পডজল মাটি(Podsol Soil)
উৎপত্তি (Origin)
পণ্ডসল (Podsol) দুটি বুশীয় শব্দ 'Pod'-এর অর্থ নিম্নে এবং 'Zola'-এর অর্থ ছাই বর্ণের। মাটি বিজ্ঞানে আগে এই নামে ব্যবহৃত হত। মাটি ট্যাক্সনমি শ্রেণিবিভাগে 'স্পডোসল' (spodosol) নামটি পরিবর্তিত হয়েছে। এই নামটির অনুরূপ অর্থ অর্থাৎ গ্রিক শব্দ Spodos থেকে উৎপন্ন। যার অর্থ কাঠের ছাই। এই মাটি সমগ্র পৃথিবীর একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক মাটি। যে মাটির এ স্তর নিঃসৃত স্তর এবং ৪ স্তরে লোহা ও অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড ও হিউমাস জমা হয়েছে তাকে পডসল বা পড়জল মাটি বলে। প্রধানত সুমেরু এবং শীতল নাতিশীতোয় জলবায়ু বলয়ের মধ্যবর্তী স্থানে এই মাটি অবস্থান করে। পৃথিবীর অন্যান্য মাটির তুলনায় এই মাটি বেশি স্থান জুড়ে অধিকার করে রয়েছে। এই মাটি উৎপত্তিতে যেসব উপাদান সহায়তা করে, সেগুলি সম্বন্দ্বে আলোচনা করা হল-
1. মূল উপাদান (Main Components): এই মাটি গঠনে মূলত মাঝারি হতে মোটা বুননের শিথিল পলি হিমবাহের সঞ্চয়, বালিয়াড়ির বালি সঞ্চয় থেকে পডজল মাটির উৎপত্তি। এই মাটির মূল উপাদানে প্রচুর পরিমাণে নুড়ি ও পাথরের খন্ড দেখা যায়। সেই সঙ্গে এর মূল উপাদানে অধিক মাত্রায় কোয়ার্টজ (quartz) পাথর থাকে। এছাড়া যদি বেলেপাথর ও মূল শিলার মধ্যে সিলিকার পরিমাণ (70-90) শতাংশ বেশি হলে এই মাটি সহজেই গঠিত হয়।
2. জলবায়ু (Climate): বিখ্যাত মাটি বিজ্ঞানী গ্লিঙ্ক (Glink)-এর মতে যেসব অঞ্চলে প্রায় সারাবছর গড় বৃষ্টিপাত 55-57 সেমি হয় এবং বার্ষিক গড় উন্নতা 3°-6° সেলসিয়াস সেই সব অঞ্চলে এই মাটি গড়ে উঠে। সাধারণত শীতল ও আর্দ্র কিংবা অতি আর্দ্র নাতিশীতোয় জলবায়ু অঞ্চলেই এই মাটি গড়ে ওঠে। এছাড়া আর্দ্র মহাদেশীয় শীতল গ্রীষ্মকালসহ জলবায়ু এবং ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলে এই মাটি উৎপত্তি লাভ করতে পারে। তুন্দ্রা কিংবা সামুদ্রিক জলবায়ু অঞ্চলে যেখানে বছরে গড় বৃষ্টিপাত প্রায় 45-125 সেমি, সেই সব অঞ্চলে এই মাটি দেখা যায়। আবার আমেরিকার পডজল মাটির বলয়ে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত 110 সেমি এবং তাপমাত্রা 10° সেলসিয়াস। পশ্চিমাবায়ুর প্রভাবে সেখানে সারাবছর বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয় এবং শীত ঋতুতে অপেক্ষাকৃত বেশি বৃষ্টিপাত হয়। সেই সব অঞ্চলে ভূমিভাগে বরফপাত হয়, মাটির রন্দ্রে জল হিমায়িত হয়ে যায়। সেখানে তাপমাত্রা কম হওয়ার দরুন জলবায়ু আর্দ্র থাকে। ফলে এই মাটি উৎপত্তি লাভ করে। এই মাটি অঞ্চলে দিন ও রাতের মধ্যে তাপমাত্রার পার্থক্য কম।
