বায়ুমণ্ডলের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য(Nature and Characteristics of Atmosphere)
পৃথিবীর অন্য দুই মন্ডলের মতো বায়ুমণ্ডল অন্যতম। বায়ুমণ্ডল সমগ্র জীবমণ্ডলের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পৃথিবী পৃষ্ঠের উপরে বহুদূর বিস্তৃত বায়বীয় আবরণ হল বায়ুমণ্ডল। বায়ুমণ্ডলের প্রকৃতি ও গঠন বৈচিত্র্যপূর্ণ। এই মণ্ডলকে বিভিন্ন আবহবিদ উদ্ভুতা ও উপাদানের তারতম্যের ভিত্তিতে যে ভাগগুলি করেছেন, সেই ভাগগুলির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট। ও চরিত্র লক্ষ করা যায়। বায়ুমণ্ডলের গঠন বৈচিত্র্য কোনো অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যকে প্রভাবিত করে। ভূগোল পাঠের ক্ষেত্রে বায়ুমণ্ডলের গুরুত্ব অপরিসীম।
প্রকৃতি (Nature)
আমাদের প্রিয় গ্রহ পৃথিবীকে চারদিক দিয়ে আগলে রেখেছে প্রায় কয়েক হাজার কিমি চওড়া গ্যাসীয় আবরণ। এই বায়ুমণ্ডল বিভিন্ন কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় পদার্থ নিয়ে গঠিত। যা মহাকর্ষের টানে ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে আবদ্ধ রয়েছে। পৃথিবীর ব্যাসার্ধের তুলনায় বায়ুমণ্ডলের পুরুত্ব খুবই পাতলা। এই পৃথিবীর তিন মণ্ডল তথা শিলামণ্ডল, বারিমণ্ডল এবং বায়ুমণ্ডলের মধ্যে যেসব পরিবেশ রয়েছে তাদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক লক্ষ করা যায়। সেই সঙ্গে একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। আবার তাদের উপাদানগুলির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। বিশাল বায়ুরাশির নীচে রয়েছে শিলামণ্ডল ও বারিমণ্ডল। আবার বারিমন্ডলের নীচে রয়েছে শিলামণ্ডল। তাই পৃথিবীর ভূ-অভ্যন্তর ভাগে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনার দ্বারা ভূপৃষ্ঠে পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। সেইসঙ্গে বারিমণ্ডল বায়ুমণ্ডলের চরিত্র বদলাচ্ছে।
আজ থেকে প্রায় 35 কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীতে স্বাভাবিক উদ্ভিদের একটি ঘন আবরণ সৃষ্টি হওয়ার পরে এই বায়ুমণ্ডলের সৃষ্টি হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। মহাকর্ষ বলের জন্য বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর কাছাকাছি আছে। সেই সঙ্গে পৃথিবীর জীবজগতের কাছে বায়ুমণ্ডলের একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে, তার কারণ প্রাণী এবং উদ্ভিদের একান্ত প্রয়োজনীয় জল ও বাতাস সরবরাহ করা ছাড়াও সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে এদের রক্ষা করে। এই বায়ুমণ্ডলের উল্লম্ব বিস্তার পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় 10000 কিমি. পর্যন্ত। বায়ুমন্ডলের নিম্নস্তর সম্বন্ধে আমরা যতটা নিখুঁত জানতে পারি, কিন্তু উপরের স্তর সম্বন্ধে ততটা খুঁজে পাইনি। এই অংশ মূলত একটি চৌম্বকীয় ক্ষেত্র এবং তড়িতাবিষ্ট কণিকার স্তর।
বৈশিষ্ট্য (Characteristics)
চাপ ও ঘনত্ব (Pressure and Density): বায়ুমণ্ডলে অবস্থানরত প্রধান উপাদান হল বায়ু এবং এই বায়ুর নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বায়ু সাধারণত বর্ণ, গন্ধ এবং স্বাদহীন। আবার বায়ু সচল ও স্থিতিস্থাপক প্রকৃতির। সেই সঙ্গে এর সংকোচন ও প্রসারণশীল ধর্ম রয়েছে। যদি এই বায়ুর অনুভূমিক প্রবাহ না থাকে, তাহলে আমরা এর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি না। বায়ুর অনুভূমিক প্রবাহকে বায়ুপ্রবাহ বলে। কঠিন এবং তরল পদার্থের মতো বায়ুরও ঘনত্ব রয়েছে এবং এই ঘনত্ব বেশি না। সেইসঙ্গে বায়ুর ওজন রয়েছে। কোনো পৃষ্ঠদেশে বায়ু যে চাপ দেয় তাকে