ডোলাইন-এর শ্রেণিবিভাগ(Classification of Doline)
চুনাপাথর কিংবা চক্ সমৃদ্ধ অঞ্চলে দারণ তল (Joint plane) যুক্ত শিলাস্তরে ভূপৃষ্ঠ জলপ্রবাহ (surface run off) কিংবা ভৌমজলের প্রবাহ দ্বারা বিভিন্ন ধরনের ভূমিরূপ দেখা যায়। ভূমিরূপগুলি দুই ধরনের যথা ভূপৃষ্ঠের ভূমিরূপ (surface land-forms) এবং ভূ-অভ্যন্তরীণ ভূমিরূপ (underground landforms)। আবার আয়তনের অভ্যন্তরীণ ভূমিরূপকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-ক্ষুদ্র আয়তনের ভূমিরূপ এবং বৃহৎ আয়তনের ভূমিরূপ। বৃহৎ আয়তনের ভূমিরূপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ডোলাইন।
ডোলাইন (Doline): চুনাপাথরযুক্ত অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে দ্রবণ ও ক্ষয়কার্যের ফলে ছোটো ছোটো গর্ত বা সিঙ্ক হোল কিংবা সোয়ালো হোলগুলি ক্রমশ আকারে বড়ো হয়ে, যে বড়ো বড়ো গর্তের সৃষ্টি করে, তাদের ডোলাইন বলে। এটি এক ধরনের আবঙ্গ নিম্নভূমি (enclosed depressions)। অনেকের মতো চুনাপাথর অঞ্চলে যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র বা গর্তের সৃষ্টি হয় এই সমস্ত ছিদ্র দিয়ে নদী কিংবা ভূপৃষ্ঠের জল ভূঅভ্যন্তরে প্রবেশ করে, ভূঅভ্যন্তর ভাগ দিয়ে ঢাল অনুসারে কয়েক কিমি প্রবাহিত হওয়ার পর পুনরায় ভূপৃষ্ঠে এসে পড়ে। এইভাবে ভূগর্ভে নদীর জল অন্যত্র চলে যাওয়ার ফলে নদী উপত্যকা শুদ্ধ (dry valley) উপত্যকায় পরিণত হয়। পুনরায় অধিক বৃষ্টিপাতের দরুন জল ছিদ্রপথে প্রবেশ করতে না পেরে শুদ্ধউপত্যকা দিয়ে প্রবাহিত হয়। যুগোশ্লাভিয়ার কার্স্ট অঞ্চলে এই ছিদ্রগুলিকে ডোলাইন বলে।
ডোলাইনের গর্তগুলি ভূ-অভ্যন্তরে বিভিন্ন আকার ধারণ করে। কখনো ত্রিকোণাকার (triangle shape) কিংবা চোঙের আকৃতি বা বাটি আকৃতি মতো হয়ে থাকে। ছিদ্র বা গর্তে ধারগুলি অনাবৃত শিলা (bare rock) দ্বারা গঠিত হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে উদ্ভিদ দ্বারা আবৃত থাকে। গর্তের মুখগুলি সাধারণত ডিম্বাকার কিংবা গোলাকার আকার ধারণ করে। ডোলাইনের গভীরতা 1/2-1000 মিটার হয়ে থাকে। সেইসঙ্গে ব্যাস 10-1000 মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। কাস্ট অঞ্চলে ডোলাইনগুলি আলাদা আলাদাভাবে অবস্থান করলেও বাইরে থেকে ডোলাইনগুলিকে দলবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে বলে মনে হয়। কোনো অঞ্চলের অসংখ্য ডোলাইনের উপস্থিতি ভূপৃষ্ঠ অসংখ্য ছিদ্রের চেহারা নেয়। ডোলাইন গঠনে কী ধরনের প্রক্রিয়া কাজ করছে তার উপর ভিত্তি করে ভোলাইনকে চটি ভাগে ভাগ করা যায়। নীচে সেগুলি সম্বন্ধে আলোচনা করা হল-
