বায়ুমণ্ডলের উপাদানসমূহের তারতম্য(Variation of Atmospheric Composition)
অক্ষাংশ ও ঋতু অনুযায়ী পরিবর্তন (Variation according to Latitude and Season)
অক্ষাংশ (latitude) ও ঋতু (season) অনুযায়ী বায়ুমণ্ডলের উপাদানগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন লক্ষ করা যায় কার্বন ডাই-অক্সাইড (C*O_{2}) জলীয় বাষ্প (H_{2}*O) এবং ওজোন গ্যাসের (O_{3}) বণ্টনে।
উত্তর গোলার্ধে 30 ^ 0 অক্ষাংশের ঊর্ধ্বে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের ঋতুকালীন চরম বৈষম্য লক্ষ করা যায়। এপ্রিল (April) থেকে সেপ্টেম্বর (September) উত্তর গোলার্ধে উদ্ভিদের পাতা ফুল-কুঁড়ির সংখ্যার আধিক্য দেখা যায় ফলে সালোকসংশ্লেষের পরিমাণ বাড়ে এবং বায়ুমন্ডলের কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমে। ঐ অঞ্চলে (উত্তর গোলার্ধের 30° ঊর্ধ্ব অংশ) গ্রীষ্মকালে বায়ুমন্ডলে প্রায় গড়ে ও শতাংশ O ^ 2 কমে। আবার শীতকালে এই মাত্র বাড়ে। তথ্য বলে 500 উত্তর অক্ষাংশে এই মাত্রা গ্রীষ্মকালের 310 ppm থেকে বেড়ে শীতকালে 318 ppm-এ দাঁড়ায়। তাছাড়া ঐ অঞ্চল কিংবা আরও উচ্চ অক্ষাংশে শীতল সমুদ্র স্রোত (cold ocean current) বায়ুমণ্ডলের C*O_{2} - কে শোষণ করে মাত্রা আরও কমিয়ে দেয়। দক্ষিণ গোলার্ধের উচ্চ অক্ষাংশে স্থলভাগ তথা উদ্ভিদের পরিমাণ কম থাকার কারণে এই বৈষম্য তত পরিলক্ষিত হয় না। নিরক্ষীয় অঞ্চলে বায়ুমণ্ডলে ওজোন গ্যাসের পরিমাণ উচ্চ অক্ষাংশের তুলনায় কিছু কম হয়। উচ্চ অক্ষাংশে সারা বছর ওজোন গ্যাসের পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রায় থাকলেও বসন্তে কিংবা শীতের শেষে সবচেয়ে বেশি থাকে। এর কারণ সম্বন্ধে বিজ্ঞানীরা একমত হতে না পারলেও একথা বলা যায় বিশেষ কোনো প্রক্রিয়ায় নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে মের অঞ্চলে ওজোন গ্যাসের স্থানান্তর এক নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। এই স্থানান্তর সাধারণত নিম্ন অক্ষাংশের উচ্চ স্থান (35-40 কিমি) থেকে উচ্চ অক্ষাংশের তুলনামূলক কম উচ্চতায় (20-25 কিমি) ঘটে।
বায়ুমণ্ডলের জলীয় বাষ্পের সাথে তাপমাত্রার সম্পর্ক গভীর। উদ্বুতা বাড়লে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বাড়ে (বাষ্পীভবনের হার বাড়ার কারণে)। তাই গ্রীষ্মকালে শীতকালের তুলনায় বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি থাকে। অন্যদিকে নিম্ন অক্ষাংশ অধিক উয়, তাই ঐ অংশে জলীয় বাষ্পও অধিক। উচ্চ অক্ষাংশে ঠিক উল্টো অবস্থা।
সময় অনুযায়ী তারতম্য (Variation According to Time)
দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে বায়ুমণ্ডলে কিছু কিছু উপাদানের পরিবর্তন হয়। কার্বন ডাই-অক্সাইড (C*O_{2}) ওজোন (O_{3}) কিংবা বাতাসে ভাসমান কণার (dust particals) উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। বায়ুমণ্ডলে (C*O_{2}) -এর পরিমাণ নির্ভর করে ভৌত পরিবেশ থেকে জীব পরিবেশে C*O_{2} এর আত্তীকরণ বা জোগান (imput) এবং জীব পরিবেশ থেকে ভৌত পরিবেশে C*O_{2} এর নির্গমনের (output) মধ্যে সুষম আন্তঃক্রিয়ার ওপর। কিন্তু মানুষের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের ফলে C*O_{2} এর উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং O_{2} জোগান ক্রমশ কমে যাচ্ছে। ফলে বায়ুমন্ডলের সঞ্চিত C*O_{2} - এর পরিমাণ উত্তরোত্তর বাড়ছে। হিসাব অনুযায়ী গত 1870 থেকে 2008 পর্যন্ত পৃথিবীর মোট C*O_{2} 25 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় 14 * 10 ^ 12 কেজি C*O_{2} বায়ুমণ্ডলে যুক্ত হচ্ছে। ভূগর্ভে সঞ্চিত কার্বন সমৃদ্ধ যৌগ যেমন কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোলিয়াম প্রভৃতি জীবাশ্ম জ্বালানির (fossil fuel) ক্রমবর্ধমান ব্যবহার এবং ক্রমাগত অরণ্যনিধন (deforestation) এবং সবুজ আচ্ছাদনের অবলুপ্তি এর জন্য দায়ী।
