উপকূল প্রক্রিয়া(Coastal Processes)
ডবলু, এম. ডেভিস (W. M. Davis)-এর ক্ষয়চক মতবাদে উপকূল অঞ্চলের ভূমি পরিবর্তন ব্যাখ্যা করা যায়। প্রত্যেক উপকূল অঞ্চলের একটি নিজস্ব জীবন ইতিহাস রয়েছে। উপকূল অঞ্চল সাধারণত সামুদ্রিক শক্তিসমূহের দ্বারা ক্ষয় ও সঞ্চয়কার্যের মধ্য দিয়ে আবর্তিত হয়ে অবশেষে পরিণত অবস্থায় পৌঁছায়। যদিও এই অঞ্চলগুলিকে ভূ-অভ্যন্তরীণ শক্তি তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। সমুদ্র উপকূলে নদী, বায়ু ও হিমবাহের মতো ক্ষয়কার্য করে থাকে এবং ক্ষয়কার্যকে যে সমস্ত নিয়ন্ত্রকগুলি নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলি হল- (a) সমুদ্রের জলরাশির পরিমাণ, (৮) সমুদ্রতরঙ্গের প্রকৃতি, (c) উপকূলভাগের প্রকৃতি, (d) বায়ুপ্রবাহ, (e) সমুদ্রজলের প্রকৃতি, (f) সমুদ্রস্রোত, (g) সমুদ্র জলের ভৌত গুণ (h) উপকূলভাগের আগ্নেয়গিরি, (i) জোয়ার ভাটার প্রকৃতি, (১) মানুষের কার্যাবলি প্রভৃতি। গভীর সমুদ্রে সৃষ্টি হওয়া তরঙ্গগুলি যখন উপকূলের কাছাকাছি অগভীর জলরাশির মধ্যে প্রবেশ করে তখন সমুদ্রতরঙ্গের গতির পরিবর্তন হয়। এর ফলে উপকূলভাগে ক্ষয়ের সৃষ্টি হয়। সমুদ্রের ঢেউ প্রধানত চারটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উপকূলভাগে ক্ষয়সাধন করে, সেগুলি নীচে আলোচনা করা হল-
1. অবঘর্ষজনিত ক্ষয় (Corrosion): প্রবল বায়ুপ্রবাহের দ্বারা সমুদ্রের ঢেউগুলি উপকূলের উপর অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়ে থাকে। এই তরঙ্গের সঙ্গে যে সমস্ত নুড়ি, বালি, পাথর, কাঁকর এবং শিলাখন্ড প্রবাহিত হয়, এই সমস্ত পদার্থের অবিরাম সংঘর্ষের ঘর্ষণের ফলে উপকূল অঞ্চল ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এই ধরনের ক্ষয়কে অবঘর্ষজনিত ক্ষয় বলে। এই প্রক্রিয়ায় বৃহৎ আকৃতির প্রস্তর খণ্ডগুলি তরঙ্গের আঘাতে ভেঙে গিয়ে টুকরো টুকরো খণ্ডে উপকূলভাগে ফেনিল তরঙ্গের যন্ত্র হিসাবে কাজ করে উপকূলে ক্ষয়কার্য সম্পাদন করে। এই ধরনের ক্ষয়কে সমুদ্রতরঙ্গ ও সমুদ্রস্রোত উভয়েই সাহায্য করে।
2. জলপ্রবাহ ক্ষয় (Hydraulic Action): সমুদ্রস্রোত ও সমুদ্রতরঙ্গের সঙ্গে বাহিত শিলাখণ্ড, নুড়ি, বালি প্রভৃতি প্রবল বেগে উপকূলে আঘাত করে এবং উপকূল ভাগ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। আবার, উপকূলে অবস্থানরত প্রস্তরখণ্ড বা শিলাখণ্ডগুলিতে জলপ্রবাহ ক্ষয় (Hydraulic Action)
যদি ফাটল অবস্থান করে তাহলে সেই ফাটলের ভিতরের বায়ু সমুদ্রতরঙ্গের আঘাতে সঙ্কুচিত ও প্রসারিত হয়ে ফাটলকে বৃদ্ধি করে এবং সবশেষে বৃহৎ শিলাখণ্ডগুলি বা প্রস্তরখণ্ডগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিলাখণ্ড বা প্রস্তরখণ্ডে পরিণত হয়। উপকূলের এই ধরনের ক্ষয়ের প্রক্রিয়াকে জলপ্রবাহজনিত ক্ষয় বলে। এই প্রক্রিয়ায় প্রবল জলপ্রবাহের দ্বারা স্ফটিকাকার তরঙ্গগুলি উৎক্ষিপ্ত হয়ে শিলায় স্থানান্তর ঘটায় ও ক্ষয়কার্য করে।
3. দ্রবণ ক্ষয় (Solution): যে সমস্ত উপকূলভাগ চুনাপাথর ও ডলোমাইট দ্বারা গঠিত, সেই উপকূলভাগে এই ধরনের ক্ষয় লক্ষ করা যায়। অর্থাৎ, চুনাপাথরের সঙ্গে সমুদ্রজলের বিক্রিয়ায় শিলা দ্রবীভূত ও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। উপকূলভাগে অবস্থানরত চুনাপাথর ও ডলোমাইট শিলা সমুদ্রজলে মিশ্রিত হয়ে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের সঙ্গে মিশে দ্রবণ প্রক্রিয়ায় ক্ষয়কার্য করে। এই ধরনের ক্ষয়কে দ্রবণ ক্ষয় বলে। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র সমুদ্রের নোনাজলের দ্রবণ প্রক্রিয়া লক্ষ করা যায়।
4. ঘর্ষণ ক্ষয় (Attrition): সমুদ্র তরঙ্গের সঙ্গে বাহিত বৃহৎ আকৃতির প্রস্তরখণ্ডগুলি পরস্পর পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিলাখণ্ডে পরিণত হয়। এই ধরনের ক্ষয়কে ঘর্ষণ ক্ষয় বলে।
5. উপরিউক্ত ক্ষয় কার্যের প্রক্রিয়া ছাড়াও চাপের ফলে উপকূল ভাগে ক্ষয় হয়। সমুদ্র তরঙ্গের আঘাতে উপকূলভাগের প্রস্তরখণ্ডে প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টি হয়। মূলত শিলার ফাটলে অভ্যন্তরস্থ বায়ু সমুদ্রতরঙ্গের আঘাতে সঙ্কুচিত ও প্রসারিত হয়ে ফাটল বৃদ্ধি করে ক্ষয়কার্যে সরাসরি অংশগ্রহণ করে।