welcome to mygeo.in Indian no 1 geography based website in Bengali

নদীগঠিত ভূমিরূপ(Landforms Produced By River)

নদীগঠিত ভূমিরূপ(Landforms Produced By River)


স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে নদীর কাজের ফলে বিভিন্ন ধরনের ভূমিরূপ গড়ে ওঠে। ক্ষয়চকে র প্রত্যেক পর্যায়ে কিছু সুনির্দিষ্ট ভূমিরূপ নায্য করা যায়। নদীক্ষয়কার্য সাধারণত উচ্চগতিতে ঢাল (22°-35°) খুব বেশি থাকার দরুন, নদীর জলের স্রোতের ফলে নদী উপত্যকাকে ভীষণভাবে ক্ষয় করে। সেই সঙ্গে যে ভূমিরূপগুলি গড়ে ওঠে তাকে ক্ষয় কাজের ফলে গঠিত ভূমিরূপ বলে। নীচে এগুলি সম্বন্ধে আলোচনা করা হল-

উচ্চগতিতে ভূমিরূপ (Landforms in Upper Course)

1. নদী উপত্যকা (River Valley): নদীর ক্ষয়কাজের ফলে উল্লেখযোগ্য ভূমিরূপ হল উপত্যকা। ক্ষয়চকে র যৌবন পর্যায়ে জল প্রবাহ ও অবঘর্ষজনিত ক্ষয়ের ফলে উপত্যকা গড়ে ওঠে। নদী তার পার্শ্বক্ষয়ের দ্বারা খাতের দু-পাশে ক্ষয় করতে থাকে। আবার নদী খাত সংলগ্ন অঞ্চলে বৃষ্টি জলের দ্বারা পাত ক্ষয় দেখা যায়। এইভাবে নদী খাতের পাড় বরাবর রিল (rill) ও গালি (gully) মাধ্যমে নদী প্রস্থ বৃদ্ধি পায়। যে অংশ দিয়ে নদীর জল প্রবাহিত হয় তাকে নদী খাত (river channel) বলে। আবার খাতের উপরের দুপাশের জলবিভাজিকা দ্বারা আবন্ধ অংশকে উপত্যকা বলে। যে কোনো নদী উপত্যকাকে নদী খাত এবং দুপাশের উপত্যকা ঢালের (river valley) মধ্যে ভাগ করা যায়। এই উপত্যকা দৈর্ঘ্য বরাবর বৃদ্ধি পেতে থাকে বিভিন্ন কারণে, যেমন নদী তার মস্তক ক্ষয়ের ফলে উপত্যকার দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করতে পারে। আবার নদী বাঁক সৃষ্টির মাধ্যমে উপত্যকা বৃদ্ধি করতে পারে। কিংবা নদী মোহনায় ভূমিভাগের উত্থান ঘটলে বা সমুদ্রতল নীচে নেমে গেলে নদী উপত্যকার দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায়। শুধুমাত্র নদীর কার্যের ফলে উপত্যকা গড়ে ওঠে তা না আবহবিকার কিংবা পুস্তুক্ষয়ের মাধ্যমেও উপত্যকা গড়ে ওঠে।

2. গিরিখাত (Gorge): উচ পার্বত্য অঞ্চলে নদীর ঢাল বেশি বলে নদী বেগে প্রবাহিত হয়। এই প্রবাহিত হওয়ার সময় জলের স্রোতের সঙ্গে বাহিত শিলাখণ্ড নদীর তলায় ঘষতে ঘষতে এগিয়ে চলে কিন্তু নদীখাতের দুপাশে কঠিন শিলার অবস্থান করে বলে, ক্ষয় কাজে বাধা দেয় এবং খাড়া দেওয়ালের মতো অবস্থান করে। নদীর এই ধরনের ক্ষয় নীচের দিকে খুব বেশি হয় বলে, উপত্যকাটি অতি সংকীর্ণ ও অত্যন্ত গভীর হয়। একে দেখতে অনেকটা ইংরেজি 'V' আকৃতির মতো হয়। এই ধরনের গভীর উপত্যকাকে গিরিখাত (Gorge) বলে।

