পৃথিবীর অভ্যন্তর: সাধারণ ধারণা(The Interior of the Earth: General Concept)
পৃথিবীর ভেতরে কী আছে তা জানার কৌতূহল বহু পুরোনো। মনুষ পৃথিবীর বুক ছেড়ে মহাকাশে অনেকদূর পর্যন্ত পাড়ি দিয়েছে অজানাকে জানার উদ্দেশ্যে। এক সময়ের মহাকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা চাঁদ এখন আর কল্পনার বস্তু নয়। বর্তমানে সৌর জগতের বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহ-তারা কিংবা ছায়াপথ সম্বন্ধে জানার প্রচেষ্টা আজও অব্যাহত। কিন্তু পৃথিবীর ভূ-অভ্যন্তরীণ ভাগে মানুষের খুব বেশি দূর যাওয়া হয়নি। বিভিন্ন খনিজ পদার্থের সন্ধানে মাটি খুঁড়ে 3-4 কিমি গভীর পর্যন্ত কম ব্যাস যুক্ত অঞ্চলে যেতে সমর্থ হয়েছে। আবার জলের জন্য ভূ-অভ্যন্তরে 7-8 কিমি যেতে সমর্থ হয়েছে। বিভিন্ন ভূবিজ্ঞানীগণ পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ ভাগের গঠন, উপাদান প্রভৃতি সম্বন্ধে জানার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধরনের বিকল্প পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। সেই উল্লেখযোগ্য পদ্ধতিগুলি হল-ভূকম্পন তরঙ্গ (seismic wave), তেজস্ক্রিয়তা (radio-activ-ity), ভূ-চুম্বকত্ব (geomagnetism), ভূ-বিদ্যুৎ (geo-electricity) প্রভৃতি। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ভূকম্পন তরঙ্গ ও পৃথিবী পৃষ্ঠের ওপর পতিত উল্কাপিণ্ডের যার সাহায্যে পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগের গঠন কাঠামো সম্বন্ধে সরাসরি দেখতে না পেলেও অনেক তথ্য পাওয়া গেছে; যা বর্তমান ভূগোলবিদদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এত কিছু করেও ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রকৃত ব্যাসের 0.1 শতাংশের বেশি এলাকার খবর জানা সম্ভব হয়নি।
বৈশিষ্ট্য (Charecteristics)
পৃথিবীর জন্ম যেভাবেই হোক না কেন, জন্ম মুহূর্তে এর আয়তন ছিল শূন্য এবং ঘনত্ব ছিল সসীম। সময় তখন শুরু হয়নি। যেন এক অজানা অবর্ণনীয় অবস্থা। এর পর থেকে ক্রমশ আয়তন বৃদ্ধি ও তাপমাত্রা হ্রাস পেতে থাকে। এই ক্রমশীতলতা একদিন বন্ধ হবে। যাই হোক জন্মের সময় সূর্যের ন্যায় পৃথিবীও ছিল একটি গ্যাসীয় পিন্ড। তারপর কোটি কোটি বছর ধরে বহু বিবর্তনের মধ্যদিয়ে পৃথিবী তার দেহ থেকে গ্যাসকে ত্যাগ করে বর্তমান কঠিন অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। পরবর্তী সময়ে তাপ বিকিরণের নিয়ম অনুসারে শীতল ও ঘনীভূত হয়ে তরল অবস্থায় পৌঁছেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে তাপ বিকিরণের মাত্রা, হিমাঙ্ক ও ঘনাঙ্ক বিভিন্ন। তাই এই তরল অবস্থায় পৃথিবীর উপাদানগুলির মধ্যে স্থান বিনিময় বা পরিবর্তন হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় হালকা উপাদান ওপরে চলে আসে। আবার ভারী উপাদান নীচে চলে যায়। সুতরাং লোহা, নিকেল তরলের নীচে ডুবে যায় এবং সেই সময় গঠনগত উপাদানগুলি স্তরে স্তরে ঘনত্বের (density) ভিত্তিতে স্তরে স্তরে সজ্জিত হয়।
পৃথিবী সৃষ্টির সময়ে বিভিন্ন মনীষী এবং ভূ-বিজ্ঞানীরা যেমন বিভিন্ন মত পোষণ করেছিলেন তেমনি পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কেও বিভিন্ন বিজ্ঞানী বহুকাল ধরে বিভিন্ন মত পোষণ করে আসছেন। অনেকে মনে করেন পৃথিবীর অভ্যন্তরে কেন্দ্রমণ্ডল (core or centrosphere) কঠিন (solid) অবস্থায় রয়েছে। আবার কেউ মনে করেন তরল (liquid) অবস্থায় রয়েছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে পৃথিবীর কেন্দ্রমণ্ডল সম্পূর্ণ বায়বীয় অবস্থায় রয়েছে। যারা কেন্দ্রমণ্ডলকে কঠিন অবস্থায় রয়েছে বলে মনে করেন তাঁদের মতে-
1. কেন্দ্রমণ্ডল যদি কঠিন না হয়ে তরল হত, তাহলে এই মন্ডলের চারদিকের আবরণের গভীরতা বৃদ্ধি পেতে থাকত। সেইসঙ্গে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত হ্রাস পেত।
2. কেন্দ্রমণ্ডল যদি তরল অবস্থায় থাকত তাহলে সেখানে প্রতিদিন জোয়ার ভাটা সংঘটিত হত, সেই সঙ্গে ভূভাগ কেঁপে উঠত।
3. পৃথিবী পৃষ্ঠের উপরিভাগ কঠিন এবং নীচের ভাগ যদি তরল অবস্থায় থাকত, তাহলে উপরিপৃষ্ঠ ধীরে ধীরে নীচে তরলের মধ্যে ডুবে যেত।
*আবার যে সমস্ত ভূ-বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর অভ্যন্তরের কেন্দ্রমণ্ডলকে তরল অবস্থা বলে সমর্থন করেছেন, তাঁদের মতে পৃথিবীর অভ্যন্তরে এমন কোনো বস্তু নেই যা ভূকেন্দ্রের অধিক উন্নতায় ও কঠিন অবস্থায় থাকতে পারে। তাঁরা মনে করেন যে উন্ন প্রশ্নবণ ও আগ্নেয়গিরির গলিত লাভাই প্রমাণ করে যে পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগ তরল।
*সেইসঙ্গে পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগকে যে সমস্ত বিজ্ঞানীরা গ্যাসীয় অবস্থা বলে চিহ্নিত করেছেন, তাঁদের মতে আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুৎপাতের সঙ্গে যে গ্যাসীয় পদার্থ নির্গত হয় যা ম্যাগমা থেকে লাভা পরিণত করে।
*সে যাইহোক, পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্বন্ধে সঠিক ধারণা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন ভূকম্প তরঙ্গোর গতিপ্রকৃতি পর্যালোচনা করা দরকার।