আইসোপ্লেথ পদ্ধতি ও আইসোল্লেথ মানচিত্র-এর প্রস্তুতি (isopleth method and preparation of isoleth map or isoline map)
ধারণা (concept)
ভূমির উচ্চতা, ভূমির ডাল, বায়ুর চাপ, বায়ুর উয়তা, বৃষ্টিপাত ইত্যাদি উপাদানগুলির তীব্রতা ধীরে বাড়ে বা কমে। এই উপাদানগুলি কোনো প্রশাসনিক সীমানা দ্বারা আবন্ধ বা নির্দিষ্ট থাকে না। বাস্তবের সঙ্গো এ ধরনের মিল রাখতে সমমান রোযার মাধ্যমে ভূমির উচ্চতা, ভূমির ঢাল, বায়ুর উন্নতা, বৃষ্টিপাত প্রভৃতির ক্রমপরিবর্তন বোঝাতে সমমানরেখার (iso-line or isopleth) প্রয়োজন হয়। 1. K. Wright এর মতে, একটি সমমানরেখা একটি পরিমাণ নির্দেশ করে এবং ঐ রেখা মানচিত্রের যে যে স্থানের উপর দিয়ে টানা হয় সেই-সেই স্থান নির্দিষ্ট সমান মান নির্দেশ করে। উচ্চতা, উন্নতা, বৃষ্টিপাত প্রভৃতির সমমানযুক্ত অঞ্চলগুলিকে মানচিত্রে যুক্ত করে যে রেখা পাওয়া যায় তাকে সমমান রেখা (Isoline, ISO = equal বা সমান এবং line = রেখা) বলে। ইংরেজিতে 'isoline' শব্দের প্রতিশব্দ হল 'Isopleth' (দুটি গ্রিক শব্দ iso অর্থাৎ equal বা (৪) সমান এবং plethos অর্থাৎ magnitude or crowd বা পরিমাণ ব্য সংখ্যা) যে পদ্ধতিতে এই সমমান রেখাগুলো টানা হয় তাকে isopleth method বলে। এবং মানচিত্রটিকে isopleth map বলে। অন্য কথায়, মানচিত্রে সমোন্নতি রেখা, সমোয় রেখা, সমবর্ষণ রেখা আঁকার জন্য ইন্টারপোলেশন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতি অনুসারে সম-মান রেখা (Isopleth-iso = equal = সমান; plethos = magnitude = crowd পরিমাণ বা সংখ্যা) দিয়ে মানচিত্রের বিভিন্ন স্থানগুলিকে যুক্ত করা হয়।
সংজ্ঞা (definition)
① মানচিত্রে অবস্থানকারী সমমানযুক্ত অঞ্চলগুলিকে একটি কাল্পনিক রেখার দ্বারা যোগ করলে যে রেখা পাওয়া যায়। তাকে সমমান রেখা (isoline) বলে। এই পদ্ধতিকে isopleth বলে। এবং প্রস্তুত মানচিত্রকে isopleth map বলে।
② মানচিত্রে প্রদর্শিত একই মানযুক্ত বিভিন্ন স্থানকে যুক্ত করলে যে রেখা পাওয়া যায় তাকে সমমানরেখা (iso-line) বা আইসোপ্লেথ (isopleth) বলে।
বৈশিষ্ট (characteristics)
(1)সমমান রেখাগুলি পরস্পরকে ছেদ করে না।
(2)সমমান রেখাগুলিতে অবস্থানকারী অঞ্চলগুলির প্রকৃতি একই রকম।
(3)প্রত্যেকটি সমরেখার একটিত নির্দিষ্ট মান থাকবে।
(4)রেখাগুলি যত কাছাকাছি অবস্থান করবে, উপাদানগুলির মানগত পার্থক্য তত বেশি হবে।