যদি কোনো নদীখাতের নীচে চ্যুতি কিংবা নরম শিলাস্তর অবস্থান করে তাহলে নিম্নক্ষয় বেশি হয়, তখন দুই পাড়ের মধ্যে দূরত্বের তুলনায় গভীরতা বাড়তে থাকে। ভারতের সিন্ধু, শতদ্রু, গঙ্গা প্রভৃতি নদী তাদের পার্বত্য প্রবাহের গিরিখাত লক্ষ করা যায়। নবীন ভঙ্গিল পার্বত্য অঞ্চলেও গিরিখাত দেখা যায়। হিমাদ্রি অঞ্চলের শতদ্রু নদীখাতের গভীরতা প্রায় 4000 মিটার। পেরুর এল-ক্যানন দ্য কলক। পৃথিবীর গভীরতম গিরিখাত, আবার চিনের ইয়াং সিকিয়াং নদীর চিয়াং গিরিখাত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গিরিখাত যার দৈর্ঘ্য 250 কিমি।

3. ক্যানিয়ন (Canyons): শুষ্ক অঞ্চলে গিরিখাতকে ক্যানিয়ন বলা হয়। শুষ্ক অঞ্চলে বৃষ্টির অভাবে পার্শ্বক্ষয় নয় কিন্তু নিম্নক্ষয় চলতে থাকে। ফলে এখানে উপত্যকা সংকীর্ণ ও গভীর হয়। মরু অঞ্চলের বাইরে উচ্চ পর্বতের বরফগলা জলে পৃষ্ট নদী যদি মরু অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন অঞ্চলে বৃষ্টির তাণ্ডবে পার্শ্বক্ষয় বিশেষ লক্ষ করা যায় না। কিন্তু শুধুমাত্র নিম্নক্ষয় লক্ষ করা যায়। এক্ষেত্রে কোমল শিলাস্তরের উপর দিয়ে খরস্রোতা নদী বয়ে চলে, সেখানে সুগভীর খাত সৃষ্টি করে। যা দেখতে ইংরেজি 'T' অক্ষরের মতো হয়। খাড়াই পাড়বিশিষ্ট নদীর এই গভীর খাতকে ক্যানিয়ন বলে। জলবায়ুর শুদ্ধতার জন্য এই সমস্ত অঞ্চলের নদীপাড়ের আবহবিকার জাত শিলাচূর্ণ অপসারিত হয় না এবং নদীর দুপাড়ের উচ্চতাও কমে না। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমে শুষ্ক মরু অঞ্চলে কলোরাডো নদীতে একটি সুন্দর গিরিখাত। গড়ে উঠেছে, যা কলোরাডো গ্র্যান্ড ক্যালিয়ন (Colorado Grand Canyon) নামে পরিচিত। প্রতি পৃথিবীর দীর্ঘতম ও গভীরতম গিরিখাত। যার দৈর্ঘ্য 483 কিমি এবং গভীরতা 161 মিটার। ভারতের শুষ্ক লাদাখ মালভূমিতে সিন্ধুর উপনদী শিয়রে এক সুন্দর ক্যানিয়নের সৃষ্টি হয়েছে।

