কোনো ফলাফল পাওয়া যায়নি

    অর্থনৈতিক ভূগোলের অনুশীলন পদ্ধতি (Approaches of Economic Geography)

     অর্থনৈতিক ভূগোলের  অনুশীলন পদ্ধতি (Approaches of Economic Geography)



    অর্থনৈতিক ভূগোল ও সম্পদশাস্ত্র অনুশীলনের কতকগুলি পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত পদ্ধতি আছে, যেমন


    (1) বর্ণনামূলক পদ্ধতি (Descriptive Approach)

    এই পদ্ধতিকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-

     (i) বিষয়ানুগ পদ্ধতি (Topical approach):

     এই পদ্ধতিতে আলোচনা বা ব্যাখ্যার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয়কে বেছে নেওয়া হয়। যেমন, কোনো দেশ বা অঞ্চলের কৃষিকাজ, শিল্প উৎপাদন, জনসংখ্যা ইত্যাদি।

    এতে সুবিধা হল যে, ওই নির্দিষ্ট বিষয় সম্বন্ধে একটা সামগ্রিক ধারণা পাওয়া যায়। ফলে আলোচ্য বিষয়টির সুবিধা-অসুবিধা, গুরুত্ব ইত্যাদি সব দিক বিচার করা সম্ভব হয়।


    (ii) আঞ্চলিক পদ্ধতি (Regional approach): 

    এই পদ্ধতিতে আলোচনা বা ব্যাখ্যার জন্য পৃথিবীকে কতকগুলি বড়ো (macro) অঞ্চলে, বড়ো অঞ্চলগুলিকে কতকগুলি মাঝারি (meso) অঞ্চলে এবং মাঝারি অঞ্চলগুলিকে আরও ছোটো ছোটো (micro) অঞ্চলে ভাগ করা হয়। আঞ্চলিক পদ্ধতি অনুসারে আঞ্চলিক বিভাজনের একটি সুনির্দিষ্ট ভিত্তি থাকা দরকার। যেমন- জলবায়ুর ভিত্তিতে, মাটির বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে, উদ্ভিজ্জের ভিত্তিতে, কৃষিকাজের ভিত্তিতে, অর্থনৈতিক উন্নতির ভিত্তিতে ইত্যাদি নানা সূচকের ভিত্তিতে অঞ্চলকে চিহ্নিত করা যায়।


    (iii) পণ্যভিত্তিক পদ্ধতি (Commodity approach):

     আলোচ্য পদ্ধতি অনুসারে কোনো প্রকৃতিদত্ত পণ্য, যেমন- কয়লা, খনিজতেল অথবা মানুষের তৈরি পণ্য যথা- ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম, পারমাণবিক শক্তি প্রভৃতির আঞ্চলিক বণ্টন, বাণিজ্য, সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।


    (iv) কার্যকলাপভিত্তিক পদ্ধতি (Activity approach):

     অর্থনৈতিক কার্যকলাপের বিভিন্ন স্তর, যেমন প্রথম স্তরে কৃষি, দ্বিতীয় স্তরে শিল্প, তৃতীয় স্তরে সেবাক্ষেত্র, চতুর্থস্তরে বিনোদন-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-তথ্যপ্রযুক্তি, পঞ্চম স্তরে প্রশাসন-গবেষণা প্রভৃতির ভিত্তিতে সম্পদের বণ্টন, উৎপাদন, বাণিজ্য, সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়।


    (v) নীতি বা কারণভিত্তিক পদ্ধতি (Principles approach): 

    এই পদ্ধতি সাধারণীকরণ (generalization)-এর নিয়ম, নীতি বা কারণের উপর প্রতিষ্ঠিত। আলোচ্য দৃষ্টিভঙ্গীতে অর্থনৈতিক কাজকর্মের ভিত্তি হিসাবে মানুষ ও পরিবেশ সম্পর্কে কতকগুলি সাধারণ ধারণা তৈরি করা হয়, যেমন- সমতলভূমি অর্থনৈতিক কাজের জন্য পার্বত্য এলাকার তুলনায় বেশি উপযোগী। এই বক্তব্যটি সহজবোধ্য কিন্তু পৃথিবীর সব অঞ্চলের জন্য সমান সত্য নয়। যদি সত্য হত, তাহলে জাপান বা সুইজারল্যান্ড পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত হওয়া সত্বেও উন্নত দেশ হিসাবে গড়ে উঠতে পারতো না।


