welcome to mygeo.in Indian no 1 geography based website in Bengali

ভূমিরূপ সৃষ্টির নিয়ন্ত্রকসমূহ (Controlling Factors of Landforms)

ভূমিরূপ সৃষ্টির নিয়ন্ত্রকসমূহ (Controlling Factors of Landforms)



পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে সৃষ্টি হওয়া ভূমিরূপের উপর বেশ কিছু উপাদানের নিয়ন্ত্রণ থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন ক্ষেত্রের শিলার বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে শিলার চরিত্র সাধারণত জটিল ধরনের। আবার পরীক্ষায় লক্ষ করা গেছে যে পৃথিবীর কোনো একটি ক্ষুদ্র অঞ্চলের গঠনেও নানা প্রকার শিলার সহাবস্থান। পৃথিবীর কোনো বিশেষ শিলায় গঠিত অঞ্চলের ভূমিরূপের গঠন ওই অঞ্চলের গাঠনিক শিলার বৈশিষ্ট্য ও পার্শ্ববর্তী শিলার দ্বারাও প্রভাবিত হয়। শিলার বেশ কিছু ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য ওই অঞ্চলের শিলার উপর গঠিত ভূমিরূপের নিয়ন্ত্রক হিসাবে কাজ করে। নীচে এই নিয়ন্ত্রকগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হল-

1. শিলার প্রথন (Texture of Rock): পৃথিবীর ভূমিরূপ সৃষ্টির অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসাবে বিবেচিত বিষয় হল শিলার প্রথন। সাধারণত শিলামধ্যস্থ খনিজ পদার্থসমূহের বিন্যাসের উপর শিলার প্রখন নির্ভরশীল। শিলার প্রথন মূলত দুই প্রকারের হয়। যথা-

(a) সুক্ষ্ম প্রথন ও স্কুল গ্রখন। সূক্ষ্মগ্রথন বিশিষ্ট শিলার কেলাস বা, ক্রিস্টালগুলি অতি ঘন সন্নিবিষ্ট থাকার দরুন এই শিলা আবহবিকারে বাধা প্রদর্শন করে। এর ফলাফলে শিলার ক্ষয় কম হয়ে স্বল্প ক্ষয়বিশিষ্ট ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। আবার, সমূল প্রথন বিশিষ্ট শিলার কেলাসগুলি অথন সন্নিবিষ্ট বা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার দরুন এই শিলা আবহবিকারে বাধ্য প্রদর্শন করলেও এই শিলার ক্ষয় বেশি হয়ে বৃহৎ মাত্রায় ক্ষয়বিশিষ্ট ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়।

2. শিলার কাঠিন্যতা (Hardness of Rock): পৃথিবীর ভূমিরূপ সৃষ্টির নিয়ন্ত্রক হিসাবে বিবেচিত দ্বিতীয় বিষয় হল শিলার কাঠিন্যতা। শিলার কাঠিন্যতা বা, যান্ত্রিক প্রতিরোধ ক্ষমতা ভূমিরূপকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করতে পারে না। কারণ, শিলার অন্যান্য কিছু বৈশিষ্ট্য শিলার কাঠিন্যতার প্রভাবকে হ্রাস করে। সাধারণত যে সমস্ত শিলার কঠিন্যতা (hardness) অনেক বেশি, সেই সমস্ত শিলা যথেষ্টভাবে ক্ষয় প্রতিরোধ করে কম মাত্রার ক্ষয়জাত ভূমিরূপ বা প্রায় উচ্চভূমি সৃষ্টি করে। যেমন-গ্রানাইট, নিস্ ও কোয়ার্টজাইট জাতীয় শিলার কাঠিন্যতা যথেস্ট বেশি হওয়ার দরুন এই সমস্ত শিলা ক্ষয় প্রতিরোধ করে বিভিন্ন প্রকার উচ্চভূমি, টিলা, ইনসেলবার্জ, বোর্নহার্ড (Bornhardt) বা শৈলশিরা তৈরি করে। আবার, চুনাপাথর, ডলোমাইট, কাদাপাথর ও খড়ি পাথর শিলার কাঠিন্যতা যথেষ্ট কম হওয়ার দরুন এই সমস্ত শিলা ক্ষয় প্রতিরোধে অক্ষম হয়। এই সমস্ত শিলার উপর সাধারণত নিম্ন উপত্যকা, গর্ত প্রভৃতি সৃষ্টি হয়ে থাকে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপালেশিয়ান পার্বত্য অঞ্চলে শেনানন্দোহা নদী অববাহিকায় (Shenandoah river valley) কঠিনতর বেলেপাথর ও কোয়ার্টজাইট শিলা কম ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে উচ্চভূমি ও খাড়া ঢাল সৃষ্টি করেছে এবং এর সংলগ্ন কোমলতর চুনাপাথর অধিক ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে নীচু ও তরঙ্গায়িত সমভূমির সৃষ্টি করেছে।