1. দ্রবণজনিত ডোলাইন (Solution Doline): চুনাপাথর যুক্ত অঞ্চলে যেখানে শিলার দারণতলগুলি পরস্পর-পরস্পরকে ছেদ করে, সেখানে দারণতলগুলি ক্রমশ চওড়া হতে থাকে। এই তল বা ফাটল বরাবর দ্রবীভূত পদার্থ (solute) এবং জলীয় দ্রবণের অবশেষ নীচের দিকে নেমে এসে নিম্নভূমির (depression) সৃষ্টি করে। এইভাবে ভূপৃষ্ঠের কিছু অংশ যদি বসে যায়, তাহলে স্বাভাবিক কারণে সেখানে জলধারাগুলি প্রবাহিত হয়। অতিরিক্ত জলপ্রবাহের ফলে ডোলাইনের আয়তন বৃদ্ধি পায়। এইভাবে দারণ বরাবর দ্রবণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ডোলাইন গঠিত হতে পারে। এই ডোলাইনের ধারগুলি অনেক ক্ষেত্রে উদ্ভিদ দ্বারা ঢাকা থাকে, এবং দ্রবণ পদার্থ নীচে সঞ্চিত হয়ে অপ্রবেশ্য মৃত্তিকার স্তর গঠন করে যার ফলস্বরূপ একটি হ্রদ গঠিত হয়। মূলত এই ডোলাইনগুলি বাটি (bowl) আকার ধারণ করে। অনেকক্ষেত্রে ডোলাইনের চারপাশে ঢাল সমান না হওয়ায় তাকে অপ্রতিসম ডোলাইন (asymmetric doline) বলে। এই ধরনের ডোলাইনে টেরারোসা (terra rossa) মাটি দেখতে পাওয়া যায়।
2. ধসজনিত ডোলাইন (Collapse Doline): কার্স্ট অঞ্চলে ভূগর্ভের যদি গৃহা থাকে, তাহলে ডোলাইনগুলি অনেক গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত হতে থাকে। ফলে গুহার ছাদ ভেঙে ধসে পড়লে যে ডোলাইনের সৃষ্টি হয় তাকে ধসজনিত ডোলাইন বলে। এই অংশে গৃহার নীচে বেশি জল থাকলে হ্রদ সৃষ্টি হতে পারে। এই ধরনের ডোলাইনের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল যুগোশ্লাভিয়ার ভেলিকা (velika) ডোলাইন। যার গভীরতা 164 মিটার এবং প্রস্থ প্রায় 500 মিটার। আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চলে এই ডোলাইনগুলি চারপাশের ঢাল চোঙের ন্যায় (funnel shape) কিন্তু শুদ্ধ অঞ্চলে খাড়া ঢাল বহু দিন পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকে।
3. অবনমনজনিত ডোলাইন (Subsidence Doline): সাধারণত চুনাপাথরযুক্ত অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠে উপরের অবস্থানরত মৃত্তিকা কিংবা শিলাচূর্ণের স্তর আলগা হয়ে গেলে তা অনেক সময় ধীরে ধীরে অবনমিত হয়ে অবনমনজনিত ডোলাইন সৃষ্টি করে। অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের উপর যেখানে জলের প্রবাহ কিংবা হিমবাহ জমা হওয়ায়, চুনাপাথরের দারণ তলগুলি প্রথমে দ্রবণ প্রক্রিয়ায় চওড়া ফাটলে পরিণত হয় এবং পরবর্তী সময়ে নীচের দিকে বসে যাওয়ার ফলে এই ধরনের ডোলাইনের উৎপত্তি ঘটে। এই ধরনের ডোলাইন হল ইয়র্কশয়ারের ক্লাভেন যে সব শেহোল (Shakehole) রয়েছে সেগুলি।
