ভূকম্পন তরঙ্গ (Seismic Wave)
ভূমিকম্পের সময় যে শক্তি নির্গত হয় তা পাথরের মধ্যে কম্পন সৃষ্টি করে । এই সময় যে তরঙ্গ সৃষ্টি হয় তাকে ভূকম্পন তরঙ্গ ( seismic wave ) বলে । এই তরঙ্গের সাহায্যে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে বিশদভাবে জানা যায় যে কোনো প্রকার ভূমিকম্পের সময় ভূকম্পন কেন্দ্র থেকে একই সঙ্গে তিন ধরনের ভূকম্পীয় তরঙ্গের উৎপত্তি হয় । এইসব তরঙ্গ ভূকম্পন কেন্দ্র হতে বিভিন্ন দিকে , বিভিন্ন মাধ্যমে , বিভিন্ন গতিতে এবং বিভিন্ন উপায়ে প্রবাহিত হয় । ভূকম্পন তরঙ্গের বিভিন্ন বিষয়গুলি ভূকম্পলেখ যন্ত্রের ( Seismograph ) সাহায্যে পাঠ নেওয়া হয় । কম্পনের তরঙ্গের গতিবেগ নির্ভর করে স্তরের ঘনত্বের ওপর । আবার স্তরের অবস্থান যতই ঘন হবে ততই তরঙ্গের গতিবেগ বৃদ্ধি পাবে । ফলে একই স্থানে অবস্থিত ভূকম্পলেখ যন্ত্রগুলিতে কম্পনের রেখাগুলোর মধ্যে তারতম্য লক্ষ করা যায় । ভূকম্পলেন যন্ত্রের সাহায্যে তরঙ্গ কোনো শিলার মধ্যে দিয়ে , কী প্রকার তরঙ্গ কতদূর যাবে এবং তার গতিবেগ কী পরিমাণ তা জানা যায় । পৃথিবীর আকার অনুযায়ী এই তরঙ্গগুলি বিভিন্ন গতিতে অগ্রসর হয় ।
ভূকম্প তরঙ্গের শ্রেণিবিভাগ ( Classification of Seismic Wave )
ভূমিকম্পের তরঙ্গগুলিকে তাদের দৈর্ঘ্য ও প্রবেশ্যতা অনুসারে তিনভাগে ভাগ করা হয় । যথা ( a ) অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ বা প্রাথমিক তরঙ্গ বা Primary wave , ( b ) তির্যক তরঙ্গ বা অনুপ্রস্থ তরঙ্গ বা গৌন তরঙ্গ বা Secondary wave এবং ( c ) পৃষ্ঠতরা বা পার্শ্বতরঙ্গ বা Long wave বা Surface wave । এদের মধ্যে P এবং S তরলা ভূগর্ভের মধ্য দিয়ে যায় । তাই এদের ভূ - অভ্যন্তরস্থ তরঙ্গ বা Body wave বলে । L তরঙ্গ ভূপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে যায় বলে একে ভূপৃষ্ঠস্থ তরঙ্গ বা Surface wave বলে । নীচে তরঙ্গগুলি সম্বন্ধে আলোচনা করা হল
[1] অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ ( Primary Wave )
P তরা হল অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ এক্ষেত্রে তরঙ্গ যেদিকে প্রবাহিত হয় , মাধ্যমের কণাগুলি সেদিকেই কাঁপতে থাকে । এই তরঙ্গ কঠিন , তরল এবং গ্যাসীয় সমস্ত বস্তুকণার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় । এই তরলাটি ভূকম্প পরিলেখন যন্ত্রে লিপিবদ্ধ হওয়ার পর কিছুটা সময় সরলরেখার মতো অঙ্কিত হয় । তারপর কিছুক্ষণ আলোড়ন ঘটে সরলরেখাটি আঁকাবাঁকা রেখা লিপিবন্ধ হয় । এই তরঙ্গটি পৃথিবীর কেন্দ্রমণ্ডলের মধ্য দিয়ে অপর প্রান্তে চলে যেতে পারে । এই তরঙ্গের গতিবেগ নির্ভর করে পৃথিবীর অভ্যন্তরে অবস্থানরত পদার্থের অবস্থা , ধর্ম ও ঘনত্বের উপর । ভূ - অভ্যন্তরে পদার্থের ঘনত্বও অনড়তার সঙ্গে P তরঙ্গের গতিবেগের সম্পর্ক সমানুপাতিক । অর্থাৎ পদার্থের ঘনত্ব ও অনড়তা বাড়লে এই তরঙ্গের গতিবেগও বাড়ে আবার কমলে কমে । ভূত্বকে এর গতিবেগ প্রতি 28 মেঝেঝে 4.25-6.5 কিমি , গুরুমণ্ডলে 6.47-134 কিমি , এবং কেন্দ্রমণ্ডলে 8.0-11.3 কিমি । এই তরঙ্গ বারবার সম সৃষ্টি করে বলে কোনো যন্ত্র ছাড়াই এর শব্দ শোনা যায় । এখানে V = প্রাথমিক তরঙ্গের গতিবেগ , V = অনুরতরে গতিবেগ , K = স্থিতিস্থাপকতার আয়তনাঙ্ক , ( bulk modulal of elasticity ) , কঠিন্যের মানাঙ্ক ( modulus বা rigidity ) এবং p বস্তুর ঘনত্ব । প্রাথমিক তরা সংকোচন প্রসারণ তরঙ্গ বলে তার গতিবেগ অণুতরঙ্গ চেয়ে বেশি কারণ অণুতরঙ্গ শুধু পীরন অন্তরঙ্গ।
