নদীর সঞ্চয় কাজ (Depositional Work of River)
নদীর তিনটি কাজের মধ্যে সঞ্চয় কাজ অন্যতম। এই সঞ্চয় কাজের দ্বারা ভূমিরূপ গঠিত হয়। এই সঞ্চয় কাজই হল নদীর শেষ কাজ। নদী ক্ষয়কাজের ফলে যা পদার্থ ক্ষয় করে তা বহন কাজের মাধ্যমে অপসারিত করে। কিন্তু এই অপসারিত পদার্থ হয় নদী দুপাশে জমা করে কিংবা সমভূমির উপর দিয়ে বয়ে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে দেয়। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই ধরনের সঞ্চয় হয় তাকে সঞ্চয়জাত প্রক্রিয়া এবং গঠিত ভূমিরূপকে সঞ্চয়জাত ভূমিরূপ বলে। নদী তার ক্ষয় করে আনা শিলাখণ্ড বা চূর্ণ, পলি প্রভৃতি নদীখাতে কিংবা নদীতে অত্যধিক জলের সরবরাহ হলে (বন্যা বা অন্য কোনো উৎস) তখন নদী তার পাড়ে দুইদিকে জমা করে। নদীর সঞ্চয় অনেকাংশে বহন প্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল, কারণ নদী যদি বহনে অক্ষম বা অসমর্থ হয় তখন সঞ্চয় লক্ষ করা যায়।
নদী উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত কোথাও না কোথাও ক্ষয়জাত পদার্থকে সন্বয় করে। প্রতিটি নদী উচ্চগতি, মধ্যগতি কিংবা নিম্নগতিতে সঞ্চয় করে, তবে নিম্নগতিতে মোহনার কাছে সঞ্চয়ের পরিমাণ সর্বাধিক। এটা মনে রাখতে হবে যে নদী পার্বত্য প্রবাহে বা উচ্চগতিতেও সঞ্চয় করে থাকে। নদীবাহিত শিলাখণ্ড, শিলাচূর্ণ কিংবা পলি, বালি, নুড়ি প্রভৃতিকে অভিকর্ষজনিত বল নীচের দিকে বা পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে টানে। কিন্তু নদীর জলস্রোত ওই বলকে সরিয়ে ক্ষয়জাত পদার্থকে নিম্নপ্রবাহের দিকে নিয়ে যেতে চায়। নদীর বহন ও সঞ্চয় কাজ ওই অভিকর্ষজনিত বলকে অতিক্রম করে নিজেরা নিজেদের কাজ সমাপ্ত করে। নদীর সঞ্চয় কাজ কতকগুলি বিষয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, সেগুলি হল- (a) ভূমিভাগে ঢাল কমে গেলে, (b) নদীতে জলের সরবরাহ কমে গেলে, (c) নদীর গতিবেগ হ্রাস পেলে, (d) নদীর বোঝার পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে, (e) নদী কোনো হ্রদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হলে, (f) নদী কোনো সছিদ্র শিলাস্তরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হলে, (৪) নদীর বিক্ষিপ্ত প্রবাহ হলে, (h) নদী পরিবাহিত পদার্থের আকার ও আকৃতি বাড়া কমা হলে।
নদী যে সমস্ত কঠিন পদার্থ নিয়ে আসে যেগুলির দ্বারা অবক্ষেপের ফলে সঞ্চয় গড়ে ওঠে। সেই কঠিন পদার্থগুলি সূক্ষ্ম থেকে কয়েক সেমি ব্যাস বিশিষ্ট হয়। কিন্তু সমস্ত অবক্ষেপে একই ধরনের পদার্থ লক্ষ করা যায় না। এই সমস্ত অবক্ষেপকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায় যথা- (i) গ্রাভেল এবং (ii) গ্রাভেল ছাড়া অন্যান্য পদার্থের সঞ্চয়। ভূমিরূপ বিজ্ঞানী ফিক্ (H. N. Fisk, 1944)-এর মতে সঞ্চয়ের মধ্যে প্রায় 45 শতাংশ গ্রাভেল এবং বাকি 55 শতাংশ অন্যান্য পদার্থ থাকে।
নদী প্রবাহ পথে বাধা অনেকক্ষেত্রে নদীর সঞ্চয়কে প্রভাবিত করে। যেমন কোনো বড়ো আকারের শিলাখন্ড ঝড় বৃষ্টির ফলে যখন নদীখাতে এসে পড়ে তখন সেই বড়ো মাপের শিলাখণ্ডের পাশে সঞ্চয় দেখা যায়। আবার নদী পাড়ের ক্ষয়ের ফলে যখন ডালপালাযুক্ত গাছ এবং পাথরখণ্ড নদীতে এসে পড়ে তখন প্রবাহ বন্ধ হয়ে সঞ্চয় গড়ে উঠে। নদীর উপর যদি সেতু তৈরি হয়, সেই সেতুর বীমের গায়ে সঞ্চয় লক্ষ করা যায়। আবার বাঁধ কিংবা সেচবাঁধ তৈরির ফলে তাদের পাশে সঞ্জয় লক্ষ করা যায়। যদি কোনো নদীতে প্রকল্প (project) গড়ে ওঠে, তাহলে সেখানেও সঞ্চয় লক্ষ করা যায়। নদী বাঁকের ফলে প্রায়শই নদীতে সঞ্চয় দেখা যায়।