ভূবৈচিত্র্যসূচক মানচিত্রের সাধারণ ব্যাখ্যা করার পদ্ধতি (method of general interpretation of topographical map)
ভূবৈচিত্র্যসূচক মানচিত্র কীভাবে সাধারণ ব্যাখ্যা করতে হয় তা নিচে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হল। যথা-
A ভূমিকা (Introduction):
ভূমিকায় মানচিত্রটির মূল তথ্যসমূহ বর্ণনা করতে হবে। প্রথম মানচিত্রটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তারপর মানচিত্রের উপরে মাঝবরাবর এবং বামপাশে লেখা থাকে কোন রাজ্য কোন কোন জেলা নিয়ে গঠিত, তা লিখতে হবে। এবং ডানদিকে দেওয়া থাকে মানচিত্রটির সূচক সংখ্যা। তারপর মানচিত্রটির অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশগত বিস্তার লিখতে হবে। এগুলি মানচিত্রের চারটি কোণে লেখা থাকে। মানচিত্রে সাধারণত দ্রাঘিমাংশ ও অক্ষাংশ যথাক্রমে পূর্ব কিংবা পশ্চিম অথবা উত্তর-দক্ষিণ লেখা থাকে না। যেহেতু survey of india সংস্থা কর্তৃক এগুলি তৈরি এবং স্থানগুলি ভারতের তাই দ্রাঘিমা হবে পূর্ব এবং অক্ষাংশ হবে উত্তর (উদাহরণ হিসেবে বলা যায় 85°15'E থেকে 85°30'E দ্রাঘিমা এবং 23°30′N থেকে 23°45'N অগাংশ)। তারপর মানচিত্রটির নিচে মাঝবরাবর স্কেলটি আঁকা থাকে এবং স্কেল সূচক ভগ্নাংশ বা R.F. দেওয়া থাকে। তা বর্ণনা করতে হবে। ঐ স্কেলের তলায় লেখা থাকে সমোন্নতি ব্যবধান কত এবং উচ্চতার একক। যা ভূমিকায় লেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রদত্ত মানচিত্রে প্রদর্শিত অঞ্চলটির ক্ষেত্রফল বের করতে হবে। এটি বের করা যায় মানচিত্রটির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ সেমিতে মেপে স্কেল অনুযায়ী কিমি.-তে পরিবর্তন করে তারপর গুণ করলে ক্ষেত্রফল বর্গকিমিতে পাওয়া যাবে। সবশেষে দিতে হবে অঞ্চলটি কোন সালে জরিপ করা হয়। তা দেওয়া থাকে বামদিকের উপরে [b] এবং কোন সালে কার তত্ত্বাবধানে (সার্ভে অব ইন্ডিয়া) মানচিত্রটি প্রকাশ (publish) করা হয়েছে। তা লেখা থাকে মানচিত্রের মাঝবরাবর নিচে।
এক ঝলকে ভূমিকা: [i] কোন রাজ্য [ii] কোন জেলা বা কোন কোন জেলা [iii] মানচিত্রের সূচক সংখ্যা (যেমন-. এখানে পড়তে হবে সেভেনটি থ্রি জে বাই ফোর)। [iv] অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশগত বিস্তার [v] স্কেল ও স্কেল সূচক ভগ্নাংশ [vi] সমেন্নতি রেখার ব্যবধান [vii] অঞ্চলটির আয়তন [viii] কোন সালে জরিপরকার্য হয়েছে এবং [ix] কার তত্ত্বাবধানে, (এখানে কোনো ব্যক্তির নাম লেখার দরকার নেই) কোন সালে প্রকাশ করা হয়েছে।
B ভূ-প্রকৃতি (Relief):
প্রদত্ত অঞ্চলটির ভূ-প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা করতে গেলে যে সব বিষয়গুলির উপর গুরুত্ব দিতে হয় সেগুলো হল [৯] অঞ্চলটির ঢাল কোন দিক থেকে কোন্ দিকে, (b) অঞ্চলটির চরম উচ্চতা ও আপেক্ষিক উচ্চতা (relative relief)। [c] অঞ্চলটি কতগুলো ভু-প্রকৃতি অঞ্চলে বিভক্ত, স্থানীয় উচ্চতা অনুসারে। [d] ব্যবচ্ছিন্নতার সূচক (dissection index)। [e] বন্ধুরতার সূচক (ruggedness index)। [f] প্রধান প্রধান ভূমিরূপের বৈশিষ্ট্য (typical features)
