welcome to mygeo.in Indian no 1 geography based website in Bengali

মাটি গঠনের প্রক্রিয়াসমূহ( Soil Pedogenic Processes)

মাটি গঠনের প্রক্রিয়াসমূহ( Soil Pedogenic Processes)


আবহবিকারের দ্বারা ভূত্বকের উপরিভাগে কঠিন শিলাচূর্ণকে রেগোলিখ (regolith) বলে। এই শিলাচূর্ণগুলি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জটিল প্রক্রিয়ার দ্বারা পরিবর্তিত হয়ে মাটিতে পরিগণিত হয়। এই বিভিন্ন জটিল প্রক্রিয়াগুলিকে মাটি বিজ্ঞানী সাইমনসন (Simonson, 1959) মাটি উৎপাদনের প্রক্রিয়া বলে চিহ্নিত করেন। এই প্রক্রিয়াগুলি মাটি গঠনকারী প্রক্রিয়া বা প্রাথমিক প্রক্রিয়া নামে পরিচিত এবং এই প্রক্রিয়াগুলিকে প্রধানত এটি ভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলি নীচে আলোচনা করা হল:

1. সংযোজন (Addition): মাটি গঠনের বিভিন্ন প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে সংযোজন একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। সংযোজনের অর্থ মাটির মধ্যে নানান পদার্থের সংযোজন ঘটে। এই পদ্ধতিতে মাটিতে জল, জৈব পদার্থ ও খনিজ পদার্থ সংযোজিত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সুক্ষ্ম খনিজকণা, পলল প্রভৃতি উচ্চস্থান থেকে ভূআস্তরণ, জলপ্রবাহ, নদীর প্লাবন প্রবাহ, বায়ুপ্রবাহ প্রভৃতির দ্বারা পরিবাহিত হয়ে নিম্ন সমভূমিতে সঞ্চিত হলে মাটির সংযোজন সম্পাদিত হয়।

2. অপসারণ (Removal): মাটি গঠনের অপর এক উল্লেখযোগ্য প্রক্রিয়া হল মাটিতে অবস্থিত পদার্থসমূহের অপসারণ। বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদানগুলির দ্বারা ভূপৃষ্ঠ ক্ষয়ের ফলে মাটির উপরিস্তর থেকে পললের অপসারণ হয়। এছাড়া ধৌত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জলে দ্রবীভূত পদার্থসমূহ নীচে অপসারিত হয়ে ভৌমজলের সঙ্গে মিশে গেলে অপসারণ প্রক্রিয়াটি সম্পাদিত হয়।

3. রূপান্তরকরণ (Transformation): এই পদ্ধতিতে মাটিতে অবস্থিত প্রাথমিক খনিজ পদার্থগুলি বিয়োজিত হয়ে গৌণ খনিজে রূপান্তরিত হয়। এই পদ্ধতির কতকগুলি উপবিভাগ রয়েছে যথা, অডিফিকেশন (audification), নিউট্রালাইজেশন (neutralization), অক্সিডেশন (oxidation), রিডাকশন (reduction), দ্রবণ (solution), অধঃক্ষেপণ (precipitation), হাইড্রেশন (hydration), ডিহাইড্রেশন (dehydration), হাইড্রোলিসিস্ (hydrolysis), বিয়োজন (decomposition), হিউমিফিকেশন (humification), মিনারেলাইজেশন (mineralization)। এদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল হিউমিফিকেশন এবং মিনারেলাইজেশন। এগুলি সম্বন্ধে নীচে আলোচনা করা হল:

(i) হিউমিফিকেশন (Humification): হিউমাস সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে হিউমিফিকেশন (humification) বলে। মাটি পরিলেখের সবার ওপরের স্তরে প্রাণী ও গাছপালার দেহাবশেষ মাটিতে মিশ্রিত হবার পর জীবাণুদের দ্বারা বিশ্লিষ্ট হয়ে কালো বা বাদামি রঙের কলয়েডবর্মী পদার্থ তৈরি হয় যাকে হিউমাস (humus) বলে। হিউমিফিকেশন প্রক্রিয়ায় জৈর দেহাবশেষ থেকে এই হিউমাস তৈরি হয়।