3. শিলার মারণ (Joints of Rock): পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অংশের ভূমিরূপের নিয়ন্ত্রকসমূহের মধ্যে অন্যতম হল শিলার দারণ। শিলার মধ্যস্থ এই বারণসমূহগুলি যান্ত্রিক ও রাসায়নিক আবহবিকারের মাধ্যমে শিলাসমূহের ক্ষয়সাধনে সহায়তা করে। যে সমস্ত শিলায় ধারণ বা জয়েন্টসের পরিমাণ বেশি, সেই সমস্ত শিলায় প্রবেশ্যতার পরিমান বেশি হয়ে দ্রুত শিলা ক্ষয় হয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। আবার, যে সমস্ত শিলায় দারণের পরিমাণ কম সেই সমস্ত শিলায় প্রবেশ্যতার পরিমাণ কম হওয়ায় কম ক্ষয়প্রাপ্ত ভূমিরূপের পের সৃষ্টি হয়। ভুতলে জলনির্গম প্রণালীর ধরন শিলায় দারণের বিন্যাসের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। দারণ ব্যবস্থায় জ্যামিতিক বিন্যাস অনুসারে সমান্তরাল, কৌণিক, আয়তক্ষেত্রাকার প্রভৃতি নানা ধরনের জলনিগম প্রণালীর সৃষ্টি হয়ে থাকে।

4. শিলার স্তরায়ণ তলের উপস্থিতি (Presence of Bedding Plane): পৃথিবীর ভূমিরূপ সৃষ্টির নিয়ন্ত্রক হিসাবে বিবেচিত চতুর্থ বিষয় হল শিলার স্তরায়ণ তল। যে সমস্ত শিলার স্তরায়ণ তলের পরিমাণ বেশি এবং স্তরায়ণতল ভূপৃষ্ঠের উপর উন্মুক্ত অবস্থায় বিরাজ করে, সেই সমস্ত শিলায় এই স্তরায়ণতল বরাবর ক্ষয়কার্য যথেষ্ট বেশি হয়। ফলে শিলা দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে অধিক ক্ষয়জাত ভূমিরূপের সৃষ্টি করে। আবার যে সমস্ত শিলায় স্তরায়ণ তলের সংখ্যা কম এবং স্তরায়ণ তল ভূপৃষ্ঠের যথেষ্ট নিম্নে অবস্থিত, সেই সমস্ত শিলায় স্তরায়ণ তল বরাবর ক্ষয়কার্য যথেষ্ট কম হয়। এক্ষেত্রে শিলা কম ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে স্বল্প ক্ষয়জাত ভূমিরূপের জন্ম দেয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আগ্নেয় শিলা ও রূপান্তরিত শিলার তুলনায় পাললিক শিলায় স্তরায়ণ তল যথেষ্ট বেশি বলে এবং পাললিক শিলার স্তরায়ণ তল ভূপৃষ্ঠের উপরে উন্মুক্তভাবে অবস্থান করায়, পাললিক শিলায় ক্ষয় যথেষ্ট বেশি হয়ে অধিক ক্ষয়বিশিষ্ট ভূমিরূপ সৃষ্টি হয়।