ঢাল (Slope): ঢাল (slope) বলতে বোঝায় যে প্রদত্ত মানচিত্রের অঞ্চলটির ঢাল কোন্ দিক থেকে কোন দিকে। এটি নির্ণয় করা যায় নিম্নোক্তভাবে। যথা-
① নদীর গতিপথ দেখে কারণ, জল সর্বদা উচ্চস্থান থেকে নিচে প্রবাহিত হয়।
② প্রদত্ত মানচিত্রের সমোন্নতি রেখার মান দেখে অঞ্চলটির ঢাল বোঝা যায়।
③ ভূ-প্রকৃতির দিক থেকে অঞ্চলটির ঢাল নির্ণয় করার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হল "representative section"-এর সাহায্যে পদ্ধতিটি হল অঞ্চলের সর্বোচ্চ উচ্চতা থেকে সর্বনিম্ন উচ্চতা পর্যন্ত (যদি নদী থাকে, তাহলে নদীর পাড় পর্যন্ত) একটি section line টেনে break of slope নির্ণয় করা যায়।
অঞ্চলটির চরম উচ্চতা ও আপেগিক উচ্চতা (relativerelief): প্রতিটি মানচিত্রে ৭ টি করে গ্রিড (grid) থাকে। প্রতিটি গ্রিডের উচ্চতা হল ঐ গ্রিডের চরম উচ্চতা। এবং ঐ মানচিত্রের মধ্যে সর্বাধিক উচ্চতা বিশিষ্ট স্থানটি হল ঐ অঞ্চলের চরম উচ্চতা।
অঞ্চলটির আপেক্ষিক উচ্চতা নির্ণয় করা হয় এভাবে। প্রতিটি গ্রিডের সর্বোচ্চ উচ্চতা থেকে সর্বনিম্ন উচ্চতা বিয়োগ দিয়ে যে মানটি পাওয়া যায়, তা হল ঐ-গ্রিডের আপেক্ষিক উচ্চতা। এইভাবে উত্ত মানচিত্রের ৭ টি গ্রিডের আপেক্ষিক উচ্চতা (relative relief) নির্ণয় করতে হবে। তারপর উচ্চ (high), মধ্য (middle), ও নিম্ন (low), এই তিনটি মানের উপর নির্ভর করে সমগ্র মানচিত্রকে তিনটি ভাগে ভাগ করতে হবে। তারপর নির্দিষ্ট index দিয়ে চিহ্নিত করতে হবে।
আপেক্ষিক উচ্চতার বৈশিষ্ট্য হল
আপেক্ষিক উচ্চতা ধারণাটি সঠিক নয়। কারণ এতে কোনও আপেক্ষিকতা নেই।।
আপেক্ষিক উচ্চতা যত বেশি হবে ভূমির ঢালের পার্থক্য তত বেশি হয়।
আপেক্ষিক উচ্চতা যত কম হবে ভূমির ঢালের পার্থক্য তত কম হয়।
[c] স্থানীয় উচ্চতা অনুসারে ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলের বিভাগ: খানিক উচ্চতা অনুসারে মানচিত্রকে একই ব্যবধান রেখে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। এইভাবে যে চিত্রটি অঙ্কন করা হয় তাহাকে broad physigraphic division বলা হয়। এর সাহায্যে এক ঝলকেই বলে দেওয়া যায় সমগ্র অঞ্চলটির কোন কোন স্থান নিম্ন উচ্চতা বিশিষ্ট এবং কোন্ কোন্ স্থানের মধ্যম মান বিশিষ্ট এবং কোন্ কোন্ স্থানের উচ্চতা বেশি। এরই সাহায্যে অঞ্চলটির পার্বত্য অঞ্চল, মালভূমি অঞ্চল এবং সমভূমি অঞ্চল কতখানি বিস্তৃত তা নির্ণয় করা যায়।
অন্যলের ব্যবচ্ছিন্নতার সূচক (Dissection Index-DI): কোনও নদী অববাহিকা অঞ্চলের ব্যবচ্ছিন্নতার মাত্রা ও প্রকৃতি বোঝাতে ব্যবচ্ছিন্নতার সূচক ব্যবহার করা হয়। নির্দিষ্ট নদী অববাহিকা আপেক্ষিক বন্ধুরতা ও সর্বোচ্চ উচ্চতার অনুপাতের মাধ্যমে ব্যবচ্ছিন্নতার সূচক নির্ণয় করা হয়। ভূ-রূপমিতির (morphometry) একটি উল্লেখযোগ্য সূত্র হল ব্যবচ্ছেদের সূচক (Dissection Index)। ভূ-প্রকৃতির কোনও একটি বিশেষ অঞ্চল কতটা ব্যবচ্ছিন্ন বা কর্তিত হয়েছে, তা পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত হয় ডোভ নীর (Dov Nir-1957) কর্তৃক প্রচলিত সূত্রটি-