(ii) খনিজকরণ (Mineralization): আবার যে প্রক্রিয়ায় গাছপালা ও জীবজন্তুর দেহাবশেষ বিয়োজিত হয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, জল ও অন্যান্য খনিজ তৈরি করে, তাকে খনিজকরণ (mineralization) বলে। হিউমিফিকেশনের ফলে সৃষ্ট হিউমাস বায়ুর অক্সিজেন দ্বারা জারিত হয়ে জল, কার্বন ডাই অক্সাইড ও হিউমাস গঠনকারী খনিজ পদার্থে রূপান্তরিত হয়। এই প্রক্রিয়া চার ভাগে বিভক্ত, যথা: (a) অবায়ুজীবী হিউমিফিকেশন (চ) অম্ল হিউমিফিকেশন, (৫) মধু হিউমিফিকেশন এবং (৫) আর্তক্রান্তীয় হিউমিফিকেশন।

এই হিউমিফিকেশন এবং খনিজকরণের দ্বারা মাটির বিভিন্ন স্তর গঠন হয় এবং বিভিন্ন স্তরগুলি একত্রিত হয়ে মাটির পরিলেখ গঠিত হয়।

4. স্থানান্তর (Translocation): মাটি গঠনে সর্বশেষ প্রক্রিয়াটি হল স্থানান্তর। এই পদ্ধতিতে মাটির উপাদানগুলি একস্তর থেকে অন্য স্তরে স্থানান্তরিত হয়ে জমা হয়। এই প্রক্রিয়াটি ২টি পর্যায়ে বিভক্ত, যথা: (i) এলুভিয়েশন এবং (ii) ইলুভিয়েশন। নীচে এগুলি নিয়ে আলোচনা করা হল।

(i) এলুভিয়েশন (Eluviation): মাটি গঠনে এলুভিয়েশন প্রক্রিয়া একটি উল্লেখযোগ্য তথা গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাটির উপরিস্তরে অবস্থানরত পদার্থগুলি বৃষ্টির জলের দ্বারা দ্রবীভূত হয়ে নীচের দিকে গমন করে। বৃষ্টির জল মাটিতে পড়লে প্রথমে দ্রবণীয় খনিজ লবণ দ্রবীভূত হয়ে ভৌমজলের সাথে মেশে এবং অনুভূমিক প্রবাহরূপে প্রথমে নদী ও পরে সমুদ্রে মিলিত হয়। বৃষ্টিপাত বেশি হলে Ca, Mg, K, Al, Fe, Mn প্রভৃতি খনিজ মৌল A স্তর থেকে ধুয়ে (leaching) নীচের স্তরে অর্থাৎ ৪ স্তরে চলে যায়, একে এলুভিয়েশন (eluviation) বলে। এই দ্রবণ ও ধৌতকরণের ওপর মাটির অম্লতা নির্ভর করে। খনিজ উপাদানগুলি রাসায়নিক ও যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দ্রবণের মাধ্যমে নীচের স্তরে অপসারিত হয়। তাই এলুভিয়েশন দুই প্রকারের হয় (a) রাসায়নিক এলুভিয়েশন (chemical eluviation), (b) যান্ত্রিক এলুভিয়েশন (mechanical eluviation)। এলুভিয়েশনের ফলে মাটির নীচের স্তরে Hard Pan বা কঠিন ত্বক তৈরি হয়। মাটির পরিলেখ গঠনে এই প্রক্রিয়া অধিক কার্যকরী।

(ii) ইলুভিয়েশন (Illuviation): মাটি পরিলেখ গঠনে এটি একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় A স্তর থেকে ৪ স্তরে খনিজ ও জৈব পদার্থ অপসারিত হয়ে সেখানে জমা হয় এবং ক্রমে একটি শক্ত গাঢ় রঙের স্তর গঠন করে, একে ইলুভিয়েশন বলে। এই প্রক্রিয়াটি মাটির গ্রথন, গঠন, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, তাপমাত্রা প্রভৃতির ওপর নির্ভরশীল। আর্দ্র অঞ্চলে এই প্রক্রিয়া বেশি দেখা যায়, কিন্তু শুল্ক অঞ্চলে কম হয় বলে ৪ স্তরে লবণ জমা হলেও ক্ষারীয় উপাদানগুলির প্রাধান্য দেখা যায় না।

মাটি গঠনের মৌলিক প্রক্রিয়াসমূহ (Fundamental Processes of Soil)