3. স্বাভাবিক উদ্ভিদ (Natural Vegetation): আর্দ্রতার কারণে এই জলবায়ু অঞ্চলে উদ্ভিদ বেশি জন্মায়। কিন্তু একই ধরনের প্রজাতি বেশি লক্ষ করা যায়। অর্থাৎ সরলবর্গীয় বনভূমি অঞ্চলেই এই জাতীয় মাটি উৎপত্তি লাভ করে। দীর্ঘ শীতকাল, শীতের তীব্রতা, বরফের আবরণ, মাটির কণার ফাঁকা জায়গায় জল জমে বরফ প্রভৃতির জন্য জলের অভাব এই উদ্ভিদের প্রধান সমস্যা। সরলবর্গীয় উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত জৈব আবর্জনা পডজল মাটির আম্লিক বিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সেই সঙ্গে মাটিকে জৈব পদার্থে সমৃদ্ধ করে। তবে ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলের গুল্ম উদ্ভিদ জাতীয় ভূমিতে এই মাটি উৎপত্তি লাভ করে। আবার ক্রান্তীয় পর্ণমোচী অরণ্যেও এই মাটি দেখা যায়।
4. ভূমিরূপ (Topography): পডজল মাটি মূলত সমতল ভূমিভাগে গড়ে উঠলেও বন্ধুর পার্বত্য ভূমিভাগে বেশি দেখা যায়। যাই হোক এই মাটিযুক্ত অঞ্চলে ভূমিভাগের অভ্যন্তরে জল ও বায়ু প্রবেশে উপযোগী হওয়া দরকার। এই কারণে দুর্বল জলনিকাশি অঞ্চল কিংবা নিম্ন ভূমিভাগে এই মাটি বলয় গড়ে উঠতে পারে। পার্বত্য ভূমির ন্যায় মালভূমিতে এই মাটি লক্ষ করা যায়। অর্থাৎ যেখানে জল জমতে পারে না, সেই পরিবেশে এই মাটি গড়ে উঠেছে।
উৎপত্তির প্রক্রিয়া (Process of Origin)
পড়জল মাটি যে প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়, তাকে পড়জোলাইজেশন (podsolization) বলে। নীচে এই প্রক্রিয়া সম্বন্ধে আলোচনা করা হল-
নীতল-আর্দ্র পরিবেশে তাপমাত্রা কম থাকার দরুন বাষ্পীভবন কম হয়। মাটি সবসময় আর্দ্র থাকে বলে অতিরিত্ব জল মাটির ভিতর দিয়ে নীচে নামতে থাকে। এই প্রক্রিয়াকে ধৌত প্রক্রিয়া বলে। এটি প্রায় সারা বছর চলতে থাকে। ভূমিভাগে অবস্থানরত জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে pH এর মান কমে যায়। সেই জৈব পদার্থ মিশ্রিত অম্ল জল খনিজ লবণের অপসারণ (cluviation) সম্পূর্ণ করে। সেই সঙ্গে যে লৌহ ও অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড যা সাধারণ জলে দ্রবীভূত হয় না, কিন্তু তা অম্ল জলে যৌত প্রক্রিয়ায় অপসারিত হয়ে নিকটবর্তী স্তরে সঞ্চিত হয়। মাটিতে অম্লের পরিমাণ বেশি বলে মাটির নাইট্রেট তৈরির প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। ফলে মাটির উপরের স্তরে বালি সঞ্চিত হয়। তাই এই মাটির প্রস্থচ্ছেদে সবচেয়ে উপরের স্তর খুবই পাতলা এবং ধূসর বর্ণের হয়। ধূসর রঙের বলে, এই মাটিকে পডজল বলে। আর যে পদ্ধতিতে হয় তাকে পডজলীকরণ বলে। পরিশেষে বলা যায় যে, মাটির ওপরের স্তরে বালুকারাশির সঞ্চয় এবং খনিজ লবণের অপসারণই পডসলীকরণ।