Dissection Index (DI) = Relative relief maximum altitude
ব্যবচ্ছিন্নতার সূচক-এর গুরুত্ব
①ব্যবচ্ছিন্নতার সূচক নির্ণয়ের জন্য গ্রিড পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। এই সূচকের মান 0 থেকে 1-এর মধ্যে হয়। পর্বতের খাড়া ঢাল ব্যতীয় এই মান 1.00 হয় না। সমভাবে তাত্ত্বিক ক্ষেত্র ছাড়া বাস্তবে কখনওই এই সূচক ০ হয় না।
② স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের মাত্রা বোঝাতেও ব্যবচ্ছিন্নতার সূচক ব্যবহৃত হয়। সূচকের মান 0.1 এর (<10%) কম হলে বার্ধক্য 0.1-0.3/0.1-0.3 (10%-30%)-এর মধ্যে হলে তলেও ঐ 0.3 (30%)-এর বেশি হলে যৌবন পর্যায়কে নির্দেশ করে।
এই সূচকের সাহায্যে সমমানের রেখা দ্বারা (hol ব্যবচ্ছিন্ন মানচিত্র অঙ্কন করা হয়।
ব্যবচ্ছিন্নতার সূচক নির্ণয় ইহা নির্ণয় করা হয় নিম্নোক্ত ভাবে যথা-
মানচিত্রে মোট নয়টি (9) গ্রিড (grid) রয়েছে। আগেই আমর বের করে দিয়েছি ঐ অঞ্চলের প্রতিটি গ্রিডের relative relief তারপর প্রতিটি গ্রিডের সর্বোচ্চ উচ্চতা (maximum altitude দিয়ে ঐ গ্রিডের relative relief বা আপেক্ষিক উচ্চতা কে ভাল করলে এক একটি গ্রিডের dissection index বা ব্যবচ্ছিন্নতার সূচক পাওয়া যায়। তারপর উচ্চ, মধ্য ও নিম্নমানের তিনটি মাম ধরে দুটি isoline টেনে মানচিত্রকে মোট তিনটি ভাগে বিভয় করিতে হবে। তারপর প্রতিটি অংশকে আলাদা আলাদা index সূচক দ্বারা চিহিতে করিতে হবে, dissection index এর যে মাম পাওয়া যাবে তার মান যত কম হবে তার সমভূমিকে নির্দেশ করে। এবং মান যত বেশি হবে তাহা পার্থক্য অঞ্চলকে নির্দেশ করবে।
Dissection Index (DI) = R.R. Μ.Α. Where, R. R. Relative relief
M. A. Maximum altitude
বন্ধুরতার সূচক (Ruggedness Index):
বন্ধুরতা বন্ধুরতা (relief-H) বা আপেক্ষিক বন্ধুরতা (relative relief- RR) বলতে নদী অববাহিকার উচ্চতম ও নিম্নতম বিন্দুর বিয়োগফলকে বোঝায়।
সংজ্ঞা (definition):
কোনো অঞ্চলের জলনির্গম প্রণালী ঐ অঞ্চলের ভূমিরূপকে কতটা কর্তিত ও ব্যবচ্ছিন্ন করতে পারে, তা নির্ণয়ের জন্য যে সূচক ব্যবহার করা হয়, তাকে বন্ধুরতার সূচক (ruggedness index) বলে।
বন্ধুরতা সূচক বা সংখ্যা (Ruggedness Index) নির্ণয় নদী অববাহিকার বন্ধুরতার (H) অন্যতম পরিমাপ হল। বন্ধুরতা সূচক বা বন্ধুরতা সংখ্যা। এটি নিম্নলিখিত সূত্রের সাহায্যে প্রকাশ করা যায়-
R relative relief x drainage density 1000
স্যুম (Schumann)-এর মতে যদি অববাহিকার বন্ধুরতা (H) ফুটে ও নদীখাতের ঘনত্ব/মাইলে (D) মাপা হয় তাহলে, DxH বন্ধুরতা সূচক (R) = 5280
আবার, অববাহিকার বন্ধুরতা (H) মিটারে ও নদী ঘনত্ব/কিমি (D) মাপা হয়। তাহলে বন্ধুরতা সূচক (R.)= 1000 হয়।