বর্তমানে বাতাসে সূক্ষ্ম কণা তথা অ্যারোসলের (aerosols) পরিমাণও ক্রমাগত বেড়ে চলছে। এর একটি কারণ প্রাকৃতিক হলে অন্যটি অবশ্যই মনুষ্যসৃষ্ট। সক্রিয় আগ্নেগিরির অগ্ন্যুদ্গমে নিক্ষিপ্ত পদার্থ বা কণাসমূহ নিয়মিতভাবে বায়ুমণ্ডলে ধূলিকণার পরিমাণ বাড়িয়ে চলেছে। তাছাড়া মানুষের ক্রমাগত কার্যকলাপে সালফেট-এর কণা, মৃত্তিকা কণা বাতাসে যুক্ত হচ্ছে। মনুষ্যসৃষ্ট অন্যান্য উৎসগুলি হল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র (thermal power station), খনিজ উত্তোলন, খনিজ নিষ্কাশন, প্রস্তর বিচুর্ণীভবন ইত্যাদি। মনে রাখা দরকার বাতাসে সৃষ্ট ও মনুষ্যসৃষ্ট কণাদূষণের মাত্রা প্রায় কাছাকাছি।
বায়ুমণ্ডলের 15 থেকে 35 কিমির মধ্যে সৌরকিরণের অতিবেগুনি রশ্মির সাথে অক্সিজেনের বিক্রিয়ায় ওজোন স্তরের সৃষ্টি। তাই এই অতিবেগুনি রশ্মির তারতম্যের ফলে বায়ুমণ্ডলে ওজোন গ্যাসের তারতম্য হতে পারে। তাছাড়া মনুষ্যকৃত নানান কাজকর্মের ফলে বিভিন্ন বায়ুদূষক (যেমন CFC-ক্লোরোফ্লুরোকার্বন) ওজোনের সাথে অনুঘটকীয় (catalist) রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ওজোন স্তর ক্ষয় করে দিয়েছে কিংবা দিচ্ছে। তাতে ভূপৃষ্ঠে অতিবেগুনি রশ্মির আপতন বাড়ছে, জীবমণ্ডল হচ্ছে বিপন্ন।
উচ্চতা অনুসারে তারতম্য (Variation According to Height): উচ্চতা অনুসারে বায়ুমণ্ডলের নির্মম অংশে যাদের তারতম লক্ষ্মী ও তাদের মধ্যে জলীয় বাষ্প এবং ওজোন গ্যাস অন্যতম।
ভূপৃষ্ঠের উপরে প্রায় 10 কিমি পর্যন্ত জলীয় বাষ্পের অস্তিত্ব বর্তমান। ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুস্তরে এর পরিমাণ সর্বাধিক। কারণ এই জলীয় বাষ্পের উৎস জলাশয়ের বাষ্পীভবন (evaporation) কিংবা উদ্ভিদের বাষ্পমোচন (transpiration)প্রক্রিয়া। উর্ধ্বগামী বায়ুর পরিচলন স্রোত (convectional current বায়ুর তুলনায় হালকা এই জলীয় বাষ্পকে সর্বাধিক 10 কিমি পর্যন্ত বহন করে, তাছাড়া তাপমাত্র বাড়লে বায়ুর জলীয় বাষ্পের ধারণ ক্ষমতা বেড়ে যায়। সেই দিক দিয়ে দেখলে ট্রপোস্ফিয়ারের উর্ধ্বস্তরে তাপমাত্রা কম, তাই জলীয় বাষ্পের ঘনত্বও কম। অপরদিকে ভূপৃষ্ঠে অধিক তাপমাত্রার জন্য জলীয় বাষ্পের ঘনত্বও অধিক।
বায়ুমণ্ডলে ওজোন গ্যাসের (O_{3}) ঘনত্ব সর্বাধিক 15-35 কিমির মধ্যে, যদিও 60 কিমি পর্যন্ত ওজোন গ্যাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ওজোন গ্যাস তৈরি হয় অক্সিজেন অণুর (O_{2}) সঙ্গে জায়মান অক্সিজেন (০)-এর বিক্রিয়ায়। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি (ultra violet ray) অক্সিজেন অণুকে ভেঙে এই জায়মান অক্সিজেন তৈরি করে। ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলে (80-100 কিমি) বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব কম থাকায় অক্সিজেন পরমাণু (০) অক্সিজেন অণুর (O_{2}) সাথে যুক্ত হতে পারে না। তাই ঐ অঞ্চলে ওজোন গ্যাস পাওয়া যায় না। অপরপক্ষে 30 কিমির নীচে অতিবেগুনি রশ্মির (ultra violet ray) পরিমাণ খুবই কমে যায় বলে ওজোন গ্যাস তৈরি হতে পারে না। সুতরাং বায়ুমণ্ডলের (30-60) কিমি অঞ্চলই ওজোন গ্যাসের আদর্শ জায়গা।
বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন কণা বা অ্যারোসলও (aerosols) উচ্চতার সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। যেহেতু অ্যারোসলের অধিকাংশের উৎপত্তি মানুষের বিভিন্ন কার্যকলাপের (human activity) দ্বারা, তাই স্বাভাবিকভাবে ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন অংশেই অ্যারোসলের মাত্রা বেশি থাকে। শহরাঞ্চলের উর্ধ্বে এই মাত্রা আরও অধিক হয়। যে অঞ্চলে নিয়মিত বৃষ্টিপাত হয় সেখানে অ্যারোসলগুলি বৃষ্টিপাতের সঙ্গে ভূপৃষ্ঠে পতিত হয় এবং তাই বৃষ্টিপাতের পর এই মাত্রা অনেক কমে যায়। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত অঞ্চলে (volcanic region) কিংবা মরুভূমি অঞ্চলে (desert region) বাতাসে অ্যারোসলের পরিমাণ অধিক।