ভূ-বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন ধারণা থেকে বলা যায় যে, প্রায় 400-500 কোটি বছর আগে পৃথিবীর সৃষ্টির সময় তা ছিল এক গ্যাসীয় জ্বলন্ত পিন্ড। পরবর্তী সময়ে তা তাপ বিকিরণের দ্বারা ধীরে ধীরে শীতল হয়ে তরল এবং আরো শীতল হয়ে কঠিন এবং সবশেষে তা শক্ত শিলায় পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর উপরিভাগ থেকে নীচের দিকে অর্থাৎ ভূ-অভ্যন্তরের দিকে কতকগুলি পৃথক স্তরে বিভক্ত। এদের সবচেয়ে উপরের স্তরের নাম ভূত্বক এবং সবচেয়ে নীচের স্তরের নাম কেন্দ্রমণ্ডল বা Core। যার গভীরতা প্রায় 6371 কিমি। ভূত্বক আবার দুটি ভাগে বিভক্ত একটি হালকা সিয়াল স্তর এবং অন্যটি ভারী সিসা স্তর। এই ভূত্বকের উপরিভাগে শিলাগুলি বিভিন্ন প্রক্রিয়ার দ্বারা মাটিতে পরিণত কিংবা রূপান্তরিত হয়। মাটি তৈরিতে বিভিন্ন প্রক্রিয়া কাজ করলেও কতকগুলি প্রক্রিয়া আছে যেগুলি প্রায় সবধরনের মাটিতে কাজ করে থাকে। এই প্রক্রিয়াগুলি পৃথিবীর যে কোনো স্থানে যে কোনো ধরনের মাটিতে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে। এই প্রক্রিয়াগুলি দুটি ভাগে বিভক্ত যথা (৫) মৌলিক প্রক্রিয়া বা সাধারণ প্রক্রিয়া (Fundamental or General Processes) এবং (b) বিশেষ প্রক্রিয়া বা সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া (Special or Specific Processes)। নীচে এগুলি সম্বন্ধে আলোচনা করা হল-

মাটি সৃষ্টিতে যে সমস্ত প্রক্রিয়াগুলি প্রত্যক্ষ বা সক্রিয় ভাবে কাজ করে তাকে সাধারণ বা মৌলিক প্রক্রিয়া বলে। এই প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা হল-

হিউমিফিকেশন (Humification): আবহবিকারের ফলে শিলাখণ্ডের ওপর যতক্ষণ না পর্যন্ত জৈব পদার্থ সংযুক্ত হয়,ততক্ষণ পর্যন্ত সেই শিলাখণ্ড বা রেগোলিথকে মাটি বলা যাবে না। জৈব পদার্থই মাটির মূল উপাদান। এই জৈব পদার্থগুলি আসে মাটিতে পড়ে থাকা মৃত উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহাবশেষ থেকে। এই সমস্ত দেহাবশেষগুলি বিভিন্ন রাসায়নিক পদ্ধতির মাধ্যমে যে গাঢ় কালো বা বাদামি বর্ণের চটচটে পদার্থে পরিণত হয় তাকে হিউমাস (humas) বলে। এই হিউমাস সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে হিউমিফিকেশন (humification) বলে। হিউমাসের প্রকৃতি সর্বত্র সমান নয়। এটি নির্ভর করে উদ্ভিদ ও প্রাণীর কাঁচা দেহাবশেষের সরবরাহের উপর। হিউমাস মাটিতে কলয়েড সৃষ্টি করে মাটির পুষ্টিতে সাহায্য করে। হিউমিফিকেশন চারটি উপপ্রক্রিয়ায় বিভক্ত। যথা-

(a) অবায়ুজীবী হিউমিফিকেশন (Anaerobic Humification): জলাভূমি, হ্রদ, জলাশয় কিংবা স্রোতহীন স্থানে যে সব জলজ উদ্ভিদ জন্মায় সেগুলি জলের অনেক গভীরে জন্মায়। সেইসব স্থানে বায়ুপ্রবেশ করতে পারে না বলে অক্সিজেনের অভাব লক্ষ করা যায়। ফলে উদ্ভিদের পচন শুরু হয়। এইসব অঞ্চলে বিশেষ অবায়ুজীবী জীবাণু বিশেষ পদ্ধতিতে মৃত জৈব পদার্থকে বিয়োজিত করে হিউমাসে পরিণত করে। এই ধরনের হিউমিফিকেশনকে অবায়ুজীবী হিউমিফিকেশন বলে। এই ধরনের হিউমাস থেকে পিট মাটির সৃষ্টি হয়।