4. নীচে অবস্থিত কাস্টীয় ডোলাইন (Subjacent Karst Doline): যে সমস্ত স্থানে চুনাপাথরের উপরে বেলেপাথর(sandstone) কিংবা কাদাপাথর (mudstone) জাতীয় শিলার অবস্থান হয়েছে সেখানে এই ধরনের ডোলাইনের উৎপত্তি ঘটেছে। সাধারণত ভূ-অভ্যন্তরে গুহার ছাদ ভেঙে পড়লে, উপরের শিলাস্তরগুলি ভারসাম্য না রাখতে পেরে ভেঙে পড়ে। তখন তার নীচে চুনাপাথরের স্তর থাকলেও ডোলাইনের মুখটি অন্য কোনো শিলাস্তরের উপর অবস্থান করে।
5. নদী অবতরণজনিত ডোলাইন (Stream Sink Doline): যখন ভূপৃষ্ঠে কোনো অবস্থানরত পলির স্তরকে ছেদ করে কোনো নদীপ্রবাহ ভূ-অভ্যন্তরে চুনাপাথর স্তরে প্রবেশ করে তখন তাকে নদী অবতরণজনিত ডোলাইন বলে। এই ধরনের ডোলাইনে নদীগুলি মাটির নীচে সুড়ঙ্গ তৈরি করে। নদীর জলপ্রবাহ শুধুমাত্র দ্রবণ প্রক্রিয়াকে সাহায্য করে তা নয়। ভূ-অভ্যন্তরে সুড়ঙ্গ গঠনে সাহায্য করে। ফলে সুড়ঙ্গগুলি মাটির নীচে বিস্তার লাভ করে। অনেকগুলি সুড়ঙ্গ একত্রে গহবরে গিয়ে পড়ে। সুড়ঙ্গগুলি ডোলাইনে যেখানে মিলিত হয়, সেই অংশকে পোনর (ponor) বলে।
GLOSSARY
1. কাস্ট জন্মল (Karst Region): কাস্ট অঞ্চল হল প্রধানত ভৌম জলপ্রবাহের দ্রবণের দ্বারা সৃষ্ট চুনাপাথরের বিভিন্ন ভূচিত্র(landscape)। কাস্ট অঞ্চলকে কাস্টভূমিও বলা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় কাস্টভূমি থাকলেও প্রধান কার্স্টভূমিটিকে পাওয়া যায় এড্রিঅ্যাটিক সাগরের পূর্ব উপকূলে দিনারিক আয়স অঞ্চলে। এর দৈর্ঘ্যা প্রায় ১০০ কিমি, প্রস্থ 75 কিমি, আয়তন প্রায় 20,250 বর্গ কিমি। ভারতে কাস্টভূমি দেখা যায় উত্তরপ্রদেশে দেরাদুন অঞ্চলে। মধ্যপ্রদেশের পাঁমোরি অঞ্চলে ও মেঘালয়ের চেরা মালভূমিতে।
2. গ্রানাইট (Granite): গ্রানাইট একটি কেলাসিত আগ্নেয়শিলা, প্রধান খনিজগুলি হল কোয়ার্টজ, ফেল্ডস্পার, মাইকা, হর্নব্রেন্ড, অগাইট ইত্যাদি। বর্ণ হালকা-গোলাপি সাদা ও কালো ছিট ছিট দাগযুক্ত। গ্রানাইটে সিলিকার 35 শতাংশ বা তার কম। প্রানাইট শিলার দানাগুলি বড়ো হওয়ায় খালি চোখে দেখা যায়। ভারতে প্রচুর গ্রানাইট পাথর রয়েছে। মধ্য ভারতে প্রায় সব রাজ্যে গ্রানাইট শিলা পাওয়া যায়।
