welcome to mygeo.in Indian no 1 geography based website in Bengali

জেট প্রবাহ (Jet Stream)

জেট প্রবাহ (Jet Stream)


ধারণা (Concept)

বায়ুপ্রবাহ ভূগোল বিষয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বায়ুপ্রবাহের সঙ্গে জেট বায়ুপ্রবাহ ওতপ্রতোভাবে জড়িত। জলবায়ু ও আবহবিদ্যার আলোচ্য বিষয় হল জেট বায়ুপ্রবাহ। বায়ুমণ্ডলে বায়ুর সঞ্চালন জনিত তত্ত্বগুলির মধ্যে অন্যতম তত্ত্ব হল জেট বায়ুপ্রবাহ। পৃথিবীকে বৃত্তাকারে ঘিরে রাখা একটি বায়ুপ্রবাহ হল জেট বায়ুপ্রবাহ World Meteorological Or-ganisation জেট প্রবাহকে একটি শক্তিশালী সংকীর্ণ বায়ুস্রোত হিসেবে অখ্যায়িত করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই বায়ুস্রোত আবহাওয়াবিদগণের দৃষ্টিতে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় 1944 সালে বিজ্ঞানী M. Backen এই প্রবাহ আবিষ্কার করেন। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের পরে চিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্ল গুস্টাফ রসবি (Carl Gustaf Rossby)-র অধীনে এই বিষয় সম্বন্ধে গবেষণা শুরু হয় যা আজও চলছে। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ এবং মেরুপ্রদেশীয় নিম্নচাপ কক্ষের মধ্যবর্তী অঞ্চলে বায়ুমণ্ডলের উচ্চস্তরে কিছু প্রবল পশ্চিমা জিওস্ট্রপিক বায়ু প্রবাহিত হয়। যা পরবর্তী সময়ে জেট প্রবাহ নামে পরিচিত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আমেরিকার বোমারু বিমানগুলি জার্মানি এবং জাপানে বোমা বর্ষণের জন্য পূর্ব থেকে পশ্চিমে যেত, সেই সময় বিমান চালকেরা লক্ষ করেন যে, ঊর্ধ্ব ট্রপোস্ফিয়ারে অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠ থেকে 9-12 কিমি উচ্চতায় পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে এবং 30°-40° উত্তর অক্ষাংশের মধ্যবর্তী অঞ্চলে উচ্চ গতিবেগ সম্পন্ন এক ধরনের বায়ু প্রবাহিত হচ্ছে। এই বায়ুর জাপানের উপর গতিবেগ ঘণ্টায় 200-300 নট্ (1 নট্ = 1.1 মাইল)। ঋতু অনুযায়ী অক্ষাংশের অবস্থানের তারতম্য লক্ষ করা যায়। যেমন গ্রীষ্ম ঋতুতে 35°-45° অক্ষাংশের মধ্যে আবার শীতকালে 20°-25° অক্ষাংশের মধ্যে অবস্থান করে। এই বায়ুপ্রবাহ মূলত শীতের শুরুতে দেখা গেলেও মেয়াদ কিন্তু মার্চ-এপ্রিল মাস পর্যন্ত। আবার পৃথিবীর অধিকাংশ স্থানে এই বায়ুপ্রবাহ স্থায়ী হয়। তবে স্থান, সময় ও উচ্চতা ভেদে এই বায়ুর গতিবেগ পরিবর্তিত হয়। এই বায়ু গ্রীষ্মকাল অপেক্ষা শীতকালে গতিবেগ বেশি। আবার ভূপৃষ্ঠ থেকে 9 কিমি উচ্চতার মধ্যে গতিবেগ কম কিন্তু ভূপৃষ্ঠ থেকে 12 কিমি উচ্চতার ঊর্ধ্বে গতিবেগ বেশি। অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় মেরু অঞ্চলে এর গতিবেগ বেশি থাকে। এই বায়ু সর্বোচ্চ গতিবেগ 100 কিমি/ঘন্টা এবং সর্বনিম্ন 500 কিমি/ঘন্টা। এই বায়ুপ্রবাহের চারদিকে বায়ুপ্রবাহের স্বল্প গতিবেগ সম্পন্ন বায়ু থাকে।