4. জলপ্রপাত (Waterfall): নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে গঠিত ভূমিরূপগুলির মধ্যে জলপ্রপাত এক উল্লেখযোগ্য ভূমিরূপ। যা যৌবন পর্যায়ে নদীর পর্যায়িত ঢালের উপর বিভিন্ন স্থানে লক্ষ করা যায়। নদীর প্রবাহগতির মধ্যে জলতলের পার্থক্যকে জলপ্রপাত বলে। অর্থাৎ নদী তার প্রবাহ পথে জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়। নদীর গতিপথে কঠিন ও কোমল শিলাস্তর আড়াআড়ি, উল্লম্ব কিংবা তির্যকভাবে অবস্থান করলে কোমল শিলাস্তরটি বেশি ক্ষয় হয়ে নীচু হয়ে। ফলে কঠিন শিলাস্তর থেকে জল প্রবল বেগে নীচে পড়ে এবং জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়। পার্বত্য অঞ্চলে নদীর গতিপথের দৈর্ঘ্য বরাবর ঢাল খাড়া ভাবে নীচের দিকে নেমে জলরাশি প্রবল বেগে উপর থেকে নীচের দিকে পতিত হয়। অনেক সময় অনেকগুলি ছোটো ছোটো জলপ্রপাত একটি সমান্তরাল রেখা দ্বারা অবস্থান করতে দেখা যায়। একে জলপ্রপাত রেখা (waterfall line) বলে। নদীর গতিপথে কোনো চাতির সৃষ্টি হলে যে খাড়া ঢালের সৃষ্টি হয়, কিংবা আন্দোলনের ফলে কোনো স্থানে খাড়া ঢালের সৃষ্টি হলে আবার পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে ঝুলন্ত উপত্যকার সৃষ্টি হলে কিংবা মালভূমির প্রান্তভাগে খাড়া ঢাল গঠিত হলে জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়ে থাকে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট লরেন্স নদীর উপর নায়াগ্রা জলপ্রপাত পৃথিবীর বিখ্যাত সুন্দর জলপ্রপাতের উদাহরণ। ভেনেজুয়েলা রাষ্ট্রে কারাওয় শাখা নদী রিও করোনির উপর গড়ে ওঠা সাল্টো অ্যাঞ্জেলা পৃথিবীর উচ্চতম জলপ্রপাত। যার উচ্চতা 979 মিটার। জাইরে প্রজাতন্ত্রের বোরোমা পৃথিবীর বৃহত্তম জলপ্রপাত। যার বছরে জলপ্রবাহের পরিমাণ 6 লক্ষ কিউসেক (cusee), লাওসেরখোন জলপ্রপাত পৃথিবীর মধ্যে প্রশস্ত জলপ্রপাত। এর প্রস্থ প্রায় 10.8 কিমি। ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের সরাবতী নদীর উপর যোগ জলপ্রপাত ভারতের উচ্চতম জলপ্রপাত।

5. আবন্ধ বা শৃঙ্খলিত শৈলশিরা (Interlocking Supr): পার্বত্য অঞ্চলের নদীর গতিপথে বাধা দেওয়ার জন্য শৈলশিরার বা পাহাড় অবস্থান করলে নদী এই পাহাড় বা শৈলশিরাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য সামান্য বাঁক নিয়ে কিংবা এঁকেবেকে প্রবাহিত হয়, তখন শৈলশিরাগুলিকে দূর থেকে উপত্যকার মধ্যে আবদ্ধ আছে বলে মনে হয়। সেই সঙ্গে নদীর গতিপথ আড়োনা হয়ে যায়। এই ধরনের অবস্থাকে আবন্ধ বা শৃঙ্খলিত শৈলশিরা বলে। এই সমস্ত শৈলশিরা নদীর ঊর্ধ্ব অংশকে এমনভাবে আড়াল করে রাখে যেন মনে হয় দুপাশ লোক পাহাড়গুলি উপত্যকায় নেমে এসে পরস্পরের সাথে যুক্ত (Interlock) হয়েছে। এই ধরনের ভূমিরূপকে অনেকে আড়াআড়ি পাড়ও বলে। হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে ভাগিরথী ও মন্দাকিনীর প্রবাহপথে শৃঙ্খলিত শৈলশিরা লক্ষ করা যায়।

6. কর্তিত শৈলশিরা (Truneated Spur): অনেক সময় নদীর পার্বত্য প্রবাহে হঠাৎ ঢাল বৃদ্ধি পেলে সঙ্গে সঙ্গে জলপ্রবাহের গতিবেগ ও মাত্রা বৃদ্ধি পায়, সেই সঙ্গে তীব জলের স্রোতের প্রভাবে জলস্রোতের দ্বারা কিংবা আঘাতে পার্বত্য অঞ্চলে গঠিত শৃঙ্খলিত শৈলশিরাগুলিকে ক্ষয়প্রাপ্ত করে নদী সোজাপথে বয়ে চলে। এরফলে পর্বতের স্পারগুলি খাড়াভাবে বন্ধুর কর্তিত শৈলশিরার সৃষ্টি করেছে। পাহাড়ী অঞ্চলের স্পারগুলি নদীস্রোতে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে কর্তৃত শৈলশিরা গঠন। করে। পাহাড়ের পাশে প্রবাহিত নদীক্ষেত্রে এই ধরনের ভূমিরূপ অধিক লক্ষ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তোর্সা নদী ভুটানের দক্ষিণ সীমায় প্রবাহিত হওয়ার সময় বর্তিত শৈলশিরা সৃষ্টি করেছে।