ধৌতকরণের এ স্তর বা উপরিস্তর থেকে নেমে আসা সেসকুই-অক্সাইড ও জৈব পদার্থ ৪ স্তরে অনুধাবিত হয়ে অদ্রাব্য ফেরিক লৌহে পরিণত হয়। ফলে ৪ স্তরে বালুকারাশির গায়ে লাল রঙের আয়রন দেখা যায়। জলের অভাবের জন্য এগুলি ৪ স্তরের আরো নীচে না যেতে পেরে ৪ স্তরে জমা হয়। এই ৪ স্তরে বিপরীত আধান যুক্ত কাদা ও বালি কণাগুলি অ্যালুমিনিয়াম ফেরিক ও লৌহ আয়রনগুলিকে আকর্ষণের দ্বারা আটকে দেয়। তাই ৪ স্তরের নীচে যৌগগুলি আর নামতে পারে না। আবার এই ৪ স্তরে বিভিন্ন ক্ষুদ্র প্রাণীগুলির কাজের দ্বারা যৌগগুলি ভেঙে যায় ও এই ৪ স্তরে জমা হয়। এইভাবে দেখা যায় যে, A স্তর থেকে নেমে আসা দ্রবীভূত যৌগগুলি হিউমিফিকেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে পডজল মাটি উৎপত্তি লাভ করে।
বৈশিষ্ট্য (Characteristics)
(i) সরলবর্গীয় বনভূমি অঞ্চলের জীবাণুগুলির কাজের ফলে জৈব পদার্থসমূহ পচে গিয়ে জৈব অ্যাসিড তৈরি হয়।
(ii) সমস্ত ধরনের পড়জল মাটিতে কিছু সুনির্দিষ্ট ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম লক্ষ করা যায়।
(iii) এই মাটিতে সাধারণত 70-80 শতাংশ বালি এবং 10 শতাংশের কম কাদা কণা লক্ষ করা যায়।
(iv) এই মাটির সমস্ত দিগন্ত (horizons) বালি ও দোআঁশ জাতীয় প্রথন দেখা যায়।
(v) এই মাটির পরিলেখের মধ্যবর্তী স্তরে লৌহ হাইড্রক্সাইড এবং অ্যালুমিনিয়াম জমা হওয়ার জন্য মাটিতে কাদা কণার অনুপাত সামান্য বাড়তে পারে।
(vi) পৃথিবীর প্রায় সমস্ত পড়জল মাটির দুটি দিগন্তে বেশি পরিমাণে জৈব পদার্থ উপরের (A) দিগন্তে যার পরিমাণ প্রায় 70 শতাংশের কাছাকাছি। কিন্তু নীচের দিগন্তে (B) এই পদার্থের পরিমাণ প্রায় 15 শতাংশের কাছাকাছি।
(vii) এই মাটির A Horizon-এ অম্লের পরিমাণ বেশি। অর্থাৎ pH-এর পরিমাণ প্রায় 3.5-4.5। কিন্তু পরিলেখের গভীরতা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গো pH-এর মান বেড়ে প্রায় 5.5 হয়।
(viii) এই মাটিতে জৈব অ্যাসিডের উপস্থিতি হওয়ার জন্য অধিক অম্লধর্মী এবং অনুর্বর প্রকৃতির হয়।
(ix) এই মাটির বিভিন্ন স্তরে রঙের তারতম্য লক্ষ করা যায়। এই মাটির উপরের স্তরে জৈব পদার্থ বেশি থাকায় বর্ণ বাদামি বা ছাই বর্ণের হয়। কিন্তু নীচের স্তরে রঙ হালকা ধূসর হয়ে থাকে।
(x) বৃষ্টিপাত ও বাষ্পীভবন যথেষ্ট পরিমাণে হয় বলে হিউমাস ও খনিজ পদার্থ মাটির ওপরের স্তর থেকে নীচের স্তরে স্থানান্তরিত হয়।
(xi) বৈশিষ্ট্য অনুসারে এই মাটি পেডালফার শ্রেণির.
