আদর্শ মাটি পরিলেখ (Ideal Soil Profile)
মাটি ভূগোলে মাটির প্রোফাইল বা পরিলেখ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাটি গঠনের একটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি হল বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যযুক্ত মাটি স্তরের সৃষ্টি। বিভিন্ন উৎসের জল মাটির মধ্য দিয়ে চুঁইয়ে পড়ার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় মাটির স্তর সৃষ্টি হয়। এই পদ্ধতি স্তরায়ণ পদ্ধতি নামে পরিচিত। মাটির পৃষ্ঠতল থেকে নিম্নস্থ শিলামাতৃকা পর্যন্ত উল্লম্ব প্রস্থচ্ছেদকে মাটির প্রোফাইল (soil profile) বা পরিলেখ বলে।
মাটির বিভিন্ন স্তর (Different Soil Horizon)
কোনো পরিণত মাটিতে সাধারণত প্রধান চারটি স্তর লক্ষ করা যায়, যথা (1) O স্তর বা A_{0} স্তর, (2) A স্তর, (3) ৪ স্তর এবং (4) C স্তর। এই স্তরগুলির মধ্যে ০ বা A_{0} স্তরকে জৈব পদার্থের সঞ্চয় স্তর রূপে পরিগণিত করা হয়। এ স্তরকে এলুভিয়াল স্তর (eluviated horizon) বলে, এই স্তর থেকে ধৌত প্রক্রিয়ায় (leaching) মাটির বিভিন্ন মৌলিক পদার্থ ভূঁইয়ে পড়া জলের সঙ্গে অপসারিত হয় বা ৪ স্তরে সঞ্চিত হয়। ৪ স্তরটিকে ইলুভিয়াল স্তর (illuviated horizon) বলে, কারণ A স্তর থেকে অপসারিত বিভিন্ন মৌলিক ও জৈব পদার্থ এই স্তরে সঞ্চিত হয়। C স্তর প্রকৃত পক্ষে মূল শিলাখণ্ড বা আবহবিকারের ফলে সৃষ্টি হয়।
1. জৈব পদার্থের সঞ্চয় স্তর বা O / A_{0} স্তর (Organic Layer): মাটির সবচেয়ে ওপরে অবস্থিত জৈব পদার্থে সমৃদ্ধ স্তরটি ০ বা A_{0} স্তর নামে পরিচিতস্তর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য অনুসারে নিম্নলিখিত উপস্তরে বিভক্ত।
(i) O_{1} বা A_{0} স্তর ( f*O_{1} or A_{0} Layer): এই স্তরে প্রাণী বা উদ্ভিদের দেহাবশেষ প্রায় অপরিবর্তিত অবস্থায় জমে থাকে। তাই জৈব পদার্থের মূল প্রকৃতি বা উৎস সহজেই জানা যায়। যেহেতু মাটির ওপরে এই স্তর সঞ্চিত হয় তাই এই স্তরের গভীরতা 1 ইঞ্চি থেকে ২ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়। এই স্তরের প্রকৃতি নির্ভর করে সাধারণত স্বাভাবিক উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্যের ওপরে। বনভূমি এই স্তরের মধ্যে অবস্থান করে বলে শুকনো পাতা, উদ্ভিদের অন্যান্য অংশ এবং সেইসঙ্গে তৃণভূমিতে মরে যাওয়া ঘাসের অংশ মিলিতভাবে এখানে জমা হয়।
(ii) O_{2} বা A_{0} স্তর ( O_{2} or A_{0} Layer): O_{1} বা A_{0} স্তরের ঠিক নীচেই O_{2} বা A_{0} স্তর দেখা যায়। এই স্তরের মধ্যে জৈব উপাদানের কিছু অংশ পচে যাওয়া অবস্থায় দেখা যায়, তাই জৈব পদার্থের মূল প্রকৃতি বা উৎস সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করা যায় না। এই স্তরের নীচের অংশে পচে যাওয়া জৈব পদার্থের সঞ্চয় হতে দেখা যায়। বনভূমির মাটিতে এই স্তরটিকে হিউমাস স্তর বলে চিহ্নিত করা হয়। এই স্তরে জৈব পদার্থ বিয়োজিত হয়ে কালো রঙের হিউমাসে পরিণত হয়।