5. শিলার সচ্ছিদ্রতা (Porosity of Rock): পৃথিবীর ভূমিরূপসমূহের সৃষ্টির নিয়ন্ত্রকরূপে বর্ণিত পঞ্চম নিয়ন্ত্রক হল শিলার সচ্ছিদ্রতা। শিলার মধ্যেকার সচ্ছিদ্রতা বলতে সাধারণত শিল্পামধ্যস্থ খনিজগুলির মাঝখানের ক্ষুদ্র বা সুক্ষ্ম ফাঁকগুলিকে বোঝানো হয়। শিলার সচ্ছিদ্রতা সাধারণত খনিজ কণার আকৃতি, গঠন ও সংঘবন্ধতার উপর নির্ভর করে। শিলার মধ্যেকার সচ্ছিদ্রতার পরিমাণ অসম আয়তনের খনিজসমূহের ক্ষেত্রে যথেষ্ট কম ও সম আয়তনের খনিজসমূহের ক্ষেত্রে যথেষ্ট বেশি হয়ে থাকে। যে সমস্ত শিলার সচ্ছিদ্রতার পরিমাণ যত বেশি হবে সেই সমস্ত শিলা ততই কম ক্ষয় প্রতিরোধ করে অধিক ক্ষয়বিশিষ্ট ভূমিরূপের জন্ম দেবে। আবার, যে সমস্ত শিলার সচ্ছিদ্রতার পরিমাণ যথেষ্ট কম, সেই সমস্ত শিলা বেশি ক্ষয় প্রতিরোধ করে কম ক্ষয়বিশিষ্ট ভূমিরূপের জন্ম দেবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বেলেপাথর বা চুনাপাথর শিলার সচ্ছিদ্রতা গ্রানাইট বা শ্লেট জাতীয় শিলার সচ্ছিদ্রতা থেকে যথেষ্ট বেশি হওয়ার দরুন বেলেপাথর বা চুনাপাথর শিলাগঠিত অঞ্চলে অধিক ক্ষয়বিশিষ্ট ভূমিরূপের সৃষ্টি হয় এবং গ্রানাইট ও শ্লেট শিলাগঠিত অঞ্চলে স্বল্পক্ষয় বিশিষ্ট ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। শিলার সচ্ছিদ্রতা প্রাথমিকভাবে শিলাগাত্রে অধিক ক্ষয় সংঘটিত করতে সাহায্য করলেও পরবর্তী সময়ে শিলাগাত্রে ক্ষয়ের পরিমাণের হ্রাস ঘটিয়ে থাকে।

6. শিলার প্রবেশ্যতা (Permeability of Rock): পৃথিবীর ভূমিরূপ সৃষ্টির নিয়ন্ত্রক হিসাবে বিবেচিত ষষ্ঠ বিষয় হল-শিলার প্রবেশ্যতা। শিলার প্রবেশ্যতা বলতে সাধারণত শিলার ভিতর দিয়ে জল প্রবাহিত হওয়ার ক্ষমতাকে বোঝায়। শিলার প্রবেশ্যতা সাধারণত শিলার ফাটল, শিলার সংযুক্তি ও শিলার স্তরায়ণ তলে অবস্থিত দারণের উপর নির্ভরশীল। যে সমস্ত শিলার প্রবেশ্যতা যথেষ্ট বেশি, সেই সমস্ত শিলার মধ্যে দিয়ে জলের দ্রুত প্রবাহের দরুন শিলার মধ্যে ক্ষয়ের পরিমাণ অতি অল্প হারে ঘটে কম ক্ষয়প্রাপ্ত ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। কিন্তু যে সমস্ত শিলার প্রবেশ্যতা যথেষ্ট কম, সেই সমস্ত শিলার মধ্যে দিয়ে জলের অদ্ভুত প্রবাহের দরুন শিলার মধ্যে ক্ষয়ের পরিমাণ যথেষ্ট বেশি হারে সংঘটিত হয়ে অধিক ক্ষয়প্রাপ্ত ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যুক্তরাজ্যের কার্বনিফেরাস যুগের চুনাপাথর গঠিত অঞ্চলে প্রবেশ্যতা যথেষ্ট বেশি থাকার দরুন, সেই অংশে কম ক্ষয়কার্য সংঘটিত হয়ে উচ্চ মালভূমি, খাড়া ঢাল ও শৈলশিরা গঠিত হয়েছে।