DxHবন্ধুরতা সূচক-এর গুরুত্ব নদী অববাহিকার নদী ঘনত্ব (drainage density) ও বন্ধুরতা(H) সামগ্রিকভাবে বন্ধুরতার মাত্রা নির্ণয়ে সহায়তা করে-
① যদি বন্ধুরতা (H) স্থির থাকে তাহলে উচ্চ নদী ঘনত্ব খাড়া ঢালের সৃষ্টি করে ও ভূমির ওঠা-নামার পরিসংখ্যা বাড়ায়।
② আবার যদি নদী ঘনত্ব (D) স্থির থাকে তাহলে বন্ধুরতা (H) যেখানে বেশি সেখানে ভূমির ঢাল বেশি হবে। সুতরাং, ভূমির ঢাল নদী ঘনত্ব (D) ও বন্ধুরতা (H) উভয়ের উপর নির্ভরশীল।
বন্ধুরতা সূচক নির্ণয় প্রদত্ত মানচিত্রে যে অঞ্চল রয়েছে তাহার ঢালের প্রকৃতি আলোচনা করিতে গিয়ে ভূমিরূপের বন্ধুরতার কথা চলে আসে। এর সাহায্যে অঞ্চলের পার্বত্য অংশ, মালভূমি অংশ ও সমভূমি অংশ নির্ণয় করা হয়। ইহাই হল অঞ্চলের বন্ধুরতা, যাহা নির্ণয় করা হয় নিম্নস্তোভাবে। যথা-
মানচিত্রের প্রতিটি গ্রিডের (grid) আপেক্ষিক উচ্চতা (relative relief) আগেই বের করা হয়েছে। পরে প্রতিটি গ্রিডের (grid) নদীর ঘনত্ব (drainage density) বের করিতে হবে। ইহা বের করা হয় এভাবে ঐ গ্রীডের সমস্ত জল নির্গম প্রণালীর মোট দৈর্ঘ্যকে ঐ গ্রিডের ক্ষেত্রফল ঐ দিয়ে ভাগ করিতে হবে। তারপর নদীর ঘনত্ব (drainage density) ও আপেক্ষিক উচ্চতা (relative relief) গুণ করিতে হবে। যে মানটি (value) পাওয়া যাবে তাহাকে 1000 দিয়ে (constant value) ভাগ করিতে হবে।
নয়টি গ্রিডে এভাবে মান বের করার পর ঐ মানচিত্রকে যদি তিনটি কিংবা চারটি অঞ্চলে বিভক্ত করতে চাই তাহলে দুটি কিংবা তিনটি সমলাইন (isoline) টানতে হবে। সবশেষে নির্দিষ্ট সূচক দ্বারা সেগুলি চিহ্নিত করতে হবে।
D. D. x R. R. Ruggedness Index = 1000 (constant value) Total stream length Drainage Density (D.D.) =- Area
প্রধান প্রধান ভূমিরূপের বৈশিষ্ট্য (Main Features):
ভূ-প্রকৃতি আলোচনা করার সর্বশেষ কাজটি হল মানচিত্রকে ভালোভাবে পর্যবেগণ করে তার মধ্যে থেকে কিছু প্রধান প্রধান ভূমির বৈশিষ্ট্য বের করতে হবে। যা ভূ-প্রকৃতির বৈশিষ্ট্যকে নির্দেশ করে। যেমন-
① শম্ভু আকৃতির পাহাড় (conical hill)।
②গম্বুজাকৃতি পাহাড় (dome shaped hill)।
③ভৃগুডাল (scarp slope)
④ দু'টি পর্বতের মধ্যবর্তী সংকীর্ণ গিরিপথ (col)।
⑤স্যাল (saddle) ইত্যাদি
শঙ্কু আকৃতির পাহাড় (Ridge): শত্রু আকৃতি পাহাড় বা Ridge হল একটি পাহাড়ী ভূমিরূপ। এক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্যগুলো হল।
① সমোন্নতি রেখাগুলো কাছাকাছি অবস্থিত হবে।
② রেখাগুলোর মান খুব বেশি হবে।
③ প্রস্থচ্ছেদ টানলে (cross section) পিরামিডের চূড়ার ন্যায় ভূমিরূপ গঠন করে।
④ দুই প্রান্ত খাড়া ঢালের সৃষ্টি করে।
গম্বুজাকৃতি ভূমিরূপ (Dome shaped relief):এই গম্বুজাকৃতি ভূমিরূপের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হল বা চেনার উপায়গুলো হল।
① সমোন্নতি রেখাগুলোর মাঝে কিছুটা ব্যবধান থাকে।
② প্রস্থচ্ছেদ টানলে উল্টানো গামলার মতো ভূমিরূপ গঠিত হয়।
③ দুই প্রান্তভাগ মৃদু ঢালযুক্ত।