মাটি সৃষ্টির পরোক্ষ উপাদান(Passive Factors of Soil Formation)
ভূপ্রকৃতি (Relief)
ভূপ্রকৃতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাটির গঠনকে নিয়ন্ত্রণ করে। ভূপ্রকৃতির মধ্যে ভূমির ঢাল (slope), উচ্চতা (altitude) প্রভৃতি মাটির গঠনকে প্রভাবিত করে। ভূপ্রকৃতিতে ঢালের পরিমাণ ও তার প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে মাটির গঠন এবং তার চরিত্র। ঢালু পার্বত্য অঞ্চলে যান্ত্রিক আবহবিকারের ফলে সৃষ্ট শিলাচূর্ণ সহজেই ঢাল বেয়ে স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু সমভূমিতে আবহবিকারের ফলে সৃষ্ট শিলাচূর্ণ নিজ স্থানেই (in-situ) পড়ে থাকে এবং একটি সম্পূর্ণ স্তরযুক্ত মাটিতে সৃষ্টিতে সহায়ক হয়ে থাকে, যাকে স্থানীয় মাটি (zonal soil) বলে। আবার গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে হিমালয় পর্বত থেকে বয়ে আসা পদার্থ শিলাচূর্ণের সাথে মিশে, যে মাটি সৃষ্টি করে তাকে অনাঞ্চলিক মাটি (azonal soil) বলে। জলাভূমিতে এবং জলাশয়ের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মাটি সৃষ্টির প্রক্রিয়া নানা দিক থেকে ব্যাহত হয় এবং সেখানে এক অসম্পূর্ণ স্তরযুক্ত ও মিশ্র প্রকৃতির বিশেষ ধরনের মাটি পাওয়া যায়। একে বলা হয় আন্তঃআঞ্চলিক (intra-zonal soil) মাটি। ঢালু জমিতে মাটি ক্ষয়ের পরিমাণও বেশি হয় বলে পাতলা অপরিণত স্তরযুক্ত মাটি পাহাড়ের ঢালে দেখা যায়। কিন্তু পার্বত্য পাদদেশে স্তরযুক্ত পুরু মাটি স্তর দেখা যায়। এখানে মাটি ক্ষয় প্রায় হয় না বললেই চলে। ভূপ্রকৃতিকে ঢাল ও উচ্চতার তারতম্যের ভিত্তিতে ওটি ভাগে ভাগ করা যায়। এই বিভিন্ন ধরনের ঢালযুক্ত ভূপ্রকৃতি মাটি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
(i) সমভূমি বা মৃদু ঢালযুক্ত ভূমি (Plain): সমভূমিতে ভূমির উচ্চতা গড় সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় 300 মিটারের কাছাকাছি। যদি কোনো অঞ্চলে ভূপ্রকৃতি সমতল হয়, তাহলে ওই অঞ্চল মাটি গঠনের আদর্শ স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। এই ভূমিভাগে বৃষ্টির জল প্রচুর পরিমাণে ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মাটি গঠন কর। অর্থাৎ এই স্থানে ধৌত প্রক্রিয়া অধিক কার্যকরী হয়। সেইসঙ্গে মাটির গভীরতা বৃদ্ধি পায়। আবার এই অঞ্চলে ঢাল কম হওয়ায় ভূমিক্ষয় কম হয়। এই ধরনের ভূমিভাগে সবকটি Horizon সুস্পষ্ট ভাবে লক্ষ করা যায় বলে এখানে আঞ্চলিক মাটি গড়ে ওঠে।
(ii) মালভূমি বা মাঝারি ঢালযুক্ত ভূমিভাগ (Plateau): এই স্থানটির উচ্চতা গড় সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় 400-700 মিটার। এই স্থানে ভূমির ঢাল মাঝারি হওয়ায় বৃষ্টির জল কম ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। ফলে ধৌত প্রক্রিয়া খুব একটা কার্যকরী হয় না। সেইসঙ্গে আবহবিকারজাত পদার্থ নীচের দিকে চলে আসায় মাটির স্তরের পুরুত্ব বৃদ্ধি পায় না। সুতরাং মাটি সৃষ্টির প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এই অঞ্চলে মাটির গভীরতা 50-100 সেমির মধ্যে অবস্থান করে।
(iii) পার্বত্য ভূমিভাগ বা উচ্চ ঢালযুক্ত ভূমি (Hily): উচ্চ ভূমিতে ভূমির উচ্চতা গড় সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় 900 মিটারের অধিক। এই স্থানে ভূপ্রকৃতি উচ্চ এবং ঢাল বেশি হওয়ায় বৃষ্টির প্রায় অধিকাংশ জলভূমির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে না। ফলে ধৌত প্রক্রিয়া প্রায় শূন্য। ফলে ওই অঞ্চলে মাটি সৃষ্টি হতে পারে না। মাটির স্তর খুবই পাতলা। এই পাতলা স্তরে কাদা কণা, বালি-কণা ও নুড়ি থাকে। কিন্তু এই পার্বত্য অঞ্চলে শিলার মধ্যে মাটি কণা অবস্থান করায় বড়ো বড়ো গাছগুলি দাঁড়িয়ে থাকে।
আদিশিলা (Parent Rock)