7. শিলার দ্রাব্যতা (Solubility of Rock): শিলার দ্রাব্যতা ভূমিরূপ সৃষ্টির একটি অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রক। শিলার দ্রাব্যতা কথাটি শিলার দ্রবণ ক্রিয়ার সহিত নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। যে সমস্ত শিলা যত দ্রাব্য অর্থাৎ দ্রাবকের সংস্পর্শে এসে নিজের আকার হারিয়ে ফেলে বা দ্রাবকে মিশে যায়, সেই সমস্ত শিলার মধ্যে ততই ক্ষয়কার্য সংঘটিত হয়ে ক্ষয়কার্যের উত্তম ভূমিরূপসমূহ গড়ে ওঠে। আবার অন্যদিকে, যে সমস্ত শিলা যত কম দ্রাব্য সেই সমস্ত শিলা তত বেশি ক্ষয় প্রতিরোধ করে স্বল্প ক্ষয়বিশিষ্ট ভূমিরূপের সৃষ্টি করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গ্রানাইট শিলার দ্রাব্যতা কম হওয়ায় এই শিলাপৃষ্ঠে যে সংখ্যক স্বল্প ক্ষয়জাত ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। চুনাপাথর বা ডলোমাইট শিলার দ্রাব্যতা যথেষ্ট বেশি হওয়ায় এই শিলাপৃষ্ঠে তার থেকে বেশি সংখ্যক অধিক ক্ষয়বিশিষ্ট ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়।

৪. শিলার খনিজ ও রাসায়নিক সংযুক্তি (Minerological and Chemical Composition of Rocks): শিলার খনিজ ও রাসায়নিক সংযুক্তি যথেষ্ট রূপে পৃথিবীপৃষ্ঠে ভূমিরূপ সৃষ্টির নিয়ন্ত্রক রূপে কাজ করে থাকে। এক প্রকার বিশেষ ধরনের শিলার মধ্যস্থ খনিজ সমন্বয়ন ও শিলার মধ্যস্থ রাসায়নিক সংযুক্তির দ্বারা শিলা দ্রুত হারে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে অধিক ক্ষয়বিশিষ্ট ভূমিরূপের জন্ম দেয়। এই প্রকার শিলার একটি আদর্শ উদাহরণ হল চুনাপাথর। চুনাপাথর শিলাগঠিত অংশে নিবিড়ভাবে রাসায়নিক আবহবিকারের দরুন আদর্শ কার্স্ট ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। কোনো স্থানে দীর্ঘকাল ধরে রাসায়নিক আবহবিকারের ফলে নানা ধরনের কাদার সৃষ্টি হয়। এই ধরনের কাদা সঞ্চিত হতে হতে কাদাস্তর সৃষ্টি করে থাকে। আবার অন্য এক প্রকার শিলামধ্যস্থ খনিজ সমন্বয়ন ও রাসায়নিক সংযুক্তির দ্বারা শিলা অদ্ভুত হারে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে স্বল্প ক্ষয়বিশিষ্ট ভূমিরূপের জন্ম দেয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Middle post ad 01