3. চুনাপাথর (Limestone): কার্বনেট জাতীয় পাললিক শিলা হল চুনাপাথর। ক্যালসাইট হল চুনাপাথরের প্রধান খনিজ। তাছাড়া ফেল্ডস্পার, পাইরাইট, সিডেরাইট অল্প পরিমাণে থাকতে পারে। জৈব অথবা অজৈব প্রক্রিয়ায় চুনাপাথর গঠিত হতে পারে। অধিকাংশ চুনাপাথরই জীবাশ্ম সমৃদ্ধ। চুনাপাথরে তাপ দিলে ক্যালসিয়াম আক্সাইড (CaO এবং CO₂) উৎপন্ন হয়। এভাবে চুণ তৈরি করা হয়। সিমেন্ট তৈরির প্রধান কাঁচামাল হল চুনাপাথর।
4. নদী ব্যবস্থা (Drainage Network): কোনো অঞ্চলে মূলনদী, উপনদী প্রউপনদী, শাখা-প্রশাখা নদী ইত্যাদির সম্মিলিত বিন্যাসের দ্বারা যে নকশা বা গঠন ভলিঙ্গর সৃষ্টি হয় তাকে জলনির্গম প্রণালী বা ব্যবস্থা বলে। এটি ওই অঞ্চলের প্রাথমিক ভূমির ঢাল, শিলার বিন্যাস, শিলার কাঠিন্য ও ভূগঠনের উপর নির্ভর করে। প্রধান কয়েকটি নদী ব্যবস্থা হল বৃক্ষরূপী, জাফরিরূপী, আয়তক্ষেত্ররূপী, কোণীয়, সমান্তরাল ইত্যাদি।
5. পাইরোক্লাস্ট (Pyroclasts): পাইরোক্লাস্ট হল, এক ধরনের ক্লাস্টিক আগ্নেয় শিলা যা বিস্ফোরক অগ্ন্যুৎপাতে নির্গত হয়। এক্ষেত্রে অগ্ন্যুৎপাতের বিস্ফোরণে শলাগুলি টুকরো হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। এদেরকে পাইরোক্লাস্ট বলে। পাইরোক্লাস্ট-এ ছোটো-বড়ো সবরকম পদার্থ থাকে। সেইসঙ্গে আগ্নেয় ছাই ও গ্যাস থাকে। এদের আকার 0.25 মিমি থেকে 64 মিমি বা তারও বেশি ব্যাসযুক্ত হয়। অনেক সময় পাইরোক্লাস্ট উত্তপ্ত গতিশীল প্রবাহ রূপে বাইরে বেরিয়ে আসে। এই পথে যা কিছু থাকে তা নিমেষে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এর বেগ 200 মি/সেকেন্ড মতো হয়।
6. ব্যাসল্ট (Basalt): ব্যাসল্ট নিঃসরণে আগ্নেয় শিলার উদাহরণ এটি সুক্ষ্ম কেলাসযুক্ত গাঢ় বর্ণর শিলা। প্ল্যাজিওক্লেজ ফেল্ডস্পার, পাইরকিক্সিন, অলিভিল, হর্নব্লেন্ড ইত্যাদি হল প্রধান খনিজ পদার্থ। ব্যাসল্টে ম্যাগনেসিয়াম ও লোহার পরিমাণ বেশি থাকে তাই তুলনামূলক ব্যাসল্ট পাওয়া যায়। ট্রাম লাইন ও রেললাইনের পাথর ব্যাসল্ট শিলা। ব্যাসল্ট শিলা দিয়ে সমুদ্র উপকূলের ধার বাঁধানো হয়।
7. লিথোলজি (Lithology): কোনো শিলার ভৌত বৈশিষ্ট্যকে লিখোলজি বলে। এই বৈশিষ্ট্যগুলি খালি চোখে কিংবা ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে সহজে চেনা যায়। বৃহৎ অর্থে এটি ভূতত্ত্বের একটি শাখা যেখানে শিলার উৎপত্তি, গঠন এবং সমগ্র পৃথিবী জুড়ে এর বিস্তারকে অধ্যয়ন করে। সুতরাং লিখোলজি থেকে আমরা জানতে পারি শিলার সম্পূর্ণ চরিত্র। অর্থাৎ শিলাটি কঠিন না নরম, ক্ষয়ের জন্য প্রতিরোধী না ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয় ইত্যাদি। লিথোলজির নামকরণ শিলার প্রকারের উপর ভিত্তি করে করা হয়।