যে শিলা থেকে সাধারণত মাটির সৃষ্টি হয় তাকে মূলশিলা (parent rocks) বলে। মূলশিলার চরিত্র এবং অবস্থানের তারতম্যে মাটি সৃষ্টির মধ্যেও তার গুণাগুণের পার্থক্য লক্ষ করা যায়। যেমন ব্যাসল্ট জাতীয় মূলশিলা থেকে সৃষ্ট মাটির প্রকৃতি অনেকটা ক্ষারকীয় এবং কৃষ্ণবর্ণ যুক্ত হয়। আবার কোয়ার্টজাইট শিলার চূর্ণ ল্যাটেরাইট জাতীয় লোহিত বর্ণের মাটির সৃষ্টি করে। যার মধ্যে ফেরাস অক্সাইডের পরিমাণ বেশি থাকে।
সময় (Time)
মাটি সৃষ্টির ক্ষেত্রে সময়ের গুরুত্বকে উপেক্ষা করা যায় না। আবহবিকারগ্রস্ত শিলাচূর্ণ যত বেশি সময় ধরে মূলশিলার ওপর অবস্থান করে ততই তার অভ্যন্তরীণ গঠন (structure) এবং প্রথনের (texture) পরিবর্তন হতে থাকে ও বিভিন্ন স্তরযুক্ত পরিণত মাটি গড়ে ওঠে। আবহবিকার ইলুভিয়েশন এবং এলুভিয়েশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাটি সৃষ্টি হয়। এই দুই প্রক্রিয়া অতি ধীরে সম্পন্ন হয়। এজন্য নির্দিস্ট পরিলেখ বৈশিষ্ট্যযুক্ত পরিণত আঞ্চলিক মাটি গঠনে সময় লাগে বহু সহস্র বছর। সময়ের এইরূপ তারতম্যে নির্ভর করে মাটি গঠনে প্রভাব বিস্তারকারী অন্যান্য নিয়ন্ত্রক। যেমন, জলবায়ু, জীবমণ্ডল, ভূপ্রকৃতি, মূলশিলাখণ্ড প্রভৃতির পারস্পরিক ক্রিয়ার ওপরে। সাধারণত 2.50 সেমি বেধযুক্ত মাটি তৈরি হতে সময় লাগে প্রায় 100 বছর।
যদিও মাটির গঠনের ওপর সময়ের প্রভাব প্রত্যক্ষ নয়। কিন্তু দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে আগের বৈশিষ্ট্যগুলি একই থাকলেও মাটির পরিবর্তন ঘটে থাকে। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে সঙ্গেঙ্গ মাটির বিভিন্ন স্তরের প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটে। সময়ের ব্যাপ্তিনা থাকলে আবহবিকার কার্যকরী হত না। বিভিন্ন বিজ্ঞানী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন যে, সময়ের সাথে সাথে অবস্থানরত খনিজ পদার্থগুলি স্থানান্তর কিংবা সময় বৃদ্ধি পায়। সেইসঙ্গে মাটি পরিণত ও অপরিণত হতে থাকে।
মাটি বিজ্ঞানী গাইল এবং হলে (Gile and Hawley, 1968) সালে নিউ মেক্সিকোর মাটিতে গবেষণা করে দেখেছেন যে, 100 বছর মাটির 'A' স্তর গঠিত হয় এবং তাতে জৈব পদার্থ সহ পাললিক শিলাস্তর দেখা যায়। 100-1000 বছরে ওই মাটিতে সামান্য পরিমাণ কার্বনেট জমা হয় কিন্তু মূলশিলা ধ্বংস হয়ে যায়। সেই সঙ্গে সূক্ষ্ম শিলাচূর্ণের পুরু স্তর দেখা যায়। 1100-2100 বছরে ওই মাটিতে কিছু গ্রাভেল লক্ষ করা যায়। আবার 2200-4600 বছরে গ্রাভেলবিহীন মাটিতে অল্প কার্বনেট দেখা যায়। সেইসঙ্গে মাটির গঠনের একক তৈরি হয়। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ প্লাইস্টোসিন যুগের শেষ ভাগে কাদার আস্তরণ যুক্ত '৪' স্তর গড়ে ওঠে।
এই সময়ের তারতম্যে কতকগুলি ভৌগোলিক কারণ হয়েছে। সেগুলি হল- (a) আবহবিকারের হার, (b) আদিশিলার প্রকৃতি, (c) পলির সঞ্চয়, (d) লোয়েস সঞ্চয়, (e) ভূমির আন্দোলন, এবং (f) পর্বতের পাদদেশে সঞ্চয়।
উপরিউক্ত মাটির গঠনের ব্যাখ্যাগুলি ছাড়াও মানুষের কার্যাবলি মাটি সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।
মানুষের কার্যাবলি (Human Activities)
সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে মানুষের কার্যাবলির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সভ্যতার আদি লগ্ন থেকে মানুষ গৃহায় বসবাস করত। পরবর্তী সময়ে তারা বনভূমি করে জীবিকা নির্বাহ করত। তারপর তারা স্থায়ী চাষাবাদের দ্বারা স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে পৃথিবীর বুকে অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের ওপর। সেইসঙ্গে বাড়তে থাকে তাদের সমস্ত ধরনের কার্যাবলি, যা ভূমিভাগকে ত্বরান্বিত করে অনেক ক্ষেত্রে মাটি সৃষ্টিতে সাহায্য করে। অর্থাৎ যে মানবীয় ভূদৃশ্য (human landscape) কিংবা সাংস্কৃতিক ভূদৃশ্য (cultural landscape) গড়ে উঠেছে তা কিন্তু এই সভ্য মানুষের দ্বারা। এদের বিভিন্ন ধরনের কার্যাবলি আদিশিলাকে বিয়োজিত করে মাটি সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে।