ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর ত্রিকক্ষ নক্শা(Tricellular Model of Rotating Earth)
ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর বায়ু সঞ্চালনে তিনটি কোশ দেখা যায়-হ্যাডলি, ফেরেল ও মেরু কোশ।
হ্যাডলি কোশ (Hadley Cell): বিজ্ঞানী জি. হ্যাডলি (G. Hadley, 1735) এই নক্শার উপস্থাপন করেন যা হ্যাডলি কোশ নমে পরিচিত। হ্যাডলি কোশ নিরক্ষরেখা ও 30° উত্তর/দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে অবস্তিত। এই নক্শা অনুসারে নিরক্ষীয় অঞ্চলের ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন ট্রপোস্ফোরিক বায়ু উত্তপ্ত হয়ে উল্লম্বভাবে উর্ধ্বে প্রবাহিত হয় এবং মেরুপ্রদেশের দিকে সংবাহিত হয়। অবশেষে ভূপৃষ্ঠ ধরে আবার নিরক্ষীয় অঞ্চলে ফিরে আসে এবং হ্যাডলি নক্শা সম্পূর্ণ করে। হ্যাডলি কোশ বা নক্সার ওপরের অংশটি নিরক্ষরেখা থেকে উচ্চতর অক্ষাংশের দিকে আর নিম্ন অংশটি উচ্চতর অক্ষাংশ থেকে নিরক্ষরেখার দিকে বহমান। নিরক্ষরেখার দিকে ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন এই ট্রপোস্ফেরিক বায়ুর প্রবাহকে আয়ন বায়ু (trade wind) বলে।
ফেরেল কোশ (Ferrel Cell): উভয় গোলার্ধে 30°-60° অক্ষাংশের মধ্যবর্তী বায়ু সঞ্চালন কোশটি ফেরেল কোশ নামে পরিচিত। এই অঞ্চলটি পরোক্ষ তাপীয় কক্ষ (indirect thermal cell) কারণ সৌরতাপের প্রত্যক্ষ উত্ত াপে গঠিত হয়নি। প্রকৃতপক্ষে, মধ্য অক্ষাংশীয় অঞ্চল থেকে উপমেরুর দিকে নীচের স্তরে বায়ুর এবং উপমেরু (60°) থেকে মধ্য অক্ষাংশীয় অঞ্চলে ওপরের দিকে বায়ু প্রবাহের কথা। এই নক্শা অনুযায়ী নীচের স্তরে বায়ু সামান্য পশ্চিমাভিমুখে এবং ওপরের অংশের বায়ু পূর্বাভিমুখে প্রবাহিত হয়, মূলত কোরিওলিস বলের (coriolis force) জন্য। কিন্তু বাস্তবে ট্রপোস্ফিয়ারের উপরের অংশের বায়ুপ্রবাহ পূর্বাভিমুখী নয়, পশ্চিমাভিমুখী এই উচ্চ পশ্চিমা বায়ু স্তর (upper air westerlies) এই অঞ্চলে বায়ু এবং শক্তি প্রবাহের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই উচ্চ পশ্চিমা বায়ুর স্তরের উৎপত্তির কারণ, মধ্য অক্ষাংশ থেকে মেরুমুখী তাপমাত্রার ক্রমহ্রাসমানতা poleward decrease of temperature)। শীতকালে এই তাপহ্রাস মাত্রা অনেক বেশি থাকে বলে তাই, স্বাভাবিকভাবে পশ্চিমা বায়ু প্রবল হয়। ট্রপোস্ফিয়ারের উর্ধ্বের পশ্চিমা বায়ু আবার, বিজ্ঞানী ট্রিওয়ার্থারের (Trewartha) মতে, চরিত্র পাল্টে যায় দীর্ঘ তরঙ্গায়িত জেট বায়ুর উপস্থিতির কারণে। বিজ্ঞানী রসবি এদেরকে রসবি প্রবাহ (rossby waves) হিসাবে বর্ণনা করেছেন। ফলে পশ্চিমা বায়ুপ্রবাহের উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত ক্রমে পরিবর্তিত হয়।
তবে সমস্ত মধ্য অক্ষাংশ জুড়ে একটি বায়ুপ্রাচীর উয় উপক্রান্তীয় বায়ু এবং শীতল মেরু বায়ুর মধ্যে অবস্থান করে। এই বায়ুপ্রাচীরকে মেরু সীমান্ত (polar front) বলে। এই অঞ্চল বরাবর মধ্য ট্রপোস্ফিয়ার উচ্চতায় উদ্বু বায়ুর ঊর্ধ্বগমন অনেক বেশি এবং ধারাবাহিক।
