ভারতের শিল্পক্ষেত্রে উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ ও বিশ্বায়নের গুরুত্ব (Importance of Liberalization, Privatization and Globalization on Indian Industries)
বাজার অর্থনীতির তিনটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হল উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ এবং বিশ্বায়ন (Liberalization, Privatization and Globalization সংক্ষেপে LPG)। ভারতে এই LPG পর্ব শুরু হয় 1991 সালের জুলাই মাস থেকে।
উদারীকরণ (Liberalization)
কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাধা ও বিধিনিষেধের অপসারণকে উদারীকরণ বা ইংরাজিতে "লিবারালাইজেশন” (Liberalization) বলে। শিল্পক্ষেত্রসহ অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ যত কমে, বেসরকারি উদ্যোগ যত বেশি অর্থনৈতিক কাজে অংশ নেয়, উদারীকরণের গতি তত বৃদ্ধি পায়।
শিল্পে উদারীকরণের উদ্দেশ্য হল- (i) দেশীয় শিল্প বা কোম্পানিগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়ানো, (ii) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিধি বৃদ্ধি করা যাতে রপ্তানি বাড়ে, (iii) শিল্পক্ষেত্রে বিদেশি মূলধন ও প্রযুক্তি বাড়ানো, (iv) উৎপাদিত দ্রব্যের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করা ইত্যাদি।
বেসরকারিকরণ (Privatization)
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগগুলির সংখ্যা কমিয়ে বেসরকারি উদ্যোগের পরিধি বৃদ্ধি করাকে বেসরকারিকরণ বা ইংরাজীতে “প্রাইভেটাইজেশন” (Privatization) বলে। বেসরকারিকরণের ফলে সরকারি মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ করে বিলগ্নীকরণ (Disinvestment) এবং সরকারি মালিকানা প্রত্যাহারের (withdrawal) মাধ্যমে বেসরকারিকরণের পর প্রশস্ত হয়।
শিল্পে বেসরকারিকরণের উদ্দেশ্য হল- (i) বিলগ্নীকরণের মাধ্যমে পুঁজি বৃদ্ধি করা, (ii) উপভোক্তাদের জন্য আরে ভালো পণ্য ও পরিসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা, (iii) শিল্পে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (FDI) বাড়ানো, (iv) সরকা সংগঠনগুলির দক্ষতা বৃদ্ধি করা ইত্যাদি।
বেসরকারিকরণ তিন ধরনের, যথা- (i) বিরাষ্ট্রীকরণ (Denationalization) অর্থাৎ রাষ্ট্রায়ত্ব কোনো কোম্পানির 100 শতাংশ শেয়ার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা, (ii) আংশিক বেসরকারিকরণ (Partial privatization) অর্থাৎ কোনো রাষ্ট্রায়ত্ব কোম্পানির 50 শতাংশের বেশি মালিকানা বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া, এবং (iii) প্রতীতী বেসরকারিকরণ (Token privatization) অর্থাৎ কোনো রাষ্ট্রায়ত্ব কোম্পানির মাত্র 5-10% শেয়ার বেসরকারি উদ্যোগের কাছে বিক্রি করা।
বিশ্বায়ন (Globalization)
বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে দেশীয় অর্থনীতির সংযোগ স্থাপনের প্রক্রিয়াকে বিশ্বায়ন বা ইংরেজিতে “গ্লোবালাইজেশন" (Globalization) বলে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বেসরকারিকরণ ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেশকে বিশ্বায়নের পথে চালিত করা হয়।
শিল্পক্ষেত্রে বিশ্বায়নের উদ্দেশ্য হল – (i) পৃথিবীর এক বাজার থেকে অন্য বাজারে পণ্য, পরিসেবা ও শ্রমিকের বাধাহীন
সরবরাহ, (ii) বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের (FDI) পরিমাণ বাড়ানো, (iii) দেশজ অর্থনীতির অনুৎপাদক ক্ষেত্রগুলিতে বিনিয়োগ আহ্বান করা, (iv) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিধি বিস্তার করা, যাতে প্রতিটি দেশই তার নিজস্ব পণ্যগুলিকে বিশ্বের বাজারে বিক্রি করতে পারে।