(5)মানচিত্রের মাঝখানে হঠাৎ করে কোনো সমরেখা শুরু বা শেষ হতে পারে না সাধারণত একপ্রান্ত থেকে শুরু হয়ে অন্য কোনো প্রান্তে গিয়ে শেষ হয়। তবে মানচিত্রের মাঝখানে আবন্ধ সমরেখা থাকতে পারে। অর্থাৎ উন্মুক্ত ও আবন্ধ দুই ধরনের সমরেখা হয়।
(6)সমরেখাগুলির মানের ব্যবধান হবে একই।
(7)প্রতিটি উন্মুক্ত সমরেখার প্রান্তভাগের উভয় প্রান্তেই এবং আবন্ধ সমরেখার ক্ষেত্রে মাঝখানে সমরেখার মান অবশ্যই উল্লেখ থাকবে।
(8)যখন সমরেখাগুলি খুব কাছাকাছি অবস্থান করে, তখন একটি নির্দিষ্ট ব্যবধানে সমরেখাগুলির মান লেখা হয়।
অন্তর্বর্তী মান নির্ণয় পদ্ধতি বাইন্টারপোলেশন (interpolation) পদ্ধতি:
দুটি বিন্দুর ভিন্নমান বিশিষ্ট মধ্যবর্তী সমমান বিশিষ্ট অংশগুলোকে যুক্ত করার পদ্ধতিকে ইন্টারপোলেশন পদ্ধতি বলে। অর্থাৎ এক স্থান বিন্দু থেকে অন্য স্থান বিন্দুর মান কম বা বেশি হয়। তাই সমহারে মানের হ্রাস-বৃদ্ধি অনুযায়ী দুটি বিন্দুর অন্তর্বর্তী স্থানের মান নির্ণয়কে ইন্টারপোলেশন বলে। এই পদ্ধতি অনুসারে সমোয় রেখা, সমবর্ষণরেখা ও সমোন্নতি রেখা অঙ্কন করা হয়।
ইন্টারপোলেশন পদ্ধতির সমস্যা(problem of interpolation method):
অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় যে স্থান বিন্দুর আয়তক্ষেত্রিক অবস্থানের ক্ষেত্রে এক কর্ণ বরাবর বিপরীত দুটি বিন্দুতে মান বেশি এবং অন্য কর্ণ বরাবর বিপরীত বিন্দুদ্বয়ের মান কম হয়। অর্থাৎ দুদিকে উঁচু স্থান ও দুদিকে নীচু স্থান পাওয়া যায়। এদের মধ্যবর্তী স্থানটি স্যাডল তৈরি করে। এই অবস্থানকে স্যাডল অবস্থা (saddle situation) বলা হয়। এদের অন্তর্বর্তী মান নির্ণয় খুবই সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে কর্ণদ্বয়ের ছেদবিন্দুতে চারটি মানের গড়কে বসিয়ে অন্তর্বর্তী মান নির্ণয় করা হয় এবং সেই অনুযায়ী সমমানরেখা (isoline) অঙ্কন করা হয়।
সমমানরেখার গুরুত্ব ও ব্যবহার(importance and uses of isoline)
(1)দৈশিক বা স্থানগত পার্থক্য বোঝাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমমানরেখার অঙ্কন ও ব্যবহার করা হয়। যেমন-সমোয়রেখা, সমচাপরেখা, সমবর্ষণরেখা ইত্যাদি।
(2)সমুদ্র জলে লবণাক্ততার পরিমাণ দেখাতে সমলবণাক্ত রেখা (isohaline) টানা হয়।
(3)ভূমির উচ্চতা, প্রকৃতি ও ভূমির ঢাল নির্ণয়ে সমোন্নতি রেখা পাঠ করা হয়।
(4)রাস্তাঘাট, বাঁধ, সেতু, জলাশয় প্রভৃতি নির্মাণের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচনের জন্য সমোন্নতি রেখা পাঠ করা হয়।