2. A স্তর বা খনিজ স্তর (Mineral layer): A স্তর হল উল্লেখযোগ্য খনিজ পদার্থের স্তর। এই স্তর থেকে ধৌত প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকার সূক্ষ্ম কাদাকণা ও অন্যান্য খনিজ উপাদান নীচের স্তরে অপসারিত হয় বলে একে এলুভিয়াল স্তর (eluvial layer) ও বলে। এই স্তরের গভীরতা জলবায়ুর তারতম্য ভেদে পরিবর্তিত হয়, যেমন মরু অঞ্চলে এই স্তরের গভীরতা 6-8 ইঞ্চি, আর্দ্র-নাতিশীতোয় অঞ্চলে 15-16 ইঞ্চি। এই স্তরকে কয়েকটি উপস্তরে বিভক্ত করা হয়। যেমন:
(i) A_{1} স্তর ( A_{1} Layer): খনিজ স্তর বা A স্তর গোষ্ঠীর সর্বোচ্চে অবস্থিত A_{1} স্তর। এই স্তরের উপরিতলে হিউমাসের প্রভাবে গাঢ় রঙের হয়।
(ii) A_{2} স্তর (A₂ Layer): এই স্তর থেকে বেশিরভাগ কাদাকণা, অ্যালুমিনিয়াম ও আয়রন অক্সাইড অপসারিত হয় বলে এর রং ধূসর বা ছাই রঙের হয়।
(iii) A_{3} স্তর ( A_{3} Layer): A ও B স্তরের মধ্যবর্তী এই স্তর সমস্ত প্রোফাইলে দেখা যায় না। এই স্তরের বৈশিষ্ট্য অনেকটা A_{1} ও A_{2} এর ন্যায় কিন্তু B স্তর থেকে যথেষ্ট আলাদা।
3. B স্তর (B layer): এই স্তরকে ইলুভিয়াল (illuvial layer) বা সঞ্চয় স্তর বলে। A স্তর থেকে ধৌত প্রক্রিয়ায় যে সমস্ত পদার্থ অপসারিত হয় সেগুলির অধিকাংশ ৪ স্তরে সঞ্চিত হতে দেখা যায়। এই স্তরে কাদাকণা, আয়রন ও অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড, ক্যালসিয়াম সালফেট ও অন্যান্য লবণ সঞ্চয় হতে দেখা যায়। এই স্তর কয়েকটি উপস্তরে বিভক্ত, যথা: B_{1}, B_{2} ,B 3 1
(i) B_{1} স্তর (B₁ Layer): A ও B স্তরের মধ্যবর্তী এই স্তরের বৈশিষ্ট্য ৪ স্তরগুলির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ কিন্তু A স্তর থেকে অনেক আলাদা।
(ii) B_{2} স্তর ( B_{2} Layer): এই স্তরেই ৪ স্তর থেকে অপসারিত কাদাকণা আয়রন ও অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড, ক্যালসিয়াম কার্বনেট ও ক্যালসিয়াম সালফেটের সঞ্চয় দেখা যায়। হিউমাসও এই স্তরে সঞ্চিত হয়।
(ii) B) স্তর (B, Layer): এটি একটি পরিবর্তনসূচক স্তর (transitional layer)। এই স্তরের বৈশিষ্ট্য ৪ স্তরের অনেক কাছাকাছি কিন্তু স্তের থেকে আলাদা।
4. Cস্তর বা শিলাখণ্ড স্তর: এই স্তরটির মূল উপাদান হল আবহবিকার সৃষ্ট শিলাখন্ড যা থেকে মাটির উদ্ভব হয়েছে। এজন্য এই স্তরকে মূল শিলাখণ্ডের (parent material) স্তরও বলে। এই স্তরের ঠিক নীচেই অবস্থান করে শিলা মাতৃকা যা থেকে মাটির উদ্ভব হয়।
মাটি প্রোফাইলের A, B ও C স্তরকে একত্রে রেগোলিথ (regolith) বলে। এই স্তরগুলি আবহবিকারের ফলে সৃষ্টি হয়। এই স্তরগুলির উপাদান হল সুক্ষ্ম খনিজ ও অজৈবকণা এবং ছোটো বড়ো প্রস্তর খণ্ড। A ও B স্তরকে একত্রে সোলাম (Solum) বলে। এই স্তরের উপাদান হল সূক্ষ্ম কোমল খনিজ ও জৈবকণা যা প্রকৃত অর্থে মাটি।