7. মন্থকূপ (Pot-hole): পার্বত্য অঞ্চলে তথা নদীর উচ্চগতিতে নদীর জলের সঙ্গে বাহিত বিভিন্ন আকৃতির শিলাখণ্ডগুলি নদীর গতিপথে কোনো শিলাস্তর অবস্থান করলে, শিলাখণ্ড ও জলের অবঘর্ষ ও ঘর্ষণ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক ঘূর্ণীর ফলে এই সমস্ত শিলাখণ্ডগুলির আঘাত নদীখাতে গোলাকার ছোটো ছোটো গর্তের সৃষ্টি করে, এদের মন্ত্রকূপ বলে। মন্ত্রকূপ পাথরযুক্ত নীচু নদীখাতে গড়ে ওঠে এবং মন্থকূপের দ্বারা নদীর গভীরতা বৃদ্ধি পায়। জলপ্রপাতের পাদদেশেও মন্ত্রকূপ পরিলক্ষিত হয়। প্রস্তরময় নীচু নদীখাতে উপর থেকে পতিত জলের চাপ কিংবা নদীবাহিত শিলাখণ্ডের পারস্পরিক সংঘাত বা বুদবুদজনিত ক্ষয়কার্যের ফলে মন্থকূপ সৃষ্টি হয়। তিস্তা নদীর পার্বত্য প্রবাহে বহু স্থানে মন্ত্রকূপ দেখা যায়। এই ভূমিরূপের ব্যাস কয়েক সেমি থেকে কয়েক মিটার পর্যন্ত হতে পারে। ঝাড়খণ্ডের সরাইকেল্লার কাছে খরবাহ নদী একসঙ্গে অনেকগুলি মন্ত্রকূপ দেখা গেছে, যাকে মন্দকূপ কলোনী বলে।

৪. প্লাস্তুপুল (Plunge-Pool): অনেক সময় জলপ্রপাতের নীচে জল এবং জলের সঙ্গে শিলাখণ্ডের আঘাতে এক ধরনের বর্তুলাকার গর্তের সৃষ্টি হয়। যা প্লাঞ্চপুল নামে পরিচিত। প্রাঞ্জপুল গর্তের গভীরতা নির্ভর করে জলপ্রপাতের উচ্চতা, পতিত জল ও পাথরের পরিমাণ প্রভৃতির ওপর। প্লাঞ্চপুল সাধারণত নদীর মধ্যে গঠিত জলপ্রপাতের উল্লম্ব আঘাতে অবঘর্ষণ সংঘর্ষণ, বুদবুদক্ষয় এবং উৎপাটনের যৌথ কি য়ায় গড়ে ওঠে। জলপ্রপাতে অবস্থিত প্রাঞ্জপুলগুলি আয়তনে খুব বিস্তৃত হয়। কিন্তু মন্থকূপ গুলির আয়তন তুলনামূলকভাবে ছোটো হয়। অর্থাৎ আয়তনের দিক থেকে প্রাঞ্জপুলগুলি সাধারণত অধিক আয়তনের ক্ষয়জাত গর্তের সৃষ্টি করে। নায়াগ্রা জলপ্রপাতে প্লাঞ্চপুল লক্ষ করা যায়। শুদ্ধ ঋতুতে নদীতে জলের পরিমাণ হ্রাস পেলে প্রাঞ্জপুল দৃষ্টিগোচর হয়। গ্রীষ্মকালে সুবর্ণরেখা নদীর হুড়ু জলপ্রপাতে প্লাঞ্চপুল লক্ষ করা যায়।

