welcome to mygeo.in Indian no 1 geography based website in Bengali

গ্রানাইট শিলায় গঠিত ভূমিরূপ(Landforms on Granite)

গ্রানাইট শিলায় গঠিত ভূমিরূপ(Landforms on Granite)


গ্রানাইট হল সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য পাতালিক আগ্নেয় শিলা। ভূত্বকের অধিক গভীরতায় আম্লিক ম্যাগমা অত্যন্ত ধীরে ধীরে শীতল ও কঠিন হয়ে প্রানাইটের জন্ম দেয়। গ্রানাইটের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল মধ্যম থেকে বৃহৎ ও সমান আকার বিশিষ্ট পরস্পর সংযুক্ত ও সম্পূর্ণ কেলাসিত দানার সমন্বয়ে সৃষ্ট বুনন, কঠিন ও পিণ্ডাকার গঠন ও অধিক দারণ বিশিষ্ট। এই প্রকার শিলাসমূহের কণাগুলির আবার প্রায় সমান আকৃতির হয়ে বলে, গ্রানাইট শিলাকে 'সমআকৃতির কণাবিশিষ্ট শিলা'ও বলা হয়। আগ্নেয় শিলাসমূহের মধ্যে গ্রানাইট হল বালুকাযৌগ শ্রেণির প্রধান শিলা। এই শিলা সাধারণত কোয়ার্টজ, বালুকা, ফেল্ডস্পার, অভ্র, টুর্মালিন, অনেক ক্ষেত্রে সোডিয়াম ও পটাশ দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। ভূত্বকে গ্রানাইট শিলার উপস্থিতি সাধারণত উন্মুক্ত ব্যাথোলিঘ বা অন্যান্য উদ্‌দ্বেষী গঠনে লক্ষ করা যায়। অধ্যাপক Young I. Tuidel-এর মতে গ্রানাইট শিলায় গঠিত ভূমিরূপের ঢাল যথেষ্ট খাড়াই প্রকৃতির হয় এবং গ্রানাইট শিলার মধ্যে জলের প্রবেশ্যতা কম হয় বলে এই প্রকার ভূমিরূপে ধসও যথেষ্ট কম হয়ে থাকে। কিন্তু গ্রানাইট শিলায় যদি দারণের যথেষ্ট উপস্থিতি থাকে তাহলে এই শিলায় ধসের জন্ম হতে পারে। আর্দ্র জলবায়ু অংশে গ্রানাইট সাধারণত আবহবিকারজাত ভগ্নশেষে আবৃত অবতল অথবা, সমভূমির মাধ্যমে পরস্পর থেকে পৃথক বহু সুস্পষ্ট স্তূপাকার ও গম্বুজাকৃতির পাহাড় সৃষ্টি করে। এইরূপ ভূচিত্রে প্রায়শই দারণ নিয়ন্ত্রিত মধ্যম বুননের বৃক্ষরূপী থেকে কৌণিক নদী বিন্যাস লক্ষ করা যায়। অপরদিকে, শুদ্ধ জলবায়ু অঞ্চলে গ্রানাইটের স্তূপগুলি অধিক ব্যবচ্ছিন্ন হয়ে বিভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভূমিরূপ গঠন করে থাকে। জলপ্রবাহ ও আবহবিকারের দ্বারা গ্রানাইট শিলার উপরে তাদের একক কিংবা যুগপৎ ক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যে সমস্ত ভূমিরূপগুলি সৃষ্টি হয় তা নীচে আলোচনা করা হল-