[2] তির্যক তরঙ্গ ( Secondary Wave )
ভূমিকম্পলেখতে প্রাথনিক ভরা লিপিবন্ধ হওয়ার পর , লেখচিত্রে কিছুটা সময় চিত্রটি সরলরেখার ন্যায় অবস্থান করে । পরবর্তী সময়ে ক্ষণস্থায়ী ভূ - আলোড়ন ঘটলে লেখচিত্রটি সরলরেখার ন্যায় অবস্থান না করে আঁকাবাঁকা রেখার ন্যাপ নেয় । পরে আসা এই তরঙ্গাগুলিকে তির্যক তরঙ্গ বা অনুতরা বলে । এই তরঙ্গগুলি সাধারণত সমকোণে প্রবাহিত হয় । ভূ - অভ্যন্তরে এই তর বেশি দূর যেতে পারে না কারণ এই তরতা শুধুমাত্র কঠিন মাধ্যমের মধ্য দিয়ে যেতে পারে , কিন্তু তরল ও গ্যাসীয় মাধ্যমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে না । সেই কারণে , তরল বহিঃকেন্দ্রমণ্ডল অতিক্রম করে এই ভরা অন্যপ্রান্তে পৌঁছোতে পারে না । ১ তরঙ্গ হল অনুপ্রস্থ তরঙ্গ অর্থাৎ তারা যে দিকে প্রবাহিত হয় , মাধ্যমের কণাগুলি তার উল্লঙ্গ দিকেই কাঁপতে থাকে । এর গতিপ্রবাহ আলোক তরঙ্গের মতো । এর গতিবেগ P ভরা অপেক্ষা কম , অর্থাৎ ভূত্বকে প্রতি সেকেন্ডে 2.29-3.56 কিমি এবং গুরুমণ্ডলে 3.55 7.23 কিমি গতিবেগ । প্রাথমিক তরফ্লোর পরে এই তরঙ্গ উপকেন্দ্রে পৌঁছায় । এই তরঙ্গের কম্পাঙ্ক ( frequency ) যথেষ্ট বেশি থাকে বলে তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের পরিমাণ কম থাকে ।
[3] পৃষ্ঠ তরঙ্গ ( Surface Wave )
এই তরঙ্গা উপকেন্দ্র থেকে দীর্ঘ পরিধিগত পথে ভূপৃষ্ঠ বরাবর প্রবাহিত হয় বলে একে Long waves বলে । এই তরা সর্বদা ভূপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে যায় । এবং ভূপৃষ্ঠের গভীরে প্রবেশ করা মাত্র হারিয়ে যায় । এই ভরা অত্যন্ত ধীর গতিসম্পন্ন । এই তরঙ্গে কম্পাঙ্ক ( frequency ) সবচেয়ে কম বলে তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি । গঠনকারী উপাদানের প্রকৃতি অনুসারে মাধ্যমগুলোকে বিভক্ত করে এটি ভূপৃষ্ঠে পৌঁছায় । এটি ভূপৃষ্ঠে শিলামন্ডল ও বায়ুমণ্ডলের মধ্যে সীমারেখা সৃষ্টি করে । এই তরঙ্গের গতিবেগ খুবই কম অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে 5-6.5 কিমি । এই তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য ও গতিবেগ পর্যবেক্ষণ করে P ও তরঙ্গের কার্যাবলী এবং শিলার প্রকৃতি ও গভীরতা সম্পর্কে জানা যায় এই তরঙ্গ ভূত্বকের উপর অবস্থিত বস্তুগুলিকে উপরে - নীচে ও দুই পাশে চলনশীল করে এবং ব্যাপকভাবে ভাঙন ঘটায় । অর্থাৎ ভূকম্পনজনিত ধ্বংসকাণ্ডের জন্য এই তরতা সর্বাধিক নারী । এই তরঙ্গ দুই প্রকার যথা - লাভ তর ( love wave ) এবং র্যালে তরঙ্গ ( rayleigh wave ১ তরঙ্গের মতো বস্তুকণার ওঠানামার মাধ্যমে যে তরঙ্গ ভূপৃষ্ঠে প্রবাহিত হয় তাকে লাভ তরলা বলে । ব্রিটিশ গণিতজ্ঞA. F. H. Love , 1911 সালে সর্বপ্রথম এই তরঙ্গের পরিচিতি ঘটান । ভূপৃষ্ঠে এর গড় গতিবেগ সেকেন্ডে 2-4.4 কিমি । বিজ্ঞানী Lord Rayleigh , 1885 সালে Rayleigh তরঙ্গের অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেন । এই তরঙ্গ বস্তুকণা ওঠানামা এবং সংকোচন প্রসারণ এই দুটি প্রকৃতির সমন্বয়ে ভূপৃষ্ঠের ওপরের অংশ দিয়ে প্রবাহিত হয় । এর গতিবেগ সেকেন্ডে 2.0-2.4 কিমি ।