welcome to mygeo.in Indian no 1 geography based website in Bengali

ল্যাটেরাইট মাটি(Laterite Soil)

ল্যাটেরাইট মাটি(Laterite Soil)


উৎপত্তি (Origin)

ইংরেজ মাটি বিজ্ঞানী এফ, বুকানন (F. Buchanan, 1807) ভারতের দক্ষিণে কেরালা রাজ্যে পশ্চিমঘাট পর্বতের পাদদেশে মাটি সম্বন্ধে গবেষণা করতে গিয়ে এক ধরনের লাল বর্ণের মাটির সন্ধান পান। যা ল্যাটেরাইট নামে পরিচিত। লাতিন শব্দ লেটার (Later) কথাটির অর্থ ইটের মতো লাল। তাই তিনি ওই ইটের মতো লাল রঙের মাটির নাম দেন ল্যাটেরাইট। এতে লৌহ অক্সাইড (Fe₂O₃) অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড (AI₂O₃) ও ম্যাগনেশিয়াম অক্সাইড (MgO) ভূপৃষ্ঠ বরাবর কিংবা ভূপৃষ্ঠ থেকে বিভিন্ন গভীরতায় অনুভূমিকভাবে সঞ্চিত হয়েছে। এই মাটিতে লৌহ অক্সাইডের সঞ্চয়ের পরিমাণ বেশি বলে এর রং লাল। ল্যাটেরাইট এমন এক পদার্থ যা বিভিন্ন ধরনের আদি শিলার চরম আবহবিকারের অবশেষ হিসাবে প্রথমে আর্দ্র অবস্থায় নরম এবং পরে শুষ্ক পরিস্থিতিতে শক্ত হয়ে উঠতে পারে। এর পরবর্তী সময়ে মাটি বিজ্ঞানী এবং ভূবিজ্ঞানীরা ক্রান্তীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলে পাওয়া লৌহ অক্সাইড যুক্ত লাল রঙের এই শিলাকে নিয়ে অনেক বিতর্ক ও গবেষণার সম্মুখীন হয়েছেন। যদিও গবেষণার পরেও ল্যাটেরাইট সম্পর্কে সব সিদ্ধান্তকে শেষ বলে ধরা যায়নি। এই মাটির উৎপত্তি বিভিন্ন উপাদানের সাহায্যে গড়ে ওঠে, সেগুলি নীচে আলোচনা করা হল-

1. প্রধান উপাদান (Main Components): ভৌগোলিক ভাষাগত দিক দিয়ে, ল্যাটেরাইট একটি শিলা। আগ্নেয়, রূপান্তরিত এবং পাললিক শিলার খনিজ উপাদানগুলি থেকে এই মাটি সৃষ্টি হয়েছে। মূলত কঠিন শিলা থেকে এই মাটির উৎপত্তি। এছাড়া টার্সিয়ারি যুগে শিথিল সঞ্চয় কিংবা আগ্নেয়গিরি থেকে প্রাপ্ত ছাই দ্বারা এই মাটির সৃষ্টি।

2. জলবায়ু (Climate): সাধারণত উদ্বু ও আর্দ্র ক্রান্তীয় জলবায়ু এই মাটি সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। এই মাটির সৃষ্টির ক্ষেত্রে ঋতু অনুযায়ী বৃষ্টির তারতম্য যথেষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করে। এই মাটি গঠনের জন্য বার্ষিক গড় তাপমাত্রার পরিমাণ প্রয়োজন প্রায় 25°C এবং বছরে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় 100-120 সেমি দরকার। অনেক ক্ষেত্রে 200-250 সেমি বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলে এই মাটি গড়ে উঠতে লক্ষ করা যায়। এই ধরনের তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাতে লোহা সহজেই জারিত হয় এবং মাটির রাসায়নিক আবহবিকারসহ ধৌতকরণের হার বৃদ্ধি পায়।

3. স্বাভাবিক উদ্ভিদ (Natural Vegetation): এই ধরনের মাটি সৃষ্টিতে ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্য (tropical evergreen forest) কিংবা উপক্রান্তীয় পর্ণমোচী বনভূমি (sub-tropical deciduous forest) দেখা যায়। এছাড়াও সাভানা জাতীয় উদ্ভিদ বা তৃণভূমিতে এই মাটি ভালোভাবে উৎপত্তি লাভ করে। বর্ষা ঋতুতে বেশি পরিমাণ জৈব পদার্থ অপসৃত হয় মাটি থেকে। আবার অত্যধিক তাপমাত্রায় উদ্ভিদের দেহাবশেষ বেশি জারিত হয় বলে মাটিতে হিউমাসের পরিমাণ কমে যায়।