(5)আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য উয়তা, বৃষ্টিপাত প্রভৃতির বন্টন বিশ্লেষণ করতে হয়। ফলে মানচিত্রে সমোয় রেখা, সমপ্রেষ রেখা, সমবর্ষণ রেখার অবস্থান, আকৃতি ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করা দরকার হয়।
(6)সামরিক প্রয়োজনেও এই রেখা ব্যবহৃত হয়।
সমমানরেখার অঙ্কন পদ্ধতি (method of drawing isoline)
① বিভিন্ন প্রয়োজনে সমমান রেখা আঁকার জন্য সাধারণত মানচিত্রের বিভিন্ন জায়গায় উচ্চতা, উন্নতা, বায়ুর চাপ, বৃষ্টিপাত ইত্যাদির পরিমাণ উল্লেখ করা থাকে। যদি আলোচ্য মানগুলি মানচিত্রের নির্দিষ্ট স্থানে উল্লেখ করা না থাকে, তবে সেই মানগুলি সংশ্লিষ্ট সারণিতে দেওয়া থাকবে। সেক্ষেত্রে যে স্থানের যে মান সারণিতে লিপিবদ্ধ করা রয়েছে। সেই মানগুলি মানচিত্রে নির্দিষ্ট স্থানের অবস্থান অনুযায়ী বসিয়ে নিতে হবে।
② প্রয়োজন অনুসারে অন্তবর্তী মান নির্ণয় বা ইন্টাপোলেশন interpolation) পদ্ধতির সাহায্যে সমমান নির্ণয় করতে হবে এবং রেখাগুলি আঁকতে হবে। বস্তুত, দুটি নির্দিষ্ট স্থানে উল্লেখ করা দুটি নির্দিষ্ট মানের ভিত্তিতে ওই মুটি মানের মধ্যবর্তী কোনো মানের অবস্থান খুঁজে নেওয়ার উপায় হল ইন্টারপোলেশন পদ্ধতি। ধরা যাক, এ নামক স্থানের উচ্চতা 580 মিটার ও ৪ স্থানের উচ্চতা 630 মিটার এবং এই দুই মানের ভিত্তিতে আমাদের 600 মিটার উচ্চতার অবস্থান জানতে হবে। এজন্য কতকগুলি কাজ ধাপে ধাপে সেরে নিতে হবে। যেমন-
ধাপ-: দুটি নিকটবর্তী স্থানকে সরলরেখায় যুক্ত করতে হবে (উদাহরণ অনুসারে এ ও ৪ দুটি স্থানকে সরল রেখার সাহায্যে মানচিত্রে সংযুক্ত করা হল)
ধাপ-: সরল রেখাটির দৈর্ঘ্য মাপতে হবে (ধরা যাক, প্রদত্ত উদাহরণের ভিত্তি AB সরলরেখার দৈর্ঘ্য হল 2.5 সেমি বা 25 মিলিমিটার।
ধাপ-: অঙ্কিত সরলরেখার দুই প্রান্তের দুই স্থান বিন্দুর মানের পার্থক্য নির্ণয় করতে হবে (উদাহরণ অনুসারে, A ও B এই দুই স্থানবিন্দুর মান যথাক্রমে 580 মিটার ও 630 মিটার। অতএব, দুই স্থানবিন্দুর মানের পার্থক্য হল 50 মিটার।
ধাপ-: অঙ্কিত সরলরেখার দুই প্রান্তের কোনো একটি স্থানবিন্দুর মানের সঙ্গে নির্বাচিত মানের পার্থক্য নির্ণয় করতে হবে (উদাহরণ অনুযায়ী, AB সরলরেখায় ৪ স্থানবিন্দুর মান 630 মিটার এবং নির্বাচিত মান 600 মিটার। অতএব এই দুই মানের পার্থক্য 30 মিটার)।