বায়ুমণ্ডলীয় চাপ বলে। বায়ুচাপ হল জলবায়ুর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বায়ুর ঘনত্ব বায়ুচাপকে প্রভাবিত করে। সমুদ্রপৃষ্ঠে বায়ুর ঘনত্ব ও বায়ুচাপ সবচেয়ে বেশি। ঘনত্ব প্রায় প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে 14.7 পাউন্ড এবং চাপ 3.2 মিলিবার। বায়ুর উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওজন ও চাপ দুই-ই কমতে থাকে। বায়ুমণ্ডলের মোট পরিমাণের প্রায় 50 শতাংশ নিম্নবায়ুমণ্ডল তথা 5.5 কিমি. উচ্চতার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। আবার 99 শতাংশ 30 কিমির মধ্যে অবস্থান করে। আবার অনেক আবহবিদদের মতে বায়ুমণ্ডলে 97 ভাগ পদার্থ ভূপৃষ্ঠ থেকে 30 কিমির মধ্যে অবস্থান করছে। বায়ুমণ্ডলের নীচের স্তর (ভূপৃষ্ঠ থেকে 100 কিমি.) আবহাওয়াবিদ্যার (metereology) অন্তর্গত এবং উপরের স্তর (100 কিমি. বেশি) এ্যারোনমি (aeronomy) বিদ্যার অন্তর্ভুক্ত।
বায়ুমণ্ডল পৃথিবীপৃষ্ঠকে আগলে রেখেছে চাদরের ন্যায়, যেমন দিনের বেলায় সূর্যের প্রচন্ড তাপকে রক্ষা করে আবার রাতে অত্যধিক তাপ হ্রাস থেকে রক্ষা করে চলেছে। সূর্যরশ্মি বায়ুমণ্ডলের দ্বারা ক্ষুদ্র তরঙ্গঙ্গদৈর্ঘ্য রূপে ভূপৃষ্ঠে পতিত হয় এবং দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্য রূপে ভূপৃষ্ঠ থেকে মহাকাশে বিকিরিত হয়। এই সময় বায়ুর অনেক উপাদান সূর্যরশ্মিকে শোষণ করে তাপ সঞ্চয় করে রাখে। ফলস্বরূপ ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয়। বায়ুমণ্ডল ছাড়া পৃথিবী পৃষ্ঠ অতিশীতল মরুভূমিতে পরিণত হত।
বিবর্তন (Evolution): বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের মতে বায়ুমণ্ডলের উৎপত্তি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, দীর্ঘদিন ধরে কোটি কোটি বছর ধরে বিভিন্ন বিবর্তনকারী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এর উদ্ভব। এই মন্ডলের গঠন পূর্বেকার গঠনের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। পৃথিবীর জন্মের পরবর্তী সময় থেকে এর গঠন ক্রমশ পাল্টাতে শুরু করে। পৃথিবীর উৎপত্তির আদি সময়ে অভিকর্ষ শক্তি কম হওয়ার কারণে হালকা গ্যাসগুলি বায়ুমন্ডলের উপরের দিকে স্তরে স্তরে সঞ্চিত হয়েছে। পৃথিবীর সৃষ্টির সময়কাল থেকে বহু বছর ধরে বিভিন্ন বিবর্তনের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্যাসের অনুপাতের তারতম্য লক্ষ করা গেছে। মহাজাগতিক (cosmic) গ্যাসগুলি থেকে এই গ্রহ সৃষ্টি আদি পর্বে, সৌর ও মহাকর্ষের প্রভাবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্যাসের সৃষ্টি ও ধ্বংস হয়েছিল। বর্তমান বায়ুমণ্ডলে যে গ্যাসগুলি বিরাজমান সেই গ্যাসগুলি পৃথিবীর সৃষ্টি সময় ছিল না বললে চলে। পরবর্তী সময়ে উদ্বু প্রস্রবণ (hot spring), আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, পদার্থের রাসায়নিক বিয়োজন এবং জীবজগত থেকে পাওয়া বস্তুগুলির বিক্রিয়ার ফলে সৃষ্টি হয়েছে গ্যাসসমূহ। মানুষের কার্যাবলির প্রভাবে বর্তমানে বহু গ্যাসের উদ্ভব হয়েছে এই বায়ুমণ্ডলে। ভূতাত্ত্বিক সময় সারণির কিছু প্রমাণ থেকে জানা যায় যে, প্রায় 600 মিলিয়ন বছর আগের ক্যামাবি য়ান যুগের বায়ুমণ্ডলে স্থিতিশীলতা এসেছিল।
তাপমাত্রা (Temperature): সৃষ্টির সময় পৃথিবী ছিল জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ড, তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৪000° সেঃ-এর বেশি। যা পরবর্তী সময়ে দীর্ঘকাল ধরে ধীরে ধীরে শীতল ও কঠিন অবস্থায় এসেছে। সেই সময় বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্প, কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন যাদের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে 60-70%, 10-15% এবং 8-10%। যা অগ্নিপিন্ড থেকে গ্যাস মোচনের মাধ্যমে পাওয়া গেছে। তাপ বিকিরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে শীতল হয়ে বায়ুমণ্ডলের জলীয় বাষ্প শীতল ও ঘনীভূত হয়ে মেঘ ও বৃষ্টিরূপে পতিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে বাষ্পীভবন, ঘনীভবন এবং অধঃক্ষেপণ প্রক্রিয়া চলতে থাকে।
বৃষ্টিপাত (Rainfall): অনেকের ধারণা হয় যে, সুদীর্ঘকাল (প্রায় ৪0000 বছর) ধরে বায়ুমণ্ডল ঘন মেঘে ঢাকা ছিল এবং ঘনীভবন ও অধঃক্ষেপণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বৃষ্টিপাত হত। এই প্রবল বৃষ্টির জলের দ্বারা সাগর, মহাসাগর প্রভৃতির সৃষ্টি হয়। এই বৃষ্টির জল CO₂ বয়ে এনে পৃথিবী পৃষ্ঠে কার্বনেট শিলার জন্ম দেয়। কিন্তু বায়ুমণ্ডলে O₂ না থাকায় জীবের অস্তিত্ব ছিল না। সর্বপ্রথম প্রাণ দেখা যায় জলভাগে এবং উদ্ভিদ দেখা যায় স্থলভাগে। পরবর্তী সময়ে উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বায়ুমণ্ডলে CO₂ হ্রাস পায়। আবার CO₂ দ্রবীভূত হয়ে জলে চুনের সঞ্চয় লক্ষ করা যায়। বহু লক্ষ বছর ধরে এই অবস্থা চলতে থাকে এবং 35 কোটি বছর আগে বায়ুমণ্ডল বর্তমান অবস্থায় পৌঁছায়।
অক্সিজেন (Oxygen): বায়ুমন্ডলের উপত্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের মতামত- যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করা হলেও একটি প্রশ্ন থেকে যায়, "যা হল মুক্ত অক্সিজেনের উৎপত্তি। অনেকে মনে করেন বায়ুমণ্ডল সৃষ্টির অনেক পরে অক্সিজেনের সৃষ্টি হয়েছে। তাঁদের মতে জলীয় বাষ্প পরিচলন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উপরে উঠে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি দ্বারা বিভাজিত হয়ে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন তৈরি করে। কিন্তু হাইড্রোজেন হালকা গ্যাস বলে বায়ুমণ্ডল থেকে বেরিয়ে যায় এবং অক্সিজেনের পরমাণুগুলি ভারী বলে বায়ুমন্ডলে পড়ে থেকে পরবর্তী সময়ে আণবিক অক্সিজেন গঠন করে। মুক্ত অক্সিজেনের কিছু অংশ এইভাবে গঠিত হলে সম্পূর্ণ অক্সিজেন এইভাবে তৈরি হয়নি। অন্যান্য বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী বলা যায় যে, বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের প্রধান উৎস হল সমস্ত উদ্ভিদ সম্প্রদায়। এই উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সূর্যালোককে কাজে লাগিয়ে H₂O এবং CO₂-কে জৈব পদার্থে পরিণত করার সময় অক্সিজেনের উৎপত্তি ঘটায়। কিন্তু এখানে প্রশ্ন জাগে যে বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন সৃষ্টির আগে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকা আবশ্যক। আবার কিছু বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে বিশ্বে সর্বপ্রথম কিছু ব্যাক্টেরিয়া জন্ম নেয়। যাদের পক্ষে অক্সিজেন ছাড়া কোনোভাবে বাঁচা সম্ভব নয়। তারপর সামান্য প্রাচীন সবুজ উদ্ভিদ জন্ম নেয় যারা বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়াতে থাকে।
পরিশেষে বলা যায় যে, পুরাজীবিও যুগের শুরুতে মহাসমুদ্রে অক্সিজেন গ্রহণকারী জীবের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। আবার মহাদেশীয় প্রাণীর উদ্ভব হয়। বর্তমান সময়ে শিলামণ্ডল, বারিমণ্ডল মধ্যে বিভিন্ন জীবের পারস্পরিক ক্রিয়ার আদান-প্রদানের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলকে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে চলেছে, সেইসঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করছে.