ভারতে LPG-র গুরুত্ব (Importance of LPG in India)
1991 সালের 24 জুলাই ভারত তার নতুন শিল্পনীতি (New Industrial Policy -1991) এই শিল্পনীতি ভারতে মুক্ত দরজা নীতি বা Open Door Policy-র পথ প্রশস্ত করে। ভারতে উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ ও বিশ্বায়নের (LPG) পর্ব শুরু হয়। কারণ ওই সময়ে দেশে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় মাত্র তিন সপ্তাহের আমদানি মেটানোর উপযুক্ত 100 কোটি (1 বিলিয়ন) ডলারে নেমে আসে। মুদ্রাস্ফীতির হার দাঁড়ায় প্রায় 17 শতাংশ এবং GDP-র 8-2 শতাংশ পরিমাণ বিপুল রাজস্ব ঘাটতির (fiscal deficit) সৃষ্টি হয়। এই সংকটের অবস্থা থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার খোলা বাজার অর্থনীতির পথকে বেছে নেয়। - 1991) প্রকাশ করে।
আলোচ্য লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপগুলি হল—
(i) 1991 সালের জুলাই মাসে ভারতীয় মুদ্রার মূল্য 18-19 শতাংশ হ্রাস করা হয় (Devaluation)। আমদানি-রপ্তানি। জন্য নির্দিষ্ট তৎকালীন নিয়মও (EXIM Policy) শিথিল করা হয়। ফলে উপসাগরীয় যুদ্ধ (Gulf War) ও অন্যান্য আর্থি কারণে ভারতে যে বাণিজ্য ঘাটতির সৃষ্টি হয়, তার পরিমাণ কমে।
(ii) শিল্পক্ষেত্রে বিলগ্নীকরণ শুরু হয়। DIPAM বা Department of Investment and Public Asset Management-এর নেতৃত্বে 31টি রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা (Public Sector Undertaking) বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বিক্রি করে 1991-1992 অর্থবর্ষে 3,037 কোটি টাকা সংগৃহীত হয়। (ii) শিল্পে লাইসেন্স প্রথা প্রায় তুলে দেওয়া হয়। মাত্র 6টি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রকে বেসরকারি
(iii) বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এছাড়া সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে চা বাগান ও নগরায়ণ ক্ষেত্রে 100%, প্রতিরক্ষা ও বিমা 26% FDI-এর জন্য খুলে দেওয়া হবে।
(iv) MRTP আইন বা Monopolistic and Restrictive Trade Practices Act, 1969-কে সম্পূর্ণ ভাবে বিলোপ করা হয়।
(v) কিছু কিছু পণ্যের ওপর 300 শতাংশ আবগারি (Customs) শুল্ক 30 শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। ফলে আমদানি বাড়ে। বিভিন্ন বিদেশি পণ্য দেশীয় বাজারে স্থান পায়।
মূল্যায়ন :
আলোচ্য পদক্ষেপগুলি থেকে যে সুবিধা বা অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি হয়, তা হল—
(1) ভারতে শিল্পসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উদারীকরণের হার এখনও নিয়ন্ত্রিত রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ফলে দেশের বাজার সম্পূর্ণভাবে বিদেশি বেসরকারি উদ্যোগের জন্য উন্মুক্ত হয়নি। UNCTAD প্রতিবেদন 2012 অনুসারে এর ফলে ভারতে অর্থনৈতিক প্রগতির হার দ্রুত নয়। (তথ্যসূত্র ঃ Twenty Years of India's Liberalization : Experiences and Lessons, UNCTAD, 2012)
(2) লোক আদালত (Lok Adalat), দেনা পুনরুদ্ধার ট্রাইবুনাল (Debt Recovery Tribunal), সম্পদ পুনর্গঠন কোম্পানিগুলি (Asset Restructuring Companies) গড়ে তোলার ফলে ভারতে বিশ্বায়নের সুযোগ বেড়েছে। শুধু তাই নয় ব্যাংক ও বিমা ক্ষেত্রে FDI-এর সীমা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ভারতে ব্যাবসা করা সহজ হয়েছে (ease of doing business)। (তথ্যসূত্র : (i) Bhandari L. et al, 2003, Development of Financial Institutions ... Journal of Emerging Market Finance, 2:83-121, (ii) Das, A. et al., 2005, Liberalization, Ownership and Efficiency in Indian Banking ... EPW, 19 March 1190-1197)।