এর সর্বোচ্চ গতি দেখা যায় এশিয়া মহাদেশের সমুদ্র উপকূল সংলগ্ন সীমান্তবর্তী অঞ্চলে, দক্ষিণ-পূর্ব আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর আফ্রিকা ও ভারত মহাসাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে। এই বায়ুপ্রবাহের বিস্তার তথা দৈর্ঘ্য কয়েক হাজার কিমি প্রস্থ 480-650 কিমি সেই সঙ্গে গভীরতা 2 কিমি অধিক।

এই বায়ু বায়ুমণ্ডলে উচ্চস্তরে প্রবাহিত একটি পশ্চিমা বায়ু। আবহবিজ্ঞানী Trewartha-এর মতে এই বায়ুপ্রবাহ সংকীর্ণ বলয়ে আঁকা বাঁকা পথে এবং অত্যন্ত শক্তিশালী ভাবে প্রবাহিত হয়। এই বায়ুপ্রবাহ দেখতে নদীর মতো বলে একে ইংরেজিতে জেট প্রবাহ বলে। আবার অনেকের মতে অতি উচ্চতায় জেট বিমানে গতিপথের বিপরীতে এই বায়ু প্রবাহিত হয় বলে এর নাম জেট বায়ুপ্রবাহ হয়েছে। এই বায়ুপ্রবাহের বেশিরভাগ অংশ অক্ষরেখা বরাবর প্রবাহিত হলেও, অনেকক্ষেত্রে উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত। তবে মধ্য অক্ষাংশে এই বায়ু অসমান ও তরঙ্গায়িত পথে (wally irregular path) পৃথিবীকে বেষ্টন করে প্রবাহিত হয়। জেট বায়ুস্রোতের প্রবাহিত পথের বিচ্যুতিও ঘটে। এই বিচ্যুতি অংশত উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত মহাদেশগুলির প্রভাবে জন্য এবং সমুদ্র সমতলে গতিশীল উচ্চ ও নিম্নচাপের জন্যে ঘূর্ণবাত ও প্রতীপ ঘূর্ণবাত ঘটে (cyclone and anticyclone)। মূলত তাপমাত্রা দ্বারা এই বায়ু প্রবাহিত হয়। জেট বায়ুপ্রবাহ নীচে ঘূর্ণবাত সৃষ্টি হয় সেইসঙ্গে এই বায়ুর প্রবাহপথকে ঘূর্ণবাত অনুসরণ করে। এই বায়ু সবসময় পশ্চিমদিক থেকে প্রবাহিত হয় না। কখনো কখনো মেরুর দিকে ও নিরক্ষরেখার দিকেও প্রবাহিত হতে দেখা যায়। কখনো কখনো এই বায়ুপ্রবাহ পশ্চিম থেকে পূর্বে না গিয়ে উত্তর পশ্চিম বা দক্ষিণ পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয়। ভারতবর্ষে জেট বায়ুপ্রবাহ দিল্লি থেকে গৌহাটির দিকে প্রবাহিত হয়। এই প্রবাহের তরঙ্গগুলি পৃথিবীর অধিকাংশ স্থানে স্থায়ী হয়।

উৎপত্তি (Origin)

জেট বায়ুপ্রবাহ একটি তাপমাত্রা তারতম্যজনিত ফল। এটি ট্রপোপজে যে অক্ষাংশে সর্বাধিক তাপ ঢাল (temperature gradient) লক্ষ করা যায় সেখানে এই বায়ুপ্রবাহ লক্ষ করা যায়। জেট প্রবাহের সৃষ্টি বা উৎপত্তির প্রধান কারণ হল বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রার উত্তর-দক্ষিণে পরিবর্তনের অসম হার। অর্থাৎ বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে উভয় মেরুর দিকে সমানভাবে হ্রাস পায় না। নিরক্ষরেখার উভয়দিকে যেহেতু দ্রুত গতিতে তাপমাত্রা কমতে থাকে। এছাড়া কিছু সংকীর্ণ সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে অধিকহারে তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটে। এই সমস্ত সীমান্তবর্তী অঞ্চলে তাই বায়ুচাপের ঢালও খুব খাড়া থাকে। তবে এই সমস্ত সীমান্তে তাপমাত্রার অনুভূমিক পরিবর্তনের হার বেশি হওয়ার জন্য সমতাপ (isotherm) রেখার দ্বারা নতি অধিক হয়। তাই একটি সীমান্ত অঞ্চলে বায়ুমণ্ডলের উচ্চতার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেঙ্গ বায়ুর গতিবেগ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই ধরনের তাপমাত্রা জনিত উচ্চগতির যে বায়ুপ্রবাহ যে সংকীর্ণ বলয়ে কেন্দ্রীভূত হয়, যা একটি জোট প্রবাহকে নির্দেশ করে।