9. পলিশঙ্কু (Alluvial-Fan): নদীর উচ্চগতি বা পার্বত্য পাদদেশ অঞ্চলে ঢালের হঠাৎ পরিবর্তনের ফলে নদীর ক্ষয় ও বহন কাজে অপেক্ষা অনেক সময় সঞ্চয় কাজ অধিক পরিমাণে করে থাকে অর্থাৎ নদীর ঢাল কমে যাওয়ার জন্য নদীর গতিবেগ কমে যায়। তখন নদীতে অবস্থানরত শিলাখণ্ড নদী আর, পুরোপুরি বহন করতে পারে না, সেই অবস্থায় অল্প ঢালু অঞ্চলে বয়ে আনা পদার্থ (নুড়ি, বালি, কাঁকর) জমা করে। উচু পার্বত্য অঞ্চল থেকে হঠাৎ সমভূমিতে নেমে আসে। নদী যখন তার পরিবাহিত পদার্থগুলি তথা মূলত পলি জমা করে পাখার মতো শঙ্কু আকৃতির ভূমিরূপ গঠন করে। একে পলি শঙ্কু বা পলল ব্যজনী বলে। পাশাপাশি অনেকগুলি পলিশঙ্কু গঠিত হয়ে পলিমণ্ড গড়ে ওঠে।

কাশ্মীর হিমালয়ে দ্রাগ, শিয়বা প্রভৃতি অংশে ত্রিকোণাকার পলিশঙ্কু গড়ে উঠতে দেখা গেছে।

মধ্যগতিতে ভূমিরূপ (Landforms in Middle Course)

1. অগভীর ও চওড়া নদী উপত্যকা (Lessdeep Valley and Wide River Valley): নদীর মধ্যগতিতে নদীর গতিপথের ঢাল কমে 5°-10°-র মধ্যে অবস্থান করে, সেইসঙ্গে নদীর জলস্রোতের গতিবেগ কমে যায়। তা সত্ত্বেও নদীর এই প্রবাহপথে নিম্নক্ষয় অপেক্ষা পার্শ্বক্ষয় বৃদ্ধি পাওয়ার দরুন নদী উপত্যকা প্রশস্ত হয়। নদী প্রবাহপথের এই অংশের ক্ষয়ের পরিমাণ সামান্য। কিন্তু বহন ও সঞ্চয় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। এই স্বল্প পরিমাণ ক্ষয় এবং বহনও সঞ্চয় কার্যের ফলে এই গতিতে যে উল্লেখযোগ্য ভূমিরূপ গড়ে ওঠে; তা অগভীর ও চওড়া নদী উপত্যকা। এই অংশে নদী যতই মোহনার দিকে অগ্রসর হয় ততই ঢাল হ্রাস পাওয়ার ফলে স্রোতের বেগ কমে যায়। এই অবস্থায় ভূমিভাগ সমতল হওয়ায় নদীখাত ক্রমশ অগভীর ও চওড়া হয়। নদী খাতের এই অংশে পলি, বালি প্রভৃতি পদার্থসমূহ পার্শ্বক্ষয়জনিত ঘূর্ণাবর্তের প্রভাবে নদীপ্রবাহ পথে চওড়া ও অগভীর নদী উপত্যকা সৃষ্টি হয়।

2. প্লাবন ভূমি (Flood Plain): প্রধানত পরিণত অবস্থার শেষে অর্থাৎ নদীর নিম্নপ্রবাহে অধিকাংশ নদী চওড়া ও অগভীর উপত্যকার মধ্য দিয়ে জলপ্রবাহ সরু পথ ধরে ধীরে ধীরে যেতে থাকে। তখন ওই নদী উপত্যকার বর্ষা ঋতুতে নদীখাতে অতিরিক্ত জল এসে পড়লে নদীতে জলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ জল সংকীর্ণ নদীখাতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে না পেরে তাড়াতাড়ি নদীর দুকূল প্লাবিত করে বন্যার সৃষ্টি করে। এর ফলে নদীর উভয়তীরে জলের প্লাবনের ফলে সূক্ষ্ম পলি, বালি, কাদা প্রভৃতি সঞ্চিত হয়ে যে নতুন ভূমিরূপের সৃষ্টি করে তাকে প্লাবনভূমি বলে। এইভাবে নদী উপত্যকা অঞ্চল জলে ডুবে যায় এবং নীচু অবনমিত জলাভূমি অঞ্চলে পলিমাটি জমে প্লাবনভূমির সৃষ্টি করে। সিন্ধু, গঙ্গা প্রভৃতি নদীতে প্লাবনভূমি লক্ষ করা যায়।