(b) অম্ল হিউমিফিকেশন (Acid Humification): মাটিতে চুন জাতীয় পদার্থের অভাব থাকলে অম্ল হিউমিফিকেশন ঘটে। কারণ চুন দ্বারা ক্ষারের মাত্রা বৃদ্ধি এবং অম্লের মাত্রা হ্রাস ঘটায় এবং উদ্ভিদজাত পদার্থ সম্পূর্ণভাবে জারিত না হলে মাটি আম্লিক হয়ে যায়। পাইন জাতীয় উদ্ভিদ অঞ্চলে কাঁচা জৈব পদার্থের সঞ্চয় থেকে উৎপন্ন হিউমাস অম্লধর্মী।

আবার যেখানে ধৌত প্রক্রিয়া সারা বছর ধরে চলে সেক্ষেত্রে ক্যালসিয়াম ম্যাগনেশিয়াম এবং পটাশিয়াম মৌলগুলি মাটির নীচের স্তরে সঞ্চিত হওয়ায়, মাটির উপরের স্তর অম্লধর্মী হয়ে পড়ে। আবার যেসব স্থানে হালকা বর্ণবিশিষ্ট কোয়াজাইট শিলা অবস্থান করে সেখানে মাটি অম্লধর্মী হয়ে যায়।

(c) মরুপ্রায় অন্যলে হিউমিফিকেশন (Humification in Semi Arid Region): সাধারণত মরু প্রায় অঞ্চলে হিউমাস কম থাকে। কিন্তু পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য তৃণভূমিগুলিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশি বলে, বর্ণ কালো হয়ে থাকে। মরুপ্রায় অঞ্চলে মাটিতে ক্ষারজাতীয় ক্যাটায়ন বেশি থাকে বলে জৈব পদার্থের সঞ্চয় ভালো হয়। হিউমাসের সাথে বেশিরভাগ চুন জাতীয় পদার্থ থাকে বলে অম্ল হিউমিফিকেশন কম হয় বা হতে পারে না।

(d) উদ্বু ও আর্দ্র ক্রান্তীয় অঞ্চলে হিউমিফিকেশন (Humification in Warm and Wet Tropical Region): ক্রান্তীয় অঞ্চলে তাপমাত্রার পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণে খনিজকরণ প্রক্রিয়া দ্রুত হয়। তাই মাটিতে জৈব পদার্থ কম থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে কারণ কাঁচা জৈব পদার্থের অতিমাত্রায় জোগান এবং সামান্য পরিমাণে হিউমাস কমপ্লেক্সের অবস্থান।

খনিজকরণ (Mineralization): মাটি গঠন প্রক্রিয়ায় সাধারণ পদ্ধতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল খনিজকরণ। কাঁচা জৈব পদার্থ পচে হিউমাসে পরিণত হয়। বায়ুর অক্সিজেন তা জারিত হয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, জল ও হিউমাস গঠনকারী খনিজ পদার্থে পরিণত হয়। কিন্তু হিউমাস খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়ায়, হিউমাস গঠনকারী খনিজগুলি এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুনরায় মাটিতে ফিরে আসে। প্রায় সব ধরনের মাটিতে এই প্রক্রিয়া কার্যকরী হয়। এই প্রক্রিয়ার বিপরীত প্রক্রিয়া হল হিউমিফিকেশন।

এলুভিয়েশন (Eluviation): যে প্রক্রিয়ায় মাটির উপাদানগুলি দ্রবীভূত অবস্থায় ধৌত প্রক্রিয়ার (eaching) মাধ্যমে উপরের স্তর থেকে নীচের স্তরে অপসারিত হয়, তাকে এলুভিয়েশন বলে। যে স্তর থেকে বিভিন্ন উপাদানের অপসারণ ঘটে তাকে ক্ষরিত বা এলুভিয়াল স্তর বলা হয়। অধিক বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলে চুঁইয়ে পড়া জলের নিম্নগতির জন্য উপরের জরে ক্ষরণ হয়। কিন্তু অধিক বাষ্পীভবনযুক্ত অঞ্চলে কৈশিক প্রক্রিয়ায় (Capillary action) জলের ঊর্ধ্বগতি বজায় থাকায় নীচের স্তরের উপাদানগুলি উপরের দিকে স্থানান্তরিত হয়।