তবে সমস্ত আবহবিজ্ঞানী এ বিষয়ে একমত নয়। কোনো কোনো আবহবিজ্ঞানীর মতে ট্রপোপজে বায়ু যেখানে কেন্দ্রমুখী সেখানেই এই ধরনের তাপঢাল ও চাপ ঢালের সৃষ্টি হয়। বায়ু প্রবাহের ত্রিকক্ষীয় মডেল অনুযায়ী ক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয়ের ঠিক উপরে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ অঞ্চল থেকে আসা একটি বায়ু এবং মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয় থেকে আসা আরেকটি বায়ু মুখোমুখি মিলনের ফলে তাদের মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্য সর্বাধিক লক্ষ করা যায়। এই ধরনের সীমান্ত বা মিলন অঞ্চল সংকীর্ণ ও দীর্ঘ হয়, এবং উৎপন্ন বায়ুপ্রবাহ সংকীর্ণ ও দীর্ঘ প্রকৃতির।

উপরি উল্লিখিত বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্য থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, বিজ্ঞানীরা তাপ (thermal), শক্তি (force), গতিবেগ (velocity) এবং প্রবাহ (flow) জনিত গবেষণার দ্বারা এই মত প্রদান করেন যে, বায়ুমণ্ডলে কোনো কারণে সৃষ্টি হওয়া ব্যারোক্লিনিক অসুস্থতা জেট প্রবাহের জন্য দায়ী। এই ধরনের অসুস্থতা মূলত ঘূর্ণায়মান অঘনীভূত পদার্থে (fluid) সৃষ্টি হয়। যার ভারসাম্যের স্থিতিশীলতা (static stability) রয়েছে, কিন্তু যা তাপ বৈচিত্র্যের (differ-ential heating) দ্বারা প্রভাবিত। বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর সাথে ঘূর্ণায়মান একটি অঘনীভূত পদার্থের আস্তরণ। বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্যের স্থিতিশীলতা রয়েছে যা hydrostatic equilibrium নামে পরিচিত। তবে বায়ুমণ্ডলের মতো বৈশিষ্ট্যযুক্ত অঘনীভূত পদার্থে ব্যারোক্লিনিক অসুস্থতা ও জেটপ্রবাহের মতো একটি প্রবাহ তৈরি হবে তা সবাই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ভাবে মেনে নিয়েছে।

অন্যভাবে বলা যায় যে, উত্তর-দক্ষিণ উয়তার ঢাল খুবই খাড়া প্রকৃতির হয়। এই কারণে উত্তর দক্ষিণ বায়ুচাপের ঢালও খুব খাড়া হয়। শীতল ভারী মেরুদেশীয় বায়ুর ক্ষেত্রে 1000mb-3000mb চাপের মধ্যে দূরত্ব থাকে মাত্র 9000 metrel আবার উয় ক্রান্তীয় বায়ুর ক্ষেত্রে এই দূরত্ব থাকে 9700 মিটার। কিন্তু সীমান্তের বাইরের দিকে এই দূরত্ব ধীরে ধীরে কমতে থাকে। সীমান্তবর্তী এলাকায় দ্রুত তাপমাত্রা পরিবর্তনের ফলে এই দূরত্ব 4000 km থেকে হ্রাস পেয়ে 300 মিটারে এসে পৌঁছায়। তাই কোনো আবহ মানচিত্রে 3000mb চাপে অঙ্কিত চাপ বলয়গুলি কাছাকাছি অবস্থান করে। এর দ্বারা বায়ুচাপের দ্রুত পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। জেট বায়ুস্রোতের স্তর পর্যন্ত এই বায়ুচাপের খাড়া ঢাল বৃদ্ধি পায়। কিন্তু মধ্য অক্ষাংশের নীচের দিকে (lower middle latitude) 9000-12000 ফুট উচ্চতায় পশ্চিমা জেট বায়ুর স্রোত সৃষ্টি হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Middle post ad 01