3. স্বাভাবিক বাঁধ (Natural levee): নদীর নিম্নপ্রবাহে নদীখাতে ক মশ পলি সঞ্চিত হয়ে ভরাট হতে থাকলে সময়ের সঙ্গে সলো নদী পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের তুলনায় কিছুটা উঁচু হয়। এই সময়ে নদীতে জলের জোগান বৃদ্ধি পেলে বন্যার ফলে নদীর দুই তীরবর্তী স্থান প্লাবিত হয় এবং বন্যার জল সরে গেলে নদীর দুই তীরে কাঁকর, বালি ও পলি প্রভৃতি সঞ্চিত হয়ে যে বাঁধের সৃষ্টি করে, তাকে স্বাভাবিক বাঁধ বলে। পৃথিবীর অধিকাংশ বড়ো নদীতে তাদের নিম্নপ্রবাহে তীরবর্তী স্থানে স্বাভাবিক বাঁধ লক্ষ করা যায়।

4. নদী বাঁক (River meander): নদীর মধ্যগতিতে নদীর শক্তি কমে যাওয়ার দরুন নিম্নক্ষয়ের হার কমে যায় ফলে পার্শ্বক্ষয় বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী উপত্যকা ক্রমশ প্রশস্ত হয়। এই সময় নদীতে জলের পরিমাণ বেশি থাকার ফলেও নদীর ঢাল কমে যাওয়ায় নদীর গতিবেগ হ্রাস পায়। এই সময় এই গতিপথে নদী প্রবাহে কোনো বাধা পেলে সেই বাধাকে অতিক্রম করার জন্য নদী এঁকেবেকে (winding course) এগিয়ে যায়, একে নদী বাঁক বলে। নদীর এই বাঁকের আকৃতি ও বিস্তার নির্ভর করে নদীর গতিও বাহিত পদার্থের আকৃতির ওপর। কখনও কখনও এই নদী বাঁকের আকৃতি চুলের কাঁটার ন্যায় দেখতে বলে একে Hair Pin Bend বলে। নদী বাঁক বিভিন্ন কারণে সৃষ্টি হয়। যেমন (৬) নদীর সরলরৈখিক প্রবাহ শক্ত শিলাস্তর বা পলল স্তরে ক্ষয় করতে সক্ষম হলে নদীবাঁক সৃষ্টি হয়, (b) আবার পৃথিবীর আবর্তন গতির জন্য ভূপৃষ্ঠের নদী প্রবাহে বাঁকের সৃষ্টি হয়। (c) ভূ-বিজ্ঞানী Ncu (1974)-এর মতে, পৃথিবীর কোরিও লিগ বলের তারতমোর জন্য নদী বাঁকের সৃষ্টি হয়। (d) ভূ-বিজ্ঞানী Richards মনে করেন যে, কোনো স্থানের নদী পাড়ের ক্ষয় ও চড়া সৃষ্টির জন্য নদী বাঁকের সৃষ্টি হয়। (e) ভূ-বিজ্ঞানী Hijul Storm (1949)-এর মতে অভিকর্ষ তরঙ্গের (Gravity Waves) এর প্রভাবে নদী বাঁধ গঠিত হয় এবং (f) ভূ-বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ও শেন (1964)-র মতে জলপ্রবাহের ঘূর্ণি (Vortey) নদী বাঁক সৃষ্টিকে সাহায্য করে। গঙ্গানদীর বারানসীর কাছে নদী বাঁক লক্ষ করা যায় এবং উত্তরপ্রদেশের চুনার দুর্গা থেকে গঙ্গার নদী বাঁকটি খুবই দৃশ্যমান। সেইসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার চূর্ণি, জলঙ্গি ও ভাগিরথীর মধ্যে বহু সুন্দর সুন্দর নদী বাঁক দেখতে পাওয়া যায়।

5. অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ (Ox-bow-lake): ক্ষ্যাচক্রের পরিণত পর্যায়ে নদীর গতিপথের ভূমির ঢাল কমে যাওয়ায় নদী সাপের মতো এঁকেবেঁকে এগিয়ে যায়। এবং নদী বাঁক (meander) গড়ে তোলে। নদীর অবতল (concave) পাশে জলপ্রবত্রাহের ক্ষয়কাজ করে এবং ক্ষয়জাত পদার্থ বিপরীত দিকে অর্থাৎ উত্তল (convex) পাশে জমা করে। এইভাবে বাঁকগুলি ক্রমশ বড়ো হওয়ায় বাঁকের বাহুদুটি পরস্পরের কাছে চলে আসে। এই অবস্থায় ওই বাঁকদুটির মধ্যবর্তী অংশ ক্ষয় পেয়ে বাঁক দুটি জুড়ে যায় ও নদী সোজা পথে বয়ে যায়। ক্ষয়প্রাপ্ত বাঁকা অংশটি নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হ্রদের আকার ধারণ করে। এই ধরনের হ্রদ দেখতে অনেকটা ঘোড়া বা গবুর ক্ষুরের মতো হয় বলে, একে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ বলে। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ভাগীরথীর উভয়পার্শ্বে অনেক অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ দেখতে পাওয়া যায়। আবার অজয় নদেও অসংখ্য অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ দেখতে পাওয়া যায়। এই হ্রদগুলিতে পলি, বালি, কাদা প্রভৃতি জমে জলে আটকে গিয়ে জলাশয়ের সৃষ্টি করে।

6. বিলম্বিত সলাম (Deferred junction): নদীর সমভূমি প্রবাহে নদীর সঞ্চয় কাজের ফলে যে স্বাভাবিক বাঁকগুলি গড়ে ওঠে, সেগুলি চিরস্থায়ী নাও হতে পারে, কিংবা বন্য নিয়ন্ত্রণ করতে নাও পারে। তখন কৃত্রিম পদ্ধতিতে তাকে আরো উঁচু করা হয়। এই অবস্থায় অনেক উপনদী প্লাবন সমভূমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এসে মূল নদীর সঙ্গে সঠিক স্থানে মিলিত হতে না পেরে, মূল নদীর সমান্তরালে প্রবাহিত হতে বাধ্য হয় এবং পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিক বাঁক ভেদ করে মূল নদীর সঙ্গে মিলিত হয়। এই ভাবে দুই নদীর মিলন বা সঙ্গমস্থলকে বিলম্বিত সঙ্গম বলে। মিসিসিপি নদীর উপনদী ইয়াজু (Yazoo) প্রায় 280 কিমি পথ অতিক্রম করে এই ধরনের সঙ্গমের সৃষ্টি করেছে। মনে রাখা দরকার যে, প্রধান নদী এবং তার উপনদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে জলাভূমি লক্ষ করা গেছে।

নিম্ন গতিতে ভূমিরূপ (Landform in Lower Course)

1. নদী চর দ্বীপ (Riverine Island): নদীর নিম্ন গতিতে অর্থাৎ সমভূমি প্রবাহে ভূমির ঢাল কমে যাওয়ায় নদী ধীর গতিতে প্রবাহিত হয়। এই সময় নদীর সঙ্গে পরিবাহিত শিলা, নুড়ি, বালি, কাঁকর প্রভৃতি বহন করতে না পেরে বিভিন্ন স্থানে নদীগর্ভে ক মাগত সঞ্চিত হতে থাকে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেঙ্গ সেগুলি নদীর বুকে চর বা চড়া হিসাবে জেগে ওঠে। জল দ্বারা পরিবেষ্টিত এই চরগুলিকে দ্বীপ হিসাবে গণ্য করা হয়। নদীর মধ্যে এগুলি মগ্নচড়ার সৃষ্টি করে এবং এগুলি বড়ো আকারের হয়। সাধারণত পর্বত পাদদেশীয় সমভূমি অঞ্চলে কিংবা মোহনার সন্নিকটে এই ধরনের ভূমি গঠিত হতে দেখা যায়। এই চর থেকে নদী বিভক্ত হয়ে চরের দুপাশ দিয়ে বেগুনির মতো প্রবাহিত হয়। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর মোহনায় অসংখ্য নদীচর বা চড়া লক্ষ করা যায়। আবার নদী বাঁকের যে প্রান্তে স্রোতের আঘাত কম লাগে, সেখানে বালুকণা সঞ্চিত হয়ে বালুচড়ের সৃষ্টি হয়। ভাগিরথী নদীর নদীয়া জেলার বিভিন্ন স্থানে এবং হুগলি নদীর হালিশহরের কাছে এই ধরনের বহু চড়া লক্ষ করা গেছে। আসামে ব্রহ্মপুত্রনদের মাজুলী দ্বীপ ভারতের বৃহত্তম দ্বীপ যার আয়তন 929 বর্গকিমি। দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলে আমাজন নদী মোহনায় গঠিত ইল্ল্লা দ্য মারাজো (Ilha de Marajo) বিশ্বের বৃহত্তম নদী গঠিত দ্বীপ। যার আয়তন প্রায় 48,000 বর্গকিমি।