ইলুভিয়েশন (Illuviation): মাটি গঠনের মৌলিক প্রক্রিয়ার মধ্যে ইলুভিয়েশন এক উল্লেখযোগ্য প্রক্রিয়া। ক্ষরণের মাধ্যমে অপসারিত উপাদানগুলি মাটির নীচের স্তরে সঞ্চয়কে ইলুভিয়েশন প্রক্রিয়া বলে। সন্বিত পদার্থসমূহের স্তরকে ইলুভিয়াল স্তর বলা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ও স্তরে খনিজে সমৃদ্ধ হয়। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি হলে মাটির উপরের স্তরে অবস্থানরত খনিজ পদার্থ বৃষ্টির জলের সঙ্গে মিশে গিয়ে প্রায় 150 সেমি গভীরে এসে পৌঁছায়। স্বাভাবিক অবস্থায় খনিজ পদার্থের অপসারণ 50 সেমি পর্যন্ত গভীরে প্রবেশ করতে পারে।

মাটির গঠনের বিশেষ প্রক্রিয়াসমূহ (Specific Processes of Soil Formation)

মাটি গঠনে মৌলিক বা সাধারণ প্রক্রিয়াগুলি সব স্থানে কার্যকরী হলেও বিশেষ প্রক্রিয়া পৃথিবীর সর্বত্র সমানভাবে কার্যকরী হয় না। এক এক ধরনের ধরনের প্রক্রিয়া এক একস্থানে সংঘটিত হয়। মূলত জলবায়ু এবং স্বাভাবিক উদ্ভিদের অবস্থানের ভিত্তিতে এই প্রক্রিয়া কার্যকরী হয়। নীচে এই প্রক্রিয়ার কতকগুলি ভাগ আলোচনা করা হল-

1. ল্যাটেরাইজেশন (Laterization): যে প্রক্রিয়ায় মাটির উপরের স্তরের লৌহকণা ও অ্যালুমিনিয়াম কণা জমাটবদ্ধ হয়ে শস্ত আস্তরণ সৃষ্টি করে তাকে ল্যাটেরাইজেশন বলে। উদ্বু-আর্দ্র ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলে পর্যায়ক্রমে আর্দ্র ও শুষ্ক ঋতুর আবর্তনের জন্য এই প্রক্রিয়ায় ল্যাটেরাইট মাটির সৃষ্টি হয়। অত্যধিক বৃষ্টিপাতের ফলে অনুস্রাবণ প্রক্রিয়ায় দ্রবীভূত সিলিকা, চুন, ম্যাগনেসিয়াম পটাশিয়াম এবং বিভিন্ন জৈব পদার্থ অপসারিত হয়ে নীচের স্তরে সঞ্চিত হয় এবং অদ্রবীভূত লোহা ও অ্যালুমিনিয়াম উপরের স্তরেই থেকে যায়। লোহার আধিক্যের জন্য মাটির রং লালচে বর্ণের হয় এবং শুষ্ক ঋতুতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে মাটির উপরের স্তরের জল বাষ্পীভূত হওয়ায় এই মাটি ইটের মতো শক্ত আবরণ স্তর গড়ে তোলে। এই পদ্ধতিতে মাটি গঠনকারী খনিজের কণাগুলি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

2. স্যালিনাইজেশন (Salinization): যে প্রক্রিয়ায় মাটির নীচের স্তরের দ্রবীভূত লবণ উপরের স্তরে সঞ্চিত হয় তাকে স্যালিনাইজেশন বলে। এটি প্রধানত মরু ও মরুপ্রায় অঞ্চলের মাটি গঠন প্রক্রিয়া। কম বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে অনুস্রাবণ কম হওয়ায় দ্রবীভূত লবণ কৌশিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাটির উপরের স্তরে উঠে আসে। এই অঞ্চলে জলের বাষ্পীভবনের হার অধিক হওয়ায় মাটির উপরের স্তরে লবণ সঞ্চিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় মাটি লবণাক্ত হয় এবং মাটির উপরিভাগে সাদা আস্তরণের সৃষ্টি হয় যাকে সোলেনচাক (solonchak) বলা হয়। স্যালিনাইজেশন প্রক্রিয়ায় মাটিতে ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম এবং ক্যালসিয়ামের লবণ সালফেট বা ক্লোরাইডরূপে সঞ্চিত হয়।