1. গোলাকৃতি ভূমিরূপ (Rounded Landscape): গ্রানাইট শিলার উপর জলপ্রবাহ কিংবা, আবহবিকারের দ্বারা সৃষ্ট যে সমস্ত ভূমিরূপটি গুরুত্বপূর্ণ, তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ভূমিরূপ হল গোলাকৃতি ভূমিরূপ। গ্রানাইট শিলা ভূগর্ভের পাতালিক অংশে গঠিত হলেও দীর্ঘ সময়ব্যাপী ভূভাগের উপর আবহবিকার ও নগ্নীভবনের ফলে বা ভূ-আলোড়ন জনিত কারণে গ্রানাইট শিলা ভূপৃষ্ঠে প্রকাশিত হয়। এই উন্মোচিত গ্রানাইট শিলার উপর যান্ত্রিক আবহবিকারের শব্ন্ধমোচন (exfoliation) প্রক্রিয়ায় বৃত্তাকার দারণ বা ফাটলের সৃষ্টি হয়। ফলে গ্রানাইট শিলার অংশবিশেষ গোলাকার ভূমিরূপের জন্ম দেয়, তাকেই গোলাকৃতি ভূমিরূপ বলা হয়। এই প্রকার ভূমিরূপটি দেখতে অনেকটা পাহাড়ের ন্যায় বলে, এই ভূমিরূপটিকে গোলাকৃতি পাহাড় (rounded hillocks) বলা হয়। একে অনেকেই গণ্ডশিলা (boulders) বলেও অভিহিত করেছেন। ভারতের ছোটোনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে, সিমলিপাল উচ্চভূমিতে ও দক্ষিণ ভারতের গ্রানাইট শিলাগঠিত আর্কট ও গুন্টুর জেলায় গোলাকৃতি ভূমিরূপের নিদর্শন মেলে।

2. উচ্চভূমি ও শৈলশিরা (Uplands and Ridges): গ্রানাইট শিলার উপর আবহবিকারের প্রভাবে সৃষ্টি হওয়া দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিরূপ হল-উচ্চভূমি ও শৈলশিরা। গ্রানাইট শিলা ভূপৃষ্ঠের বহু নীচে পাললিক শিলাস্তর দ্বারা উর্ধ্বদিকে ও পার্শ্বদিকে আবৃত হয়ে পাতালিক শিলারূপে অবস্থান করে। ভূপৃষ্ঠে আবহবিকারের ক্রম কার্যকারিতার মধ্যে দিয়ে এই শিলাস্তর স্খলিত তথা ক্ষয়ীভূত হয়। ক্রমাগত আবহবিকার চলতে থাকলে উর্ধ্ব আংশের সামগ্রিক আংশ ক্রমশ ক্ষয়ীভূত হতে হতে অবশিষ্ট পদার্থরূপে পরিণত হয়। এর পরে এই সমস্ত আবহবিকারগ্রস্ত পদার্থসমূহ অপসারিত হয়ে যায়। অপসারণ ক্রমাগত চলতে থাকলে ভূ-অভ্যন্তরের গ্রানাইট শিলাযুক্ত অংশ ভূপৃষ্ঠে প্রকাশিত হয় ও তা আবার আবহবিকারের দ্বারা ক্ষয়ীভূত হয়ে যে উচ্চ ভূমিরূপ সৃষ্টি করে, তাকেই উচ্চভূমি বলা হয়। উচ্চভূমির উচ্চতা গোলাকৃতির ভূমিরূপের উচ্চতা থেকে তুলনামূলকভাবে বেশি। এইরূপ কতকগুলি উচ্চভূমি একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে শৃঙ্খলাকারে অবস্থান করলে, তখন সেই ভূমিরূপকে শৈলশিরা বলা হয়। অ্যান্ডিনেভিয়া ও স্কটল্যান্ডের বিস্তীর্ণ ভঙ্গিল পার্বত্য অঞ্চলে এইরূপ ভূমিরূপের যথেষ্ট নিদর্শন মেলে।

3. ইনসেলবার্জ (Inselberg): গ্রানাইট শিলায় গঠিত তৃতীয় প্রকার ভূমিরূপ হল-ইনসেলবার্জ। গ্রানাইট শিলায় গঠিত বিভিন্ন আকার বা আকৃতির অবশিষ্ট পর্বতসমূহকে ইনসেলবার্জ বলা হয়। গ্রানাইট শিলা গঠিত অংশ বা উচ্চভূমি যান্ত্রিক আবহবিকারের শল্কমোচন প্রক্রিয়ার দ্বারা ক্রমশ ক্ষয়ীভূত ও স্খলিত হয়ে যে প্রায় গম্বুজাকৃতির পাহাড়ে পরিণত হয়, তাকেই ইনসেলবার্জ বলা হয়। জার্মান ভাষায় Insel শব্দের অর্থ island, দ্বীপ এবং দক্ষিন আফি কায় bery শব্দের অর্থ Hill বা পাহাড়। অর্থাৎ, ইনসেলবার্জ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল-দ্বীপীয় পাহাড় বা বিচ্ছিন্ন পাহাড়। এইরূপ ইনসেলবার্জ আবহবিকারের দ্বারা আরো ক্ষর্থীভূত হয়ে যখন ক্ষুদ্রাকৃতির গম্বুজে পরিণত হয়, তখন তাকে বোর্নহার্ড (bornhardt) বা ক্যাসেল কপিজ (castle koppie) বলে।

