বিপর্যয়(Disaster)
সংজ্ঞা ও ধারণা (Definition and Concept)
বিপর্যয় কথাটি ফরাসি শব্দ ডিজাস্টার (desastre) যার অর্থ শয়তান তারা। অতীতে মানুষের ধারণা ছিল যে শয়তান তারার প্রভাবেই প্রকৃতিতে বিপর্যয় নেমে আসে। বিপর্যয় হল দুর্যোগের পরিণতি অর্থাৎ কোনো দুর্যোগ যখন মানবজীবনে প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি করে তখন তাকে বিপর্যয় বলে। বিপর্যয় হল এমন কোনো ঘটনা যার জন্য ক্ষতি হয়, অর্থনৈতিকভাবে বিফরস্তও হতে হয়। বিপর্যয়ের বেশিরভাগটাই হল প্রাকৃতিক যদিও মনুষ্যসৃষ্ট কারণও অনেক ক্ষেত্রে দায়ী। রাষ্ট্রসংঘের হিসেব অনুযায়ী পৃথিবীর শতকরা ৪০ ভাগ বিপর্যয় হল প্রাকৃতিক। পৃথিবীর নানান বিপর্যয়ের ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের বিপর্যায়ের মধ্যে বেশ বড়োসড়ো ফারাক রয়েছে কারণ উন্নয়নশীল দেশগুলি তুলনায় গরিব, বিপর্যয় সামাল দেওয়ার মতো পরিকাঠামো তাদের নেই। সেই কারণে একই বিপর্যয় সমান মাত্রায় আলাদা আলাদ ভাবে দু-জায়গায় ঘটলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হয় দুরকম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO, 2002): বিপর্যয় হল এমন কোনো ঘটনা যার জন্য অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত হতে হয়, মানুষের জীবনহানি ঘটে এবং স্বাস্থ্যের কিংবা স্বাস্থ্য পরিসেবার অবনতি হয়। (2) ওয়েবস্টারস অভিধান (Webstars Dictionary): বিপর্যয় হল এমন কোনো গুরুতর ঘটনা যার পরিণতি হল বিধ্বংসী (a grave occurrence having ruinous results) (3) রাষ্ট্রসংঘ (United Nation) অন্তত এক মিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পত্তির ক্ষতি এবং কমপক্ষে 100 জন হবে এবং রাষ্ট্রে জরুরি অবস্থা জারি হলে তাকে বিপর্যয় বলে। (4) জন উইটো (John Whittow, 1980) বিপর্যায় হল দুর্যোগের পরিণতি। বিপর্যয়ে জীবন ও সম্পত্তিহানি হবে এবং যার ফলে সমাজ বা তুলনামূলকভাবে সংযত অঞ্চল অচল হয়ে যায়।।
বিপর্যয়ের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Disaster)
1. বিপর্যয়ের ফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটে। এই ব্যাঘাত হতে পারে অপ্রত্যাশিত, ব্যাপকতর অথবা দ্রুত বা ধীরগতিসম্পন্ন।
2. বিপর্যয় মানুষের জীবন, জীবনযাত্রা ও সম্পদের ওপর প্রভাব ফেলে, পাশাপাশি স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আঘাত হানে।
3.বিপর্যয় ধ্বংস হয়ে যায় সামাজিক কাঠামো তথা ঘরবাড়ি, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অত্যাবশ্যক পরিসেবাগুলি।
4. বিপর্যয় অবস্থায় সমাজের প্রয়োজন হয়ে পড়ে খাদ্য, অশ্রয়, স্যানিটেশন, চিকিৎসা, বস্ত্র ও সামাজিক পরিচর্যা। এজন্য দূর্গত স্থানে বাইরের সাহায্যের প্রয়োজন হয়।
5. যে-কোনো বিপর্যয়ের সংঘাতমাত্রা বা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ভর করবে 'আঘাত কেন্দ্র' সাল থেকে মানুষের বসবাস অঞ্চলের দূরত্ব এবং আঞ্চলিক ভূপ্রকৃতিগত চরিত্রের ওপর।
বিপর্যয়ের শ্রেণিবিভাগ (Classification of Disaster)
পরিবেশে বিপর্যয় সাধারণত তিনভাবে ঘটতে পারে-
(i) প্রাকৃতিক বিপর্যয় (Natural disaster): ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, সুনামি প্রভৃতি বিপর্যয়। কেবলমাত্র প্রাকৃতিক কারণেই সৃষ্টি হয়ে থাকে। এগুলির ওপর মানুষের কোনো হাত নেই। মানুষ এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কাছে অসহায়।
ii) আধা প্রাকৃতিক বিপর্যয় (Quasi-Natural disaster): বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ, দাবানল, ভূমিকম্প ইত্যাদি বিপর্যয় কার্যকলাপের ফলে নদীর খাত মজে যাবার কারণে বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। শুদ্ধ, আধা-শুদ্ধ অঞ্চলে এমনকি আর্দ্র অঞ্চলেও অবৈজ্ঞানিকভাবে জলসম্পদ ও ভূমির ব্যবহার খরা ডেকে আনতে পারে। দুর্ভিক্ষ, দাবানলের প্রসঙ্গো এই একই কথা বলা যায়। পার্বত্য ঢালে অবৈজ্ঞানিকভাবে কৃষিকার্য বা নগরায়ণের ফলে ভূমিধসের প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। কাজেই এগুলি আধা-প্রাকৃতিক বিপর্যয় (quasi-natural disaster)
(iii) মনুষ্যকৃত বিপর্যয় (Manmade disaster): যদি কোনো অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রচুর সম্পদ ও জীবনহানি হয় এবং জঙ্গিগোষ্ঠী বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কোনো এলাকাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে, অথবা যুদ্ধের সময় বিরোধী এলাকায় বোমা, রকেট ইত্যাদির সাহায্যে এলাকাটি শ্মশান করে দেওয়া হয় কিংবা যদি বিষাক্ত রাসায়নিক বা মারণরোগের জীবাণু ছড়িয়ে দিয়ে প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়, তবে এইসব বিপর্যয় সাধনে প্রকৃতির কোনো হাত থাকে না। এইসব বিপর্যয় হল মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয়। যেমন-1984-এর ভুপাল গ্যাস দুৰ্ঘটনা।