    (2) বিশ্লেষণধর্মী গঠনমূলক পদ্ধতি (Analytical Structural Approach)


    বিশ্লেষণ গঠনমূলক পদ্ধতিতে অনুশীলনের চারটি মূল ধারা আছে। যেমন- (i) নিয়ন্ত্রণবাদী পদ্ধতি (Deterministic approach), (ii) সম্ভাবনাবাদী পদ্ধতি (Possibilistic approach), (iii) কার্যকারিতা ও পরিবেশভিত্তিক পদ্ধতি (Functional and Environmental approach), এবং (iv) কল্যাণ ও উন্নয়নভিত্তিক পদ্ধতি (Welfare and Developmental approach) 

    (i) নিয়ন্ত্রণবাদী পদ্ধতি (Deterministic approach): 

    এই পদ্ধতিতে মানুষের সমস্ত কাজ প্রকৃতি ও পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ, প্রকৃতি হল সর্বময় সক্রিয় শক্তি, আর মানুষ এই শক্তির কাছে নিষ্ক্রিয় বা বশ্যতা স্বীকার করে আছে বলে নিয়ন্ত্রণবাদী ভৌগোলিকেরা মনে করেন। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিচার করলে দেখা যায় যে, নিয়ন্ত্রণবাদের জন্ম হয়েছে খ্রিস্টের জন্মের অনেক আগে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে গ্রিক দার্শনিক হেরোডোটাসের রচনায় নিয়ন্ত্রণবাদের স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। 

    হিপোক্রেটস (খ্রিস্টপূর্ব 460 অব্দ) নিয়ন্ত্রণবাদের সপক্ষে বলেছেন যে, এশিয়ার লোকজন অনেক সহজ জীবনযাপনে অভ্যস্ত, কারণ এখানকার জলবায়ু ইউরোপের তুলনায় অনেক বেশি অনুকূল। অ্যারিস্টটল-এর (খ্রিস্টপূর্ব 384-322 অব্দ) ধারণা ছিল যে, জলবায়ু মানুষের কর্মদক্ষতা ও জনবসতির বণ্টনকে নিয়ন্ত্রণ করে। 

    তিনি তাঁর 'পলিটিক্স' (Politics) নামক গ্রন্থে লিখেছেন যে, ইউরোপের লোকজন চিন্তাশীল নয়, কিন্তু সাহসী। কিন্তু এশিয়ার অধিবাসীরা দক্ষ ও চিন্তাশীল হলেও সাহসী নয়। তার অন্যতম কারণ হল জলবায়ু। আধুনিক কালে জার্মানিতে আলেকজান্ডার ফন হুমবোল্ট (1769-1859) ও কার্ল রিটার (1779-1859), ফ্রান্সে সমাজ বিজ্ঞানী ল'প্লে (1806-1882), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এলেন চার্চিল সেম্পেল-কে (1863-1932) নিয়ন্ত্রণবাদের অন্যতম প্রবক্তা বলা হয় । 

    (ii) সম্ভাবনাবাদী পদ্ধতি (Possibilistic approach): 

    এই পদ্ধতিতে প্রকৃতির দেওয়া সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে বা মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সুফলগুলিকে ব্যবহার করে, মানুষ তার নিজের ও সমাজের উন্নতির জন্য নানান সম্ভাবনা তৈরি করেছে বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ প্রকৃতি সবসময় একমাত্র শক্তি নয়। মানুষের অন্বেষা, মানুষের জানার ও জয় করার ইচ্ছা, যে কোনো বাধাকে অতিক্রম করার প্রবল মানবিক ক্ষমতা, মানুষকে এক গতিশীল শক্তিতে রূপান্তরিত করেছে।