4. টিলা (Crag): গ্রানাইট শিলায় গঠিত পরবর্তী ভূমিরূপ হল টিলা। পাতালিক আগ্নেয় শিলা গ্রানাইটের মধ্যে প্রচুর দারণ (joints) সৃষ্টি হলে, সেই দারণগুলির মধ্যে দিয়ে আম্লিক প্রকৃতির দ্রবণ নীচের দিকে নেমে এসে আবহবিকারগ্রস্ত সামগ্রিক পদার্থসমুকে অপসারিত করে যে অতি স্বল্প উচ্চতা বিশিষ্ট উচ্চভূমির সৃষ্টি করে, তাকেই টিলা বলা হয়। ইনসেলবার্জকে অনেকেই টিলার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। কিন্তু ইনসেলবার্জ-এর উচ্চতা টিলার থেকে তুলনামূলকভাবে বেশি। ইংল্যান্ডের ডার্টমোর (dartmoor) টিলার উদাহরণসহ বহু সমীক্ষায় টিলার প্রসঙ্গাটি আলোচিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গোর বীরভূম জেলায় মামাভারে পাহাড়ে এইরূপ টিলার অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়।

5. ক্ষয়জাত গর্ত (Erosional Hollow): গ্রানাইট শিলায় আবহবিকারের ফলে গঠিত অন্যতম প্রধান ভূমিরূপ হল ক্ষয়জাত গর্ত। গ্রানাইট শিলা ক্রমাগত আবহবিকারের মধ্যে দিয়ে ভূপৃষ্ঠে উন্মোচিত হওয়ার পর, এই শিলার উপরে বিষম প্রকৃতির রাসায়নিক আবহবিকারের প্রভাবে শিলা মধ্যস্থ ফেল্ডস্পার ও অভ্র খনিজ দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ও অপসারিত হয়ে যে গর্তের ন্যায় ভূমিরূপ সৃষ্টি করে, তাকেই ক্ষয়জাত গর্ত বলে। আরাবল্লী পর্বতের নানান অংশে এই ধরনের ভূমিরূপের যথেষ্ট নিদর্শন মেলে।

6. টর (Tor): গ্রানাইট শিলায় গঠিত এক প্রকার বিশেষ ভূমিরূপ কনটিকের হাম্পি অঞ্চলের গ্রানাইট ল্যান্ডস্কেপ হল টর। 1955 সালে লিন্টন বলেন যে ক্রান্তীয় অঞ্চলের অনুরূপ আবহবিকার কার্যের মধ্যে দিয়ে প্রারম্ভিক পর্যায়ে কোরস্টোন গঠিত হয় এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে টরের সৃষ্টি হয়। গ্রানাইট শিলা গঠিত অংশে দারণ বা ফাটলের উপস্থিতি থাকলে তার মধ্যে দিয়ে জল প্রবাহিত হয়ে রাসায়নিক আবহবিকারের দ্বারা শিলার দ্রাব্য অংশ দ্রাবকে মিশে গিয়ে অপসারিত হয়ে শিলার ক্ষয় পরিসাধন করে ও দারণ ও ফাটলের আকার ও আয়তন বৃদ্ধি করে। এইভাবে শিলার ক্ষয়জাত পদার্থসমূহগুলি জলধারার সঙ্গে পরিবাহিত হয়ে গিয়ে যে বৃহৎ দারণ ও ফাটলযুক্ত অক্ষয় প্রাপ্ত কঠিন অংশগুলি দাঁড়িয়ে থাকে তাকেই অন্তঃপ্রস্তর (core-stone) বলে। এই অন্তঃপ্রস্তরের উপর রাসায়নিক আবহবিকার অতি ক্রিয়াশীল হলে তার মধ্যেকার সূক্ষ্ম পদার্থসমূহ তথা কাদা, বালি ও পলি দ্রাবকের মধ্যে দ্রাব্য হয়ে দ্রবণ সৃষ্টি করে ও অপসারিত হয়। এই ক্ষেত্রে রাসায়নিক আবহবিকারের তীব তার দরুন বিভিন্ন বৃহৎ আকৃতির দারণ ও ফাটলগুলি পরস্পর যুক্ত হয়ে বৃহৎ বৃহৎ ফাঁকা স্থান সৃষ্টি করে। এইরূপ সামগ্রিক অবস্থার ফলে অন্তঃপ্রস্তরের যে অক্ষয়প্রাপ্ত অংশগুলি দন্ডায়মান থাকে, তাকেই টর বলে। গ্রাফাইট শিলাগঠিত অঞ্চলে টর পার্শ্ববর্তী তরঙ্গায়িত ভূমিরূপ থেকে প্রায় 5 মিটার থেকে 20 মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। টরকে আবার অবস্থানের বিচারে মূলত দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

