ভূতাত্ত্বিক সময়ের মানদণ্ড অনুসারে জীববৈচিত্র্য Biodiversity according to Geological Time Scale
আজ থেকে 460 কোটি বছর আগে পৃথিবী যখন প্রথম তৈরি হল তখন এই গ্রহটি ছিল এক প্রাণহীন গোলকমাত্র । আর আজ সেই গোলক জুড়েই কত রকমের প্রাণের চিহ্ন । পৃথিবীর আদিম বাতাসে কোনো অক্সিজেন ছিল না , সুতরাং পৃথিবীর প্রথম উদ্ভিদগুলি বাতাসের অক্সিজেন ছাড়াই বেঁচে থাকতে অভ্যস্ত ছিল । পৃথিবীতে আজও বহু রকম ব্যাকটেরিয়া আছে যারা বাতাসের অক্সিজেন ছাড়াই বেঁচে থাকে । তারপর পৃথিবীর আদিম উদ্ভিদগুলিও তাদের সালোকসংশ্লেষ ক্রিয়ার সাহায্যে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে এবং কালক্রমে অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদের আবির্ভাব হয় । জীববিবর্তনের সূত্রপাত প্রথম সমুদ্রে ঘটেছিল এবং একটা বিরাট সময় ধরে ( 300 কোটি থেকে প্রায় 45 কোটি বছর আগে পর্যন্ত ) জীবজগৎ সমুদ্রেই আবর্তিত হয়েছিল । এরপর জল ও স্থলে জীবজগতের বিবর্তন গত 45 কোটি বছরের মধ্যে কয়েক গুণ বেড়ে গেছে । নীচের সারণিতে এই জীববৈচিত্রর বিভিন্ন যুগ ধরে আলোচনা করা হল—
★প্রি - ক্যামব্রিয়ান যুগ ( Pre - cambrian Era )
এই যুগে গ্রামের বিকাশ শুরু হয় প্রায় 380 কোটি বছর আগে । তবে এই যুগে উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবির্ভাব ও অস্তিত্বের বিশেষ কোনো প্রমাণ শিলাস্তরগুলির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়নি । অতি সামান্য কিছু জীবাণু , সরল উদ্ভিদ ও প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে এ যুগের শিলাস্তরগুলির মধ্যে প্রি - ক্যামব্রিয়ানের শেষ দিকে আলগি এবং ব্যাকটেরিয়ার প্র থাকলেও তার সঙ্গে কিছু কীট ও স্পপ্তের আবির্ভাব ঘটে । এই সময় সমস্ত প্রাণী ছিল অমেরুদণ্ডী প্রকৃতির এবং অবায়ুজীবী বা কম অক্সিজেন যুক্ত বায়ুতে বসবাসের উপযোগী ।
★প্যালিয়োজোয়িক যুগ ( Paleozoic Era )
1. আজ থেকে প্রায় 54.7 কোটি বছর আগে প্যালিওজোয়িক যুগ শুরু হয়েছিল এবং স্থায়ী হয়েছিল প্রায় 30 কোটি বছর ।
2. এই যুগে প্রাণীজগতের অধিকাংশ অনুন্নত অমেরুদণ্ডী প্রাণীর রাজত্ব ছিল । এদের মধ্যে আর্কিওসায়াথিয়ান , ট্রাইলোবাইট , গ্রাপ্টোলাইট , ব্রাকিও পড , নটিলয়েড ইত্যাদি প্রধান ।
3. ক্যামব্রিয়ান উপযুগে জলজ প্রাণীদেরই প্রাধান্য ছিল । এদের মধ্যে রেডিওলরিয়া ও ফোরামিনিফেরা উল্লেখযোগ্য । এই উপযুগে প্রথম সুস্পষ্ট জীবাশ্ম পাওয়া যায়
4. অর্ডোভিসিয়ান উপযুগে মেরুদণ্ডী মাছ জাতীয় প্রাণীদের উদ্ভব ঘটে । এছাড়া ট্রাইলোবাইট , প্টোলাইটদের উপস্থিতিও ছিল
5. সিরিয়ান উপযুগে সংবাহীহীন জলজ উদ্ভিদ যথা ব্রায়োফাইট জাতীয় উদ্ভিদের সূচনা হয় । এই জাতীয় গাছগুলি মস জাতীয় ছোটো ছোটো উদ্ভিদ । এই যুগে প্রথম প্রধান প্রাচীরের উদ্ভব ঘটে ।
6. ডেভোনিয়ান উপযুগে উভচর প্রাণীর সৃষ্টি হয় । আবার এই যুগেই উদ্ভিদের মধ্যে বড়ো গাছের আবির্ভাব ঘটে । ডেভোনিয়ান উপযুগে প্রথম বাংল তৈরি হয় ।
7. কার্বনিফেরাস উপযুগে প্রথম বৃক্ষসমৃদ্ধ বনাঞ্চলের সূচনা হয় যাকে কোল ফরেস্ট ( Coal forest ) বা কয়লা বনা বলা হয় । আমরা বর্তমানে যে কয়লা দেখি তা মূলত এই সময় তৈরি হয়েছিল । এই সময় উদ্ভিদ জগতে এক বিশেষ ধরনের উদ্ভিদের প্রাচুর্য ছিল । সেগুলি ছিল সিড ফার্ন অর্থাৎ বীজ উৎপাদনকারী ফার্ন । আজকের বাস্তবীজী উদ্ভিদের সৃষ্টি এই সিড ফার্ন থেকে । এই উপযুগে সরীসৃপ প্রাণীদের উদ্ভব হয় ।
