ভূমিরূপ পরিবর্তনে মানুষের ভূমিকা(Role of Man on Changing Landforms)
ভূমিরূপ একটি গতিশীল বিষয়। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভূমিরূপের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। এই পরিবর্তনে প্রধান ভূমিকা বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির থাকলেও মানুষের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। মানুষ বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপে ভূপ্রাকৃতিক পদ্ধতিকে যেমন ত্বরান্বিত করতে পারে তেমনি ভূমির আকার-আকৃতিতেও প্রভাব বিস্তার করতে পারে। যাইহোক, মানুষের প্রধান কয়েকটি প্রভাব আলোচিত হল
1. ভূমিরূপের সঠিক অধ্যায়ন করলে তার উৎপত্তি এবং তার মধ্যে খনিজের অবস্থান জানা যায়। খনিজের অবস্থা চিহ্নিত করতে পারলে মাইনিং (mining)। ক্রিয়াকলাপ বৃদ্ধি পাবে। তাতে ভূমিরূপের ব্যাপক পরিবর্তন হয়।
2. কাস্ট ভূমিরূপ অঞ্চলে রাস্তা তৈরি করলে যে কোনো সময় বিপদ হতে পারে। কিংবা ঘন ঘন ব্রীজ বানাতে হতে পারে। তাতে ভূমির ব্যাপক পরিবর্তন হবে।
3. নদীবাঁধ ও জলাধার তৈরিতে ভূমিরূপ অনেকখানি পরিবর্তিত। হয়। নদী উপত্যকার সংকীর্ণ অংশে যেখানে তলদেশের শিলা কঠিন সেখানে বাঁধ নির্মাণ সহজযোগ্য।
4. ধসপ্রবণ অঞ্চলে রাস্তাঘাট প্রায়শই ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এসব অঞ্চলে খাড়াই ঢাল বরাবর সমস্তরকম নির্মাণকার্য বন্ধ করা জরুরি। তার জন্য মানুষের সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
5. কোনো ভূমিরূপের বৈশিষ্ট্য তার ঢালের পরিমাণ ও ঢালের দিকের উপর নির্ভর করে। মানুষ নানাবিধ ক্রিয়াকলাপে এই ঢাল প্রায়শই পরিবর্তন করে। ফলে ভূমিরূপের চরিত্রও পাল্টে যায়।
6. ছোটো ঘাস থেকে বড়ো উদ্ভিদ সবই ভূমির আবরণ হিসাবে কাজ করে। তাই ঘন অরণ্যে আবৃত পাহাড়ি ঢালেও ক্ষয় অনেক কম। কিন্তু পাহাড়ি অঞ্চলে বসতি স্থাপন, রাস্তা নির্মাণ কিংবা কৃষি জমি তৈরির লক্ষ্যে প্রায়শই ঢালকে উন্মুক্ত হতে হয়। কিংবা বনভূমি নিশ্চিহ্ন করে মাটিকে আলগা করে দিতে হয়। এতে ভূমিক্ষয় কয়েকগুণ বেড়ে যায় এবং জলপ্রবাহের হার ও দিক পরিবর্তিত হয়। তাতে ভূমি বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
7. নদীতে বাঁধ দিয়ে জলাধার নির্মাণ করলে নদীর দু-তীরের ক্ষয়ের শেষ সীমা অনেক উঁচু হয়ে যায়। ফলে স্পার ও শৈলশিরাগুলির আকৃতির পরিবর্তন হয়। অনেক সময় স্পারগুলি গোলাকার বা চ্যাপটা ধরনের হয়। এসব ক্ষেত্রে ক্রমশ গালি (gully) ক্ষার কমে যায়।
৪. ল্যাটেরাইট অঞ্চলে পাত ক্ষয় (sheet erosion) বেশি। বৃষ্টিপাত ক্রমশ কমতে থাকলে কিংবা সমগ্র অঞ্চলটি উদ্ভিদশূন্য হলে পাতক্ষয় ক্রমশ কঠিন ভূমিকে অল্প-অল্প ক্ষয় করে তরঙ্গায়িত ভূমিতে পরিণত করবে। পরবর্তী বর্ষায় এই ভূমির উপর নতুন রিল (rill) বা গালি (gully) তৈরি হবে যা অচিরেই ভূমিভাগকে ব্যবচ্ছিন্ন করবে। চূড়ান্ত পর্যায়ে ল্যাটেরাইট স্তর মূল শিলা থেকে আলাদা হয়ে অপসারিত হয় এবং মূল শিলা মেসা বা বিউট আকারে দাঁড়িয়ে থাকে। তাই ল্যাটেরাইট অঞ্চলে ভূমি ব্যবহারে যথেষ্ট সতর্ক থাকা জরুরি।
GLOSSARY