(a) আকাশরেখা টর (Skyline Tor): এই প্রকার টর উচ্চভূমির মস্তকদেশে বা জলবিভাজিকা অংশে লক্ষ করা যায়। এই প্রকার টর আংশিক গোলাকার বিশিষ্ট হয়।

(b) উপ-আকাশরেখা টর (Sub-Skyview Tor): এই প্রকার টর সাধারণত উপত্যকার পার্শ্বদেশে লক্ষ করা যায়। এই প্রকার টর সাধারণত গোলাকার প্রকৃতির হয়ে থাকে।

7. ঢালযুক্ত ভূমিরূপ (Slope Topography): গ্রানাইট শিলায় গঠিত অন্যতম ভূমিরূপ হল ঢালযুক্ত ভূচিত্র। সাধারণত গ্রানাইট শিলা গঠিত বহু উচ্চভূমি অংশ গভীরভাবে ব্যবচ্ছিন্ন হলে যে শুধুমাত্র রৈখিক ঢালযুক্ত ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, সেই ভূমিরূপকে ঢালযুক্ত ভূমিরূপ বলা হয়। এইরূপ ভূমিরূপে উপত্যকার তলদেশে বা শৈলশিরার উপরে কোনো স্থানেই সমভূমি লক্ষ করা যায় না। মিশরের সিনাই উপদ্বীপে, দক্ষিণ-আমেরিকার সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালার পূর্ব অংশে নিবিড়ভাবে ঢালযুক্ত ভূমিরূপের অস্তিত্ব মেলে।

৪. সমভূমি (Plains): আয়তনের ও বৈশিষ্ট্যতার বিচারে গ্রানাইট শিলায় গঠিত সর্বাপেক্ষা সাধারণ প্রকৃতির ভূমিরূপ হল সমভূমি। সাধারণত মালভূমির পরবর্তী নিম্নদিকে প্রসারিত সামগ্রিক ভূভাগই সমভূমি নামে পরিচিত। ভূমিরূপ বিজ্ঞানী টুইডেল (Charles Rowland Twidale) গ্রানাইট শিলার গঠিত চার ধরনের সমভূমিকে চিহ্নিত করেছেন। এই সমভূমিগুলি হল-(a) পেডিমেন্ট, (b) শিলা পেডিমেন্ট, (c) সমপ্রায়ভূমি ও (d) পেডিপ্লেন। উপরিউক্ত প্রধান ভূমিরূপগুলি ছাড়াও গ্রানাইট শিলাগঠিত অঞ্চলে আবহবিকারজনিত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গ্রানাইট গম্বুজ, ভুপু ও মস্তকভূমি, এচপ্লেন, পিট, প্যান, মৌচাক সদৃশ ভূমিরূপ, রিল ও কাসকেড প্রভৃতি ক্ষুদ্রাকৃতির ভূমিরূপ বিশিষ্ট রূপে গড়ে ওঠে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Middle post ad 01