4. ভূপ্রকৃতি (Topography): এই মাটি মূলত সমভূমিতে উৎপত্তি লাভ করে। এছাড়াও মৃদু ঢাল থেকে মাঝারি ঢাল যুক্ত সমভূমিতে এই মাটি গড়ে ওঠে। এই মাটি 1200-1500 মিটারের অধিক উচ্চতায় উৎপত্তি লাভ করতে পারে না। এই মাটির উৎপত্তিতে ভূমিরূপের কতকগুলি প্রকৃতি বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। যেমন সমভূমির অবশিষ্ট উঁচু অংশ, উচ্চভূমির পাদদেশ, নিম্ন উচ্চতা বিশিষ্ট সমভূমি যেখানে জলস্তর উচ্চ, কিংবা যে অঞ্চলে ভৌমজলের স্তরের ওঠানামা করে। এই সমস্ত ভূমিরূপ যুক্ত স্থানে ল্যাটেরাইট গড়ে ওঠে।

উৎপত্তির প্রক্রিয়া (Process of Origin)

ল্যাটেরাইট জন্ম সম্পর্কে দুটি উল্লেখযোগ্য মত হল-(৯) ধৌত প্রক্রিয়ার ফলে ক্ষারক জাতীয় পদার্থ এবং সিলিকা মাটির উপরের স্তর থেকে নীচে নেমে গেলে বেশি স্থিতিশীল অবশিষ্ট পদার্থ ল্যাটেরাইট স্তরের সৃষ্টি করে। (৮) ল্যাটেরাইটকে অধঃক্ষেপ হিসাবে দেখানো হয়। এখানে নীচের স্তর থেকে লৌহ জাতীয় পদার্থ ওপরের দিকে উঠে এসে একটি লৌহ অক্সাইড সমৃদ্ধ স্তর তৈরি করে।

যে প্রক্রিয়ায় ল্যাটেরাইট জাতীয় মাটি সৃষ্টি হয় তাকে ল্যাটেরাইজেশন বলা হয়। এই প্রক্রিয়ায় সিলিকা বিমুক্ত ও অপসারিত হওয়ার জন্য মাটির হরাইজান sesquioxide-এর কেন্দ্রীভবন ঘটে। আবার অধিক তাপমাত্রায় রাসায়নিক আবহবিকার হওয়ার জন্য এর খনিজ উপাদান বিভিন্ন ধরনের অক্সাইডে এবং Geothite ও Kaolinite নামক কাদা জাতীয় খনিজে সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। আর্দ্র বিশ্লেষ প্রক্রিয়ার অগ্রগতির সঙ্গে প্রথমে সিলিকা পৃথক হয় এবং পরে তা অন্যান্য ক্ষারকীয় Cation ও বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে বিধৌতকরণ প্রক্রিয়ায় অপসারিত হয়। এই কারণে মাটির প্রস্থচ্ছেদে কঠিনতর অবশেষ বা Sesquioxides-এর কেন্দ্রীভবন হয়ে থাকে। মাটির যে অংশে জলের মাধ্যমে আবহবিকার হয়, সেখানে Kaolinite পুনঃবায়ু বণ্টিত হয় সেই সঙ্গে মাটির দানা ও পেডের ওপরে mottled কাদা হরাইজন সর্বাধিক লক্ষ করা যায়। সাধারণত অণুজীবীয় কার্যকলাপ এবং প্রসারণ ও সংকোচন প্রক্রিয়ায় এই mottled কাদা সমসত্ত্ব হওয়ার জন্য ল্যাটেরাইট জাতীয় মাটির Oric B Horizon-এ সৃষ্টি হয়।

বৈশিষ্ট্য (Characteristics)

(i) মাটির ওপরের স্তরে অ্যালুমিনিয়াম ও লোহা কণা দীর্ঘকাল ধরে জারিত হয়ে ইট ভাঙা সুরকির মতো লাল রঙের মাটির সৃষ্টি হয়।

(ii) অধিক বৃষ্টিপাতের জন্য মাটির ওপরের স্তরের খনিজ ও জৈব পদার্থসমূহ ধৌত প্রক্রিয়ায় নীচের স্তরে অপসারিত হয় বলে মাটি অনুর্বর হয়।

(iii) বড়ো বড়ো দানার কণাগুলি জমাট বেঁধে কঠিন হয়, ফলে মাটির জলধারণ করার ক্ষমতা কম ও কর্ষণ করা প্রায় অসম্ভব।

(iv) এই মাটি বায়ুতে উন্মুক্ত অবস্থায় রাখলে কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু জলমগ্ন স্থানে আয়রন সমৃদ্ধ হওয়ায় অর্থাৎ প্রথম দিকে বা নতুন অবস্থায় নরম থাকে। যা কোদালের সাহায্যে কাটা যায়।

