন” অভ্যাস করা হয়, যেমন খুব সাধারণ ভাবে বলা যায় যে- বহুতল বাড়িতে আগুন লাগলে মানুষকে কীভাবে উদ্ধার করা হবে, দমকলের লোকজন তা অভ্যাস করে। কাল্পনিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই অভ্যাস হল সিমিউলেশন।
(5) সমাজ, ইতিহাস ও প্রতিষ্ঠানের প্রভাব (Influence of Society, History and Institution) :
প্রথাগত PEG-এর আলোচনায় সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যেমন- হুগলি শিল্পাঞ্চলে পাটশিল্পের অবস্থান ও উন্নতিতে বিহার, ঝাড়খন্ড ও ওড়িশা থেকে আসা শ্রমিকদের বিশেষ ভূমিকা আছে। এই ভূমিকার প্রভাব NEG-র আলোচনায় গুরুত্বহীন।