গুরুমণ্ডল (Mantle or Barysphere)
ভূত্বকের নীচে থেকে কেন্দ্রমণ্ডল (core) পর্যন্ত সান্দ্র ও ঘন পদার্থের অন্তর্বর্তী স্তরটিকে গুরুমণ্ডল বা Man-tie বলে। ভূত্বকের মধ্যে প্রবাহিত ও ১ তরঙ্গগুলি 8, 30 এবং 70 কিমি তলে দ্রুতগতি বৃদ্ধি করে। কারণ এই তলের নীচে বস্তুগুলির ঘনত্ব অধিক তাই ও তরঙ্গের গতিবেগ হঠাৎ বৃদ্ধি পেয়েছে। 1990 সালে ভূমিকম্প বিজ্ঞানী এ. মোহোরোভিসিক প্রথম লক্ষ করেছেন বলে তাঁর নাম অনুসারে এই তল মোহোরোভিসিক তল নামে পরিচিত। এই তল থেকে 2900 কিমি গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি পৃথিবীর মোট আয়তনের 34.53 শতাংশ। এই স্তরের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
1. গঠন (Structure): গুরুমণ্ডল খুব ঘন, ভারী অতি-ক্ষারকীয় শিলা দ্বারা গঠিত। এই শিলাগুলি লোহা ও ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ সিলিকেট খনিজের সমন্বয়ে গঠিত। বায়োটাইট, অলিভিন, পাইরক্সিন ও অ্যাম্ফিবোল হল এখানকার মূল খনিজ। গুরুমণ্ডলের নীচের অংশে থাকে ভারী খনিজ যথা পেরিক্রেজ, ম্যাগনেসিওয়সাইট (magnesiowusite) প্রভৃতি।
2. তাপমাত্রা (Temperature): এই স্তরের গড় তাপমাত্রা। প্রায় 200℃, যদিও তাপমাত্রা ওপর থেকে নীচের দিকে ক্রমশ বাড়ে। 100 কিমি গভীরতায় তাপমাত্রা 1200-1300°C-এর কাছাকাছি আর 700 কিমি গভীরতায় 1900° সে. এবং 2900 কিমি গভীরতায় প্রায় 2500-3000℃ বলে ধরা যায়।
3. ঘনত্ব (Density): গুরুমণ্ডলের গড় ঘনত্ব (3.32-5.2 গ্রাম/ ঘন সেমি। এই স্তরে ওপর থেকে নীচের দিকে ঘনত্ব ক্রমশ বাড়ে। বহিঃগুরুমণ্ডলের 200-700) ঘনত্ব 4.29 গ্রাম/খন সেমি এবং অন্তঃগুরুমণ্ডলের (700-2900 কিমি)। ঘনত্ব 5.66 গ্রাম/ঘন সেমি ধরা হয়। অর্থাৎ গুরুমণ্ডলের ঘনত্ব মোটামুটিভাবে জলের চেয়ে 4-5 গুণ ভারী।
4. চাপ (Presure): গুরুমণ্ডলের গড় চাপ প্রায় 855 কিলোবার। বহিঃগুরুমণ্ডলের চাপ 260 কিলোবার এবং অন্তঃগুরুমণ্ডলের চাপ প্রায় 1350 কিলোবার।
5. উপবিভাগ (Subtypes): গঠনকারী উপাদানগুলির তারতম্য এবং তরঙ্গের গতিবেগের উপর নির্ভর করে গুরুমণ্ডলকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
(A) বহিঃগুরুমণ্ডল (Upper Mantle): গুরুমণ্ডলের উপরের অংশটি মোহোরোভেসিক বিযুক্তি রেখা থেকে প্রায় 410 কিমি গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত। অর্থাৎ এই স্তরের বিস্তার 100 থেকে 410 কিমি। এটি সমগ্র পৃথিবীর আয়তনের পরিপ্রেক্ষিতে 10.3 শতাংশ স্থান অধিকার করে রয়েছে। এই স্তরের মূল খনিজ হল অলিভিন ও পাইরক্সিন। এই সব খনিজ ক্রোমিয়াম, লোহা, সিলিকা এবং ম্যাগনেসিয়ামের ভাগ বেশি থাকায় এই অংশকে ক্লোফেসিমা (Chro-Fe-Si-Ma) বলে। এই অংশের প্রায় 300 কিমির কাছাকাছি প্রায় সমস্ত উপাদান গলনাঙ্কের কাছাকাছি থাকায় আংশিক নরম কিংবা অর্ধতরল অবস্থায় উত্তপ্ত ম্যাগমা রূপে অবস্থান করে। শিলার ঘনত্ব কমে যাওয়ায় এই স্তরে 'P' ও '১' তরঙ্গোর গতিবেগ ভীষণভাবে কমে যায়। এই মন্ডলে প্রধান শিলা পেরিডোটাইচ যাতে জলের পরিমাণ প্রায় 0.1 শতাংশ। বহিঃগুরুমণ্ডলের এই ওপরের অংশ অ্যাসথেনোস্ফিয়ার (asthenosphere) নামে পরিচিত।
(B) মধ্য গুরুমণ্ডল (Transition Mantle): ভূ-অভ্যন্তরে 410 থেকে 650 কিমি মধ্যবর্তী অঞ্চল মধ্য গুরুমণ্ডল নামে পরিচিত। এটি সমগ্র পৃথিবীর 7.5 অংশ জুড়ে অবস্থিত। অ্যালুমিনিয়াম সমৃদ্ধ সিলিকেট খনিজ এখানকার মূল উপাদান। এই খনিজ তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে সহজেই গলে গিয়ে ব্যাসল্ট জাতীয় ম্যাগমায় পরিণত হয় এবং এই ম্যাগমা কখনো কখনো বিশেষ পরিস্থিতিতে লাভা রূপে বাইরে বেরিয়ে আসে।
(C) অন্তঃগুরুমণ্ডল (Inner or Lower Mantle): ভূ-অভ্যন্তরে 650 থেকে 2900 কিমি পর্যন্ত অংশকে অন্তঃগুরুমণ্ডল বলে। এই অংশের বিস্তার প্রায় 2350 কিমি। এই স্তর সমগ্র পৃথিবীর প্রায় 49.2 শতাংশ স্থান জুড়ে রয়েছে। এই স্তরের নিম্নাংশে 'P' তরঙ্গের গতিবেগ প্রায় 13.7 কিমি/ সেকেন্ড এবং 'S' তরঙ্গের গতিবেগ প্রায় 7.3 কিমি/সেকেন্ড। লোহা, নিকেল, সিলিকা ও ম্যাগনেসিয়াম হল এই স্তরের মূল উপাদান সেজন্য এই স্তরকে নিফেসিমা (Ni-Fe-Si-Ma) বলে। এর উপরের অংশকে ব্যাসল্ট অঞ্চল (basalt zone) বলে। এই পদার্থগুলি তুলনামূলক ভাবে ভারী বলে এই অংশের ঘনত্ব অধিক অর্থাৎ 5.6 থেকে 9.9 গ্রাম/ঘনসেমি.।