1. এনট্রেনমেন্ট বেগ (Entrainment Velocity): শিলা কণা উত্তোলন বা এনট্রেনমেন্ট কত হবে তা নির্দিষ্ট কতকগুলি নিয়ন্ত্রকের উপর নির্ভর করে। শিলা কণার আকার এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক। শিলা কণার আকার যত ক্ষুদ্র হবে। এনট্রেনমেন্ট প্রতিরোধ ক্ষমতা তত বেশি হবে। অর্থাৎ শিলা কণার উত্তোলনের হার তত কম হবে। এনট্রেনমেন্ট গতির উপর অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ বল-(1) অভিকর্ষ বল এবং (2) সমন্বয় বা কোহেসিভ বল।
2. কোহেশান ফোর্স বা সমন্বয় বল (Cohesion Force): কোহেশান বল হল শিলা মাটির সিয়ার শক্তির (Sier) উপাদান থেকে সৃষ্ট। এটি শিলার আন্তঃকণা ঘর্ষণ আলাদা এই বল মাটি বা শিলার কণাগুলিকে একে অপরের সঙ্গে ধরে রাখতে সক্ষম হয়। কোনো অঞ্চলের কোনো শিলার এনট্রেনমেন্ট বা উত্তোলন কতটা হবে তা কোহেসিভ বলের উপর নির্ভর করে। যে সকল শিলার কোহেসিভবল দুর্বল হয় তার এনট্রেনমেন্ট হারও বেশি হয়।
3. দ্রাব্যতা (Solubility): দ্রাব্যতা বা দ্রবণীয়তা হল পদার্থের এক ধর্ম। দ্রবণীয়তা হল একটি কঠিন, তরল বা বায়বীয় রাসায়নিক পদার্থের দ্রাবক দ্রবীভূত করার এবং একটি দ্রবণ তৈরি করার ক্ষমতা। দ্রবণীয়তা দ্রাবক কণার আকার, আলোড়ন, তাপমাত্রা ও চাপের উপর নির্ভর করে। যে সমস্ত শিলা যত দ্রাব্য অর্থাৎ দ্রাবকের সংস্পর্শে এসে নিজের আকার হারিয়ে ফেলে বা দ্রাবকে মিশে যায়, সেই সমস্ত শিলা তত দ্রুত ক্ষয় হয়ে পলি তৈরি করে কিংবা ভূমিরূপ গঠন করে। চুনাপাথর বা ডলোমাইট শিলার দ্রাব্যতা বেশি।
4. প্রবেশ্যতা (Permeability): ভূমিরূপ বা পলি তৈরির ক্ষেত্রে শিলা বা মাটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল প্রবেশ্যতা। প্রবেশ্যতা হল মাটির মধ্যের আন্তঃসংযুক্ত ছিদ্রের মাধ্যমে জল চলাচলের হার। মাটি যত বেশি ছিদ্রযুক্ত হবে, তার প্রবেশ্যতা তত বেশি হবে যদি ছিদ্রগুলি পরস্পর ছিদ্রযুক্ত হয়। সচ্ছিদ্রতা জল ধরে রাখার ক্ষমতাকে বোঝায়, আর প্রবেশ্যতা কত দ্রুত এক বিন্দু থেকে অন্য বিন্দুতে জল যেতে পারে সেই ক্ষমতাকে বোঝায়। প্রবেশ্যতা শিলাকণার আকারের উপর নির্ভর করে। নুড়ি পাথরের কোনো শিলার ছিদ্রগুলি একে অপরের সাথে ভালোভাবে সংযুক্ত থাকে, তাই প্রবেশ্যতা বেশি। আবার অন্য দিকে কাদাপাথরের দানাগুলি সূক্ষ্ম। তাই বেশির ভাগ ছিদ্রগুলি অবরুদ্ধ থাকে। যার অর্থ জল সহজে প্রবাহিত হতে পারে না।
5. সচ্ছিদ্রতা (Porosity): শিলা, মাটি বা খনিজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সচ্ছিদ্রতা। সচ্ছিদ্রতা বলতে শিলা বা মাটির উপাদানগুলির মধ্যেকার ক্ষুদ্র বা সূক্ষ্ম ফাঁককে বোঝায়। এই সচ্ছিদ্রতা উপাদানগুলির বা কণাগুলির আকৃতি, আকার, গঠন ও সংঘবদ্ধতার উপর নির্ভর করে। সচ্ছিদ্রতার পরিমাণ বা আকার বেশি বা বড়ো হলে জল ও বায়ু বেশি পরিমাণ থাকবে, ফলে ক্ষয় প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হবে। অর্থাৎ শিলা বা মাটি দ্রুত ক্ষয় হবে এবং নতুন ভূমিরূপ তৈরি হবে।
6. হিমবাহের এনট্রেনমেন্ট (Glasiar Entrainment): নদীর উপর শিলা কণার উত্তোলনে হিমবাহের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। হিমবাহ অধ্যুষিত অঞ্চলের ঢাল হিমবাহের আকার, ভূমিভাগের শিলার বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি এক্ষেত্রে এনট্রেনমেন্টের হারকে নিয়ন্ত্রণ করে। হিমবাহ গলা জল যার থেকে নদী সৃষ্টি হয় তা-ও অনেক সময় হিমবাহের সঙ্গো একত্রে পলি উত্তোলনে অংশগ্রহণ করে। এর ফলে এনট্রেনমেন্ট প্রক্রিয়া দ্রুততর হয়।