(3) 1992 সাল থেকে ভারতীয় মুদ্রা ও বিদেশি মুদ্রার বিনিময় যোগ্যতা (convertibility of rupee) সহজ করে দেওয়ার ফলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া ব্যাবসার পরিমাণ অনুসারে ভারতের National Stock Exchange (INSE) বিশ্বে পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে (তথ্যসূত্র : UNCTAD, 2012, পূর্বোল্লেখিত)।
(4) শিল্পজাত পণ্যের খুচরো ব্যবসায়ে ভারতের বাৎসরিক প্রগতি হার বর্তমানে গড়ে 20 শতাংশ (তথ্যসূত্র : Assocham India, 2017)।
(5) BPO, সিমেন্ট, ফার্মাসিউটিক্যাল, কেমিক্যাল বা রাসায়নিক, পেট্রোলিয়াম, ইস্পাত ও বয়ন শিল্পে উদারীকরণ ও বিশ্বায়নের মিশ্র প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে।
তবে বিশ্বায়ন ও উদারীকরণ প্রক্রিয়ার কিছু অভ্যন্তরীণ সমস্যা আছে, যার ফলে ভারতের শিল্পক্ষেত্রসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে আগামী দিনে অসুবিধায় পড়তে হবে পারে বলে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যেমন—
(1) বিদেশি পণ্য অনেকক্ষেত্রেই ভারতীয় পণ্যের তুলনায় দামে সস্তা এবং তা যথেষ্ট আকর্ষণীয়। ফলে ভারতে উৎপাদিত পণ্য প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে, যেমন- চিনা ইলেকট্রনিক পণ্যের সঙ্গে ভারতীয় ইলেকট্রনিক পণ্যের প্রতিযোগিতা ভারতের পক্ষে ভালো হয়নি।
(2) ভারতে ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে গবেষণা ও উন্নতির (R and D-র) সুযোগ এখনও যথেষ্ট সীমিত ব ভারতের বাজারে বিদেশি ওষুধ এবং বিদেশি চিকিৎসার সরঞ্জাম লাভজনক বাজার তৈরি করেছে। WTO-র TRIP (Trade Related Aspects of Intellectual Property Rights) সংক্রান্ত অধিকার এক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলিতে ভারতের তুলনায় বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় রেখেছে।
(3) উন্নত বিদেশি প্রযুক্তি ভারতে অপ্রতিহত ভাবে আসার ফলে ভারতে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা যতটা বেড়েছে, সে তুলনায় মধ্যম দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা তত বাড়েনি। (তথ্যসূত্র : P. Vashisht, 2017, Destruction or Polarization : Estimating Impact of Technology of Jobs in Indian Manufacturing, ICRIER, March 2017:1- 21)। আশঙ্কা করা যায় এর ফলে বেকার সমস্যা আরো তীব্র হবে।
(4) বিশ্বায়ন ও উদারীকরণের প্রভাবে ব্যাংকে সঞ্চিত আমানতের ওপর সুদ কমছে। ফলে সাধারণ গ্রাহক বিশেষ স্বল্প পুঁজির বৃদ্ধ অবসরপ্রাপ্ত গ্রাহকদের সঞ্চয় কমছে। এদিকে রিজার্ভ ব্যাংক (RBI) GDP-কে উৎসাহিত করার লক্ষে “রেপো রেট” (Repo Rate) হ্রাস করছে। বর্তমানে এই হার 5.40 শতাংশ (আগস্ট, 2019)।
সুতরাং উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ ও বিশ্বায়ন ভারতের শিল্প, ব্যবসায় ও কৃষিক্ষেত্রে মিশ্র প্রভাব ফেলেছে। এতৎসত্ত্বেও ভারত আশা করছে আগামী 2025 সালের মধ্যে দেশের অর্থনীতি 5 লক্ষ কোটি ডলার (5 ট্রিলিয়ন ডলার)-এর সীমা স্পর্শ করবে। বর্তমানে এই পুঁজির আয়তন প্রায় 2-8 লক্ষ কোটি ডলার (2-8 ট্রিলিয়ন ডলার) [আগস্ট 2019-এর তথ্য অনুসারে)।