2. বদ্বীপ (Delta): নদীর সঞ্চয় কার্যের ফলে উল্লেখযোগ্য ভূমিরূপ হল ডেল্টা। নদীর নিম্নপ্রবাহে অর্থাৎ সমভূমি প্রবাহের শেষপ্রান্তে মোহনার কাছে ভূমির ঢাল প্রায় সমুদ্র তলের সমান হওয়ায় অর্থাৎ মোহনার নিকট ভূমির ঢাল না থাকায় নদীর ক্ষয় ক্ষয়কার্যের ফলে ক্ষয়জাত পদার্থ সমুদ্রের লবণাক্ত জলের সংস্পর্শে এসে দ্রুত থিতিয়ে পড়ে, কিংবা নদীবাহিত বোঝা নদীখাতে জমা হয়। এই ধরনের পদার্থ জমা হয়ে যে বিশাল সমতল ভূমিভাগ গড়ে ওঠে তাকে বদ্বীপ বলে। অর্থাৎ সঞ্চয়কার্যের ফলে গঠিত বিস্তীর্ণ সমতল ভূভাগকে বদ্বীপ বলে। সাধারণ যে স্থান থেকে মূলনদী হতে প্রশাখা নদীগুলি উৎপন্ন হয়, সেই স্থানটি বদ্বীপের শীর্ষবিন্দু নামে পরিচিত। যাইহোক বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই ধরনের বিস্তীর্ণ সমতল ভূভাগের আকৃতি অনেকটা বাংলা মাত্রাহীন 'ব' অক্ষরের (গ্রিক অক্ষর 'এ' ডেল্টার ন্যায়) মতো, তাই এর এই ধরনের নামকরণ। নদীর মোহনা ছাড়াও হ্রদ কিংবা শাখানদী যেখানে প্রধান নদীর সাথে মিলিত হয়, সেখানে বদ্বীপ গড়ে ওঠে। বদ্বীপের ফলে মোহনার কাছে সমুদ্র ক্রমশ অগভীর হয়ে নতুন ভূমিরূপ গঠন করে। ভারত ও বাংলাদেশের গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর মিলিত বদ্বীপ পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ। এর আয়তন প্রায় 75,000 বর্গ কিমি।

3. খাঁড়ি (Estuary): সমুদ্রের নিকট নদী মোহনায় জোয়ার ভাটা হয়। জোয়ারের জল নদীখাতে ঢুকে নদী উপত্যকাকে আরও চওড়া করে দেয়। একে খাঁড়ি বলে। পশ্চিমবঙ্গে সুন্দরবন অঞ্চলে এরূপ অসংখ্য খাঁড়ি দেখা যায়। রাশিয়ার উত্তরে ওর নদীর মোহনায় অবস্থিত খাঁড়িটি পৃথিবীর দীর্ঘতম খাঁড়ি। আবার অনেকের মতে মোহনার নিকট নদীর স্রোত বেশি হলে কিংবা জোয়ার-ভাটার প্রকোপ বেশি থাকলে নদীর সঙ্গে বয়ে আসা বালি, পাথর কাদা প্রভৃতি সঞ্চিত হতে পারে না। ফলে নদীর মোহনা যথেষ্ট খোলা ও চওড়া হয় একে নদীর খাঁড়ি বলে। আমাজন, টেমস্ কিংবা কঙ্গো নদীতে এই ধরনের খাঁড়ির উৎপত্তি হয়েছে। এই খাঁড়ির ভেতর দিয়ে সমুদ্রের লবণাক্ত জল জোয়ারের দ্বারা নদীতে প্রবেশ করে কিংবা স্থলভাগের অভ্যন্তরে প্রবাহিত হয়। যা বান (bore) নামে পরিচিত। খাঁড়ি সৃষ্টি হওয়ার ফলে নদী মোহনা পরিষ্কার ও গভীরতা প্রাপ্ত হয়, ফলে জাহাজ চলাচলে সুবিধা হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Middle post ad 01