    সম্ভাবনাবাদের প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় প্লেটোর দর্শনে। তাঁর মত হল এই যে, মানুষ তার সংস্কৃতির সাহায্যে প্রকৃতি ও পরিবেশের পরিবর্তন করতে পারে। ফরাসি দার্শনিক মন্তেস্থ্য বলেছেন যে, মানুষ তার সমাজ ও অর্থনীতির পরিবর্তনে সক্ষম। আর এই পরিবর্তন শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক কাঠামোরও পরিবর্তন ঘটাতে পারে। 

    সুতরাং, মানুষ যদি প্রকৃতি-নিয়ন্ত্রিত জীবই হবে, তা হলে তার পক্ষে কখনওই প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর প্রতিষ্ঠিত অর্থনীতির পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। সম্ভাবনাবাদের স্বপক্ষে আরও অনেক দার্শনিক, সমাজতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক সওয়াল করেছেন। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন ফ্রান্সের ভিদাল-দ্য লা ব্লাশ (1845-1918), ইমানুয়েল দ্যমার্তোন (1873-1955); মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইসাইয়া বাওম্যান, কার্ল সয়ার প্রমুখ তাত্ত্বিকগণ।


    (iii) কার্যকারিতা ও পরিবেশভিত্তিক পদ্ধতি (Functional and Environmental approach): 

    এই পদ্ধতিতে মানুষের সমস্ত আর্থ-সামাজিক উদ্যোগের কার্যকারিতা এবং ওই কাজের জন্য পরিবেশ কতটা সহনশীল সে বিষয়ে অনুসন্ধান করা হয়।

     আলোচ্য দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বকে কতকগুলি পৃথক কিন্তু পরস্পর সংযুক্ত প্রণালীর সমষ্টি হিসেবে দেখা হয়। পৃথক তার কারণ, এই প্রণালীগুলির কার্যকারিতা এবং কৃৎকৌশল আলাদা। আবার এরা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত, কারণ এরা প্রত্যেকেই পরিবেশকে অনুসরণ করে। [তথ্যসূত্র: Bennett, R. J. and Chorley, R. J. 1978, Environmental Systems: Philosophy, analysis and control, Methuen, London.] যেমন- নিবিড় জীবনধারণভিত্তিক কৃষিপদ্ধতি অনুসারে ধান চাষ এবং ব্যাপক বাণিজ্যভিত্তিক কৃষি অনুসারে গম চাষ এরা কৃষি পদ্ধতি অনুসারে আলাদা হলেও পরিবেশ বা বাস্তুতন্ত্র অনুসারে, এই দুই কৃষিপদ্ধতি জীবভরের পিরামিড (pyramid of biomass), শক্তির পিরামিড (energy pyramid) ইত্যাদিকে অস্বীকার করে না।


    (iv) কল্যাণ ও উন্নয়নভিত্তিক পদ্ধতি (Welfare and Developmental approach): 

    বিংশ শতাব্দীর ছয়-এর দশকের শেষ ও সাত-এর দশকের শুরুতে অর্থনীতি ও ভূগোলে কল্যাণ ও উন্নয়নমূলক বিশ্লেষণ পদ্ধতি আত্মপ্রকাশ করে। সামাজিক সম্পদগুলির বণ্টন কেমন, মানুষের আয়ের ক্ষেত্রে সাম্য আছে কি না, দারিদ্র্যের বণ্টন ও তীব্রতা কতটা ইত্যাদি বিষয়ে অর্থাৎ সামাজিক কল্যাণকে (social welfare) কেন্দ্র করে পর্যালোচনা করা শুরু হয়।[তথ্যসূত্র: সেন অমর্ত্য, 2004, উন্নয়ন ও স্ব-ক্ষমতা, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা] অর্থনৈতিক ভূগোল ও সম্পদশাস্ত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গি নতুন মাত্রা যোগ করে। ফলে স্থিতিশীল উন্নয়ন, মানব উন্নয়ন, সামাজিক সুযোগ, সামাজিক নির্বাচন ও দায়বদ্ধতা প্রভৃতি ক্ষেত্রগুলির অন্তর্ভুক্তি ঘটে।

    নবীনতর পূর্বতন

    نموذج الاتصال