ধাপ-: অঙ্কিত সরলরেখার ওপর নির্বাচিত মানের অবস্থান নির্ণয় করার জন্য ঐকিক নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। (উদাহরণ অনুসারে, মানচিত্রে (630 মিটার 580 মিটার) = 50 মিটার উচ্চতার পার্থক্য হয়েছে 25 মিলি-মিটারে।
বা, মানচিত্রে 1 মিটার উচ্চতার পার্থক্য হয়েছে 25 মিলিমিটারে। 50
বা, মানচিত্রে 30 মিটার উচ্চতার পার্থক্য হয়েছে 25 মিলিমিটারে ×30=15 মিলি-মিটার) 50
ধাপ-: পঞ্চম ধাপে প্রাপ্ত দূরত্ব মান অনুযায়ী অঙ্কিত সরলরেখার ওপর নির্বাচিত মানের অবস্থান নির্দেশ করতে হবে (উদাহরণ অনুয়ারী, ৪ স্থানবিন্দুর 630 মিটার উচ্চতার সাপেক্ষে নির্বাচিত মান মিটারের পার্থক্য ছিল 30 মিটার। অর্থাৎ AB সরলরেখার ওপর ৪ থেকে এ-এর দিকে 15 মিলিমিটার মাপ নিলেই 600 মিটার উচ্চতার অবস্থান মানচিত্রে দেখানো যাবে।
এইভাবে দরকার মতো মানচিত্রের অন্যান্য জায়গায় 600 মিটারের আরও অবস্থান খুঁজে নিতে হবে এবং প্রত্যেকটি মিটারের অবস্থানকে মসৃণ রেখায় যোগ করে দিলেই 600 মিটারের সমোন্নতি রেখা অঙ্কন করা সম্ভব হবে। এখানে দুটি কথা মনে রাখতে হবে। [1] সঠিক মাপ না নিয়ে চোখে দেখে আন্দাজে সমমান রেখা আঁকা উচিত নয়। এতে ভুল হবে। ফলে সমমান রেখা অঙ্কনের উদ্দেশ্য নষ্ট হবে। [ii] ওপরের যে পদ্ধতি ধাপে ধাপে বর্ণনা করা হল সেই পদ্ধতি অনুসরণ করলে যে কোনো সমমান রেখা, যেমন, সমোন্নতি রেখা, সমবর্ষণ রেখা সমপ্রেষ রেখা ইত্যাদি আঁকতে কোনো অসুবিধে হবে না।
সমমানরেখা মানচিত্রের প্রস্তুতকরণ (preparation of isoline map)
(1)কী কী ব্যবধানে কী কী মানের সমমান রেখা (isoline) আঁকবে লক্ষ্য কর।
(2)অঙ্কন পদ্ধতি অনুসারে নির্দিষ্ট মানগুলোর জন্য অন্তত ১টি করে সমমান রেখা আঁকো।
(3)মানচিত্রের অপর কোনো দিকে এই মানের সমমান রেখা আঁকা গেলে কয়েকটি সমমানরেখা এঁকে দাও।
(4)কোনো সমমান রেখা যেন মানচিত্রের মধ্যে হঠাৎ শুরু বা শেষ না হয়; এক প্রান্তে শুরু হয়ে অপর প্রান্তে শেষ হয় তবে মানচিত্রের ভেতরে শুরু ও শেষ বিন্দু একই হলে অর্থাৎ সমমানরূপে বেষ্টনীবন্ধ হলে তা আঁকবে।
(5)সমমান রেখা যেখানে শুরু বা শেষ তার যেকোনো প্রান্তে অথবা উভয়প্রান্তে সমমান রেখার মানটি লিখতে হবে।বেষ্টনীকৃত সমমান রেখার মান রেখার মধ্যে লিখবে।
(6)আঁকা হয়ে গেলে মানচিত্রের জন্য একটি heading লেখো।
(7)মানচিত্রের ডানপাশের নীচের অংশে কী কী মানের সমমান রেখা আঁকা হয়েছে লিখে দাও বা index করে বিভিন্ন শেড-এর দ্বারা (zones) প্রকাশ কর।