৪. পার্সিয়ান উপযুগে টেরিডোম্পার্ম , টেরিডোফাইট জাতীয় বিশাল উদ্ভিনের অরণ্য সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে । গার্ডিয়ান উপযুগের সরীসৃপ ও উভচর প্রাণীদের বিকাশ ঘটে । এই সময় সরলবর্গীয় গাছের বিস্তার দেখা যায় ।
★মেসোজোয়িক যুগ ( Mesozoic Era )
1.মেসোজোয়িক যুগ শুরু হয় আজ থেকে 24.5 কোটি বছর আগে এবং স্থায়ী হয়েছিল প্রায় 18 কোটি বছর ।
2.মেসোজোয়িক যুগে শুরু অর্থাৎ ট্রায়াসিক উপযুগে আবহাওয়া ছিল বেশ উয় ও আর্দ্র । ফলে সরীসৃপদের বিস্তার ও বৈচিত্র্য চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছোয় । এই উপযুগে উদ্বৃত্ত সরীসৃপের আবির্ভাব ঘটে এবং ডায়নোসরের আবির্ভাব ঘটে
3. জুরাসিক উপযুগে ডায়নোসরদের চরম বিকাশ ঘটে এবং সারা পৃথিবীর জল ও স্থলভাগে তাদের বিরাজ ছিল । পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণীদের আবির্ভাব এই উপযুগেই হয়।
4. ক্রিটেসিয়াস উপযুগের শেষ ভাগে ডায়নোসরদের ধ্বংস এবং অবলুপ্তি ঘটে । তবে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বিস্তার ঘটে ।
5. উদ্ভিদজগতে বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তবীজী উদ্ভিদ এবং কিছু সপুষ্পক উদ্ভিদের আগমন ঘটে । সুপুষ্পক উদ্ভিদের বৈচিত্র্য দ্রুত বাড়তে থাকে ক্রিটেসিয়াস যুগের শেষ ভাগ থেকে । অন্যদিকে ফার্নজাতীয় বেশ কিছু উদ্ভিদ ক্রমশ অবলুপ্ত হতে থাকে ।
6. জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে মেসোজোয়িক যুগ ছিল বৈচিত্র্যময় ও অভিব্যক্তির দিক থেকে উন্নত । এযুগে প্রাণী ও উদ্ভিদকুলের শিলাস্তরে অনেক উন্নত সংরক্ষণ ঘটেছে ।
★সেনোজোয়িক যুগ ( Cenozoic Era )
1. সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে সেনোজোয়িক যুগ শুরু হয় । সেনোজোয়িক যুগের দুটি উপযুগ – ( a ) কোয়াটারনারি ও ( b ) টারসিয়ারি এবং সাতটি অধিযুগ ।
2. এই যুগে পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন প্রজাতির অবলুপ্তি যেমন ঘটতে থাকে তেমন নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে ।
3. প্যালিওসিন ও ইয়োসিন অধিযুগে ঘোড়াদের পূর্বপুরুষ ও বর্তমান গবাদি প্রাণীদের উদ্ভব ঘটে । এই সময় গুপ্তবীজী সপুষ্পক উদ্ভিদের বিস্তার লক্ষ করা যায় ।
4. অলিগোসিন উপযুগে বানর গোষ্ঠী ও শূকর গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয় ।
5. মায়োসিন উপযুগে কুকুর ও ভাল্লুকের উদ্ভব হয় । তাছাড়া এই উপযুগে সপুষ্পক উদ্ভিদের চূড়ান্ত বিকাশ হয় । তৃণভোজী স্তন্যপায়ী প্রাণীদেরও বিস্তার লক্ষ করা যায় ।
6. প্লায়োসিন উপযুগে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে বিপুল বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায় । এসময়ে হাতিরা এশিয়া ও আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে । বিবিধ বনমানুষের প্রাচুর্য লক্ষ করা যায় ।
7. প্লাইস্টোসিন উপযুগ তুষার যুগ নামে পরিচিত । প্রাচীন পৃথিবীর অপেক্ষাকৃত বড়ো মাপের প্রাণীরা এসময়ে অবলুপ্ত হয় । এই সময়ে মানুষরা ক্রমশ বিবর্তিত হয়ে আধুনিক মানুষের পরিণত হয় । সমুদ্রে প্ল্যাংকটনের উদ্ভব এই সময়ে লক্ষ করা যায় ।