পোলার কোশ (Polar Cell): পোলার কোশ উভয় গোলার্ধে 60° অক্ষাংশের ঊর্ধ্বে গঠিত হয়। এই নক্শা অনুযায়ী ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন শীতল বায়ু নিরক্ষীয় অঞ্চলের অভিমুখে এবং ওপরের অংশের বায়ু মেরু অভিমুখে প্রবাহিত হয়। এই ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন নিম্ন মেরু বায়ু সাধারণত পূর্বাভিমুখী (easterly) হয় এবং 60°-65° অক্ষাংশ বরাবর উদ্বু পশ্চিমা বায়ুর সঙ্গে মিলিত হয়ে এক মেরু প্রাচীর (polar front) তৈরি করে। প্রকৃতপক্ষে নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাত সৃষ্টির মূল কারণ এই মেরু প্রাচীরের অবস্থান।
ট্রাইসেলুলার নক্শার সীমাবদ্ধতা (Limitation of Tricellular Model)
পৃথিবীপৃষ্ঠে বায়ুর সঞ্চালন কেবলমাত্র সমান্তরালভাবে (horizontally) হয় না। কোথাও কোথাও উল্লম্ব প্রবাহ (vertically) দেখা যায়। এই উল্লম্ব এবং অনুভূমিক প্রবাহ মিলে মিশে এক একটি কক্ষ (cell) তৈরি করে। এরূপ তিনটি স্বতন্ত্র কক্ষের (হ্যাডলি, ফেরেল এবং মেরু কক্ষ) মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা সমগ্র পৃথিবীর বায়ু প্রবাহকে বর্ণনা করেছেন। যে মডেলের সাহায্যে এই বায়ু সঞ্চালন ব্যাখ্যা করা হয় তাকে ত্রিকক্ষীয় নক্শা বা Tricellular Model বলা হয়। এই মডেল বায়ু সঞ্চালনের অনেক নিয়মকে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে পারলেও 1948 সালের পরবর্তী সময় প্রবল সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে।
নীচে এই মডেলের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো সংক্ষেপে আলোচিত হল।
1. ট্রাইসেলুলার মডেলে নিরক্ষরেখা থেকে মেরু পর্যন্ত তাপমাত্রার অবক্রমকে (gradient) বায়ু সঞ্চালনের একমাত্র কারণ হিসাবে ধরা হয়েছে কিন্তু পৃথিবীর সমস্ত উচ্চচাপ ও নিম্নচাপ কক্ষ/বলয় তাপজনিত কারণে উৎপত্তি হয়নি।।
2. উচ্চ বায়ুস্তরে (500-1000m) বায়ু সাধারণত সমচাপরেখার প্রায় সমান্তরালে প্রবাহিত হয় অর্থাৎ এই দ্রাঘিমা সমান্তরাল বরাবর বায়ুপ্রবাহের মডেলকে মেনে নিতে পারেনি।
3. আয়ন বায়ুর বিপরীতে প্রবাহিত প্রত্যয়ন বায়ুর (anti trade wind) উৎপত্তিকে জোরালোভাবে সমর্থন করে এই ট্রাইসেলুলার মডেল। কিন্তু বাস্তবে প্রত্যয়ন বায়ু সমস্ত দ্রাঘিমা বরাবর একইভাবে পাওয়া যায় না।
4. মধ্য অক্ষাংশীয় (ফেরেল কোশ) উচ্চ বায়ুস্তরে পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত পশ্চিমা বায়ুর উপস্থিতির এবং শক্তিশালী হওয়ার কোনো সুস্পষ্ট কারণ এই মডেল দিতে পরেনি।
5. নিম্ন বায়ুমণ্ডলের অধিকাংশ অঞ্চলে চাপ ও সংশ্লিষ্ট বায়ুপ্রবাহ আঞ্চলিক অবস্থানে (zonal pattern) পাওয়া যায় না বরং কোশীয় কক্ষীয় অবস্থানে দেখা যায়।
6. ট্রাইসেলুলার মডেল দ্রাঘিমা বরাবর প্রবাহিত সাময়িক বায়ুপ্রবাহ যথা মৌসুমি বায়ু, স্থলবায়ু, সমুদ্রবায়ু ইত্যাদির উৎপত্তি ও বিস্তার সম্বন্ধে কোনো আলোকপাত করেনি, যদিও অনেক ক্ষেত্রে এদের আঞ্চলিক উপাংশ (zonal component) লক্ষণীয়।