পরিলেখ (Profile)
পরিণত পডজল মাটির প্রোফাইলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তার মধ্যে সমস্ত স্তরের অবস্থান। পডজল মাটিতে নিম্নলিখিত স্তরগুলি দেখা যায়।
1. A_{0} স্তর ( A_{0} Layer): 0.5 ইঞ্চি থেকে 25 ইঞ্চি গভীরতা যুক্ত এই স্তরটি আংশিকভাবে পচে যাওয়া এবং না পৌঁছে যাওয়া উদ্ভিদের পাতা কান্ড শাখা প্রশাখা-মোষ স্থান এবং বহু জাতীয় তৃণ নিয়ে গঠিত। অরণ্য অঞ্চলের জৈব পদার্থের জঞ্জালের এই রূপ আচ্ছাদনকে ডাফ নামে অভিহিত করা হয়। সরলবর্গীয় অরণ্যের অঞ্চলেAó স্তরের রাসায়নিক বিক্রিয়া আম্লিক প্রকৃতির হয়। অম্লতার পরিমাণের ক তুগত বৈচিত্র্যও দেখা যায়। শীতের শেষের দিকে এবং বসন্তের পারকালে এই স্তরের অম্লতা হয় সর্বাপেক্ষা বেশি এবং শরৎকালে সর্বাপেক্ষা কম।
2. A_{1} স্তর ( A_{1} Layer): এই স্তর 6-8 ইন্দি পুরু। এই স্তর পচে যাওয়া জৈব পদার্থ বা হিউমাস সমৃদ্ধ এবং ধূসর থেকে বাদামি রঙের। এই স্তরে জৈব পদার্থের পরিমাণ গভীরতার সাথে সাথে হ্রাস পায়। এই স্তরে কোনো নির্দিষ্ট ধরনের গঠন গড়ে ওঠে না।
3. A_{2} স্তর ( A_{2} Layer): এই স্তরের গভীরতা 6-8 ইঞ্চি। A_{1} স্তর অপেক্ষা এর রং হালকা। পরিণত পডজল মাটিতে এই স্তরের রং ধূসর বা ছাই রঙের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রং সাদা নয়। এই স্তরের গভীরতা মাটির গ্রথনের ওপর নির্ভরশীল। স্তূপ প্রথন যুক্ত পডজল মাটির A স্তরের গভীরতা অনেক বেশি হয় কারণ এক্ষেত্রে এলুভিয়েশন প্রক্রিয়া অনেক গভীরতা পর্যন্ত কার্যকরী হয়। যে সমস্ত পডজল মাটি সম্পূর্ণরূপে বিকাশ লাভ করেনি সেগুলির A_{2} স্তরের ধূসর রং বাছাই পরিণত পডজল মাটির ন্যায় সুস্পষ্ট নয়।
4. B_{1} স্তর ( B_{1} Layer): এই স্তর 6-10 ইঞ্চি পুরু। A স্তর গোষ্ঠী অপেক্ষা এই স্তরের প্রথন সূক্ষ্ম প্রকৃতির। এর রং বাদামি বা গাঢ় বাদামি অথবা লালচে বাদামি। এই স্তরে মাঝে মাঝে গাঢ় বাদামি হিউমাসের ছিটে দেখা যায়।
5. B_{2} স্তর ( B_{2} Layer): এই স্তরের গভীরতা 6-8 ইঞ্চি। এর রং বাদামি বা গাঢ় লালচে বাদামি। এই স্তরের নীচের দিকে গ্রথন অপেক্ষাকৃত স্থূল প্রকৃতির। এই স্তরের উপাদানগুলি দৃঢ় ও সংবন্ধ। হিউমাস ও সেস্কু-অক্সাইড (R_{2}*O_{3}) এই স্তরের প্রধান সঞ্চিত উপাদান। B_{2} স্তরের ওই দুই পদার্থের সঞ্চয়ের ওপর ভিত্তি করেই পডজলকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় যথা হিউমাস পডজল ও আয়রন পডজল। হিউমাস পডজল মাটির B_{2} স্তরে আয়রন অক্সাইড ও হিউমাস সঞ্চিত হয়। আয়রন পডজলের B_{2} স্তরে কেবলমাত্র আয়রন অক্সাইড সঞ্চিত হয়। B_{2} স্তরে হিউমাস ও আয়রন অক্সাইড সঞ্চয়ের ফলে ওই উপাদানগুলি কর্দম কণিকার সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সংবদ্ধ হয় এবং পিন্ড গঠন করে যকে অটস্টিন (Ortstein) বলে। আবার কখনও পাথরের ন্যায় শক্ত আস্তরণ সৃষ্টি হয় যাকে হার্ড প্যান (Hard pan) বলে।
6. C স্তর (C Layer): এই স্তরটি মূল শিলাখণ্ড দ্বারা গঠিত।