3. ক্যালশিফিকেশন (Calcification): যে প্রক্রিয়ায় মাটির নীচের স্তরে ক্যালসিয়াম কার্বনেট বা চুন জাতীয় পদার্থ সঞ্চিত হয় তাকে চুনীকরণ বলে। এটি নাতিশীতোয় তৃণভূমি অঞ্চলের মাটি গঠন প্রক্রিয়া। মধ্যম বৃষ্টিপাতের জন্য মাটির উপরের স্তর থেকে সহজেই দ্রবীভূত ক্ষারকীয় পদার্থসমূহ যেমন পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম নীচের স্তরে ক্যালসিয়াম কার্বনেটের আকারে সঞ্চিত হয়। দ্রবণীয় অন্যান্য পদার্থসমূহ, যেমন ম্যাগনেশিয়াম ও সোডিয়াম সহজে অপসারিত হয় না। চারনোজেম মাটি চুনীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়।

4. অ্যালকালাইজেশন (Alkalization): যে প্রক্রিয়ায় মরু অঞ্চলের কাদা মাটিতে লবণ সঞ্চিত হয় তাকে অ্যালকালাইজেশন বলে। মরু অঞ্চলের যে সকল স্থানে জলনিকাশি ব্যবস্থা কিছুটা উন্নত সেখানে ভৌমজল স্তর নেমে গেলে, মাটির উপরিস্থিত লবণকণা জলে দ্রবীভূত হয়ে সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড উৎপন্ন করে। এই সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড যৌগ জৈব পদার্থকে দ্রবীভূত করে মাটির উপরের স্তরে সঞ্চিত হয়। সোলোনেজ (Solonetz) মাটি এইভাবে সৃষ্টি হয়। এই মাটি শুদ্ধ প্রকৃতির হয় এবং কালো রঙের লবণের আস্তরণ সৃষ্টি করে.

5. পডজলাইজেশন (Podzolization): যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাটির এ স্তর থেকে তাপমাত্রায় ক্ষারীয় পদার্থ, যেমন-ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম প্রভৃতি ও স্তরে অপসারিত হয় এবং রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট অম্লধর্মী জৈব পদার্থ বা হিউমাসের সৃষ্টি হয় তাকে পডজলাইজেশন বলে। এই অম্লধর্মী মাটি আর্দ্র নাতিশীতোয় জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্ভুত্ব সরলবর্গীয় অরণ্য অঞ্চলে দেখা যায়। এই মাটির রং ধূসর বর্ণের হয়। এটি ল্যাটেরাইজেশনের বিপরীত প্রক্রিয়া। কারণ অনুস্রাবণের মাধ্যমে লোহা এবং অ্যালুমিনিয়াম নীচের স্তরে অপসারিত হয়। কালক্রমে নীচের স্তরে বা ৪-স্তরে একটি অদ্রবণীয় স্তর গড়ে ওঠে। একে হার্ডপ্যান (hardpan) বলে।

6. গ্লেইজেশন (Gleization): যে প্রক্রিয়ায় জলমগ্ন অঞ্চলে বিজারণ (reduction) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অক্সিজেনের জোগানকে বৃদ্ধি করে মাটির গঠনের প্রক্রিয়া সম্পাদিত হয় তাকে গ্রেইজেশন বলে। এই প্রক্রিয়া যেখানে সংগঠিত হয় সেখানকার মাটিতে অক্সিজেনের সরবরাহ কম থাকে। ফলে ছোটো ছোটো জীবাণুগুলি ঠিকমতো কাজ করতে পারে না বলে জৈব পদার্থের জারণ ক্রিয়ার ফলে বিজারণ প্রক্রিয়ায় কাজ করতে থাকে। ফলে জৈব অম্লের উৎপত্তি ঘটে সেই সঙ্গে ফেরিক যৌগ ফেরাস যৌগে পরিণত হয়। ফলে মাটি গঠনহীন ভাবে উৎপত্তি লাভ করে এবং মাটির রং নীলাভবাদামি বা ধূসর বর্ণের হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Middle post ad 01