(v) কঠিন অবস্থায় এই বস্তুটি স্কুল (massive), গাঢ় লাল বর্ণের সেই সঙ্গে রন্দ্র ও গহ্বরবিশিষ্ট হয়। আবার মাটি বিজ্ঞানী ওল্ডহাম (Oldham, 1859) মনে করেন যে, ল্যাটেরাইট শুধু স্কুল (massive) রূপে থাকে; শিথিল পিন্ড (loose nodule), জমাটবন্ধ পিন্ড (cemented nodule) ও পট্ট (plate) রূপেও থাকতে পারে।

(vi) এই মাটি আম্লিক প্রকৃতির এবং জৈব পদার্থ নেই বললেই চলে। কিন্তু জলসেচ ও সার প্রয়োগের মাধ্যমে তুলা, চা. কফি ও রবারের চাষ হয়।

(vii) এই জাতীয় মাটির প্রায় সমস্ত দিগন্তে (horizons) বালি-কাদা Urban থেকে বালি দোআঁশ জাতীয় গ্রথন এবং সমকোণিক ঘনক আকার গঠন দেখা যায়। 

(vii) এই মাটির Ah Horizon-এ বালির পরিমাণ প্রায় ৬০ শতাংশ এবং যতই নীচে যাওয়া যায় ততই বালির পরিমাণ হ্রাস পায়। অর্থাৎ Bws Horizon-এ প্রায় 40 শতাংশ।

(ix) এই মাটি প্রাচীন আগ্নেয় আদি শিলা থেকে উৎপত্তি লাভ করে। তাই এই মাটি ক্রান্তীয় উদ্বু-আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। অর্থাৎ বলয় আকারে গড়ে উঠেছে।

(x) এই জাতীয় মাটি আঞ্চলিক মাটি নামে পরিচিত। এই মাটি এশিয়া মহাদেশের অন্তর্গত ভারত, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, আফ্রিকা মহাদেশে কেনিয়া, সুদান, ইথিওপিয়া। দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্বাংশে সেই সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার অনেক জায়গায় লক্ষ করা যায়।

পরিলেখ (Profile)

হারাসোইজ (Harrassowiz) ল্যাটেরাইট মাটির নিম্নলিখিত তিনটি স্তরের উল্লেখ করেছেন।

1. A স্তর (A Layer): এই স্তরটি আয়রন অ্যালুমিনিয়াম, টাইটেনিয়াম প্রভৃতির অক্সাইড যৌগের দ্বারা সমৃদ্ধ। এই সমস্ত উপাদান জমাট বাঁধা স্তরের আকারে (freeugious incrustation) বা পিন্ডের (concretions) আকারে অবস্থান করতে দেখা যায়। এই স্তরের গভীরতা খুবই পাতলা থেকে এক মিটার বা তার বেশি পর্যন্ত হয়।

2. B স্তর (B Layer): এই স্তরটি নানা বর্ণের বিশেষত হলুদ ও বেগুনি ছাপ যুক্ত এবং সূক্ষ্ম কর্দম কণিকার দ্বারা গঠিত হয়। অবশ্য কোয়ার্জ সমৃদ্ধ বেলেপাথর থেকে উৎপন্ন ল্যাটেরাইট মাটির ক্ষেত্রে এই স্তরের প্রথন হয় স্কুল এবং সছিদ্র গঠন যুক্ত। এই প্রকার গঠনযুক্ত হওয়ায় কোনো কোনো সময়ে রশ্নগুলি ধূসর বাদামি বর্ণের উপাদান দ্বারা পূর্ণ থাকে। এই স্তরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ভিজে অবস্থায় এই স্তর অত্যন্ত কোমল হয়। কিন্তু শুকিয়ে গেলে কঠিন হয়ে পড়ে। ভিজে অবস্থায় একে ইটের মতো কেটে নিয়ে রোদে শুকিয়ে নিয়ে বাড়ি তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। এর কারণ হল কর্দম কণিকাগুলির স্থিতিস্থাপকতার (plasticity) স্বল্পতা। কাদাকণাগুলির ওপর আয়রন ও অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইডের আস্তরণ বা আবরণই স্থিতিস্থাপকতার স্বল্পতার অন্যতম কারণ। এরূপ ভৌত বৈশিষ্ট্যের জন্য কাদাকণাগুলি জল শোষণের পরেও সেরূপভাবে স্ফীত হয় না এবং শুকিয়ে যাওয়ার পরও সেরূপভাবে সঙ্কুচিত হয় না।

3. C স্তর (C Layer): এই স্তরটি ল্যাটেরাইট মাটির মূল শিলাখণ্ড দ্বারা গঠিত। এই স্তরে কেওলিনাইট জাতীয় কাদাকণা সমৃদ্ধ শিলাখণ্ডের প্রাধান্য থাকে।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Middle post ad 01