আবহবিকারের নিয়ন্ত্রক(Controls of Weathering)
পৃথিবীর সর্বত্র একই ভাবে কিংবা একই মাত্রায় আবহবিকার হয় না, কোথাও এর মাত্রা বেশি বা কোথাও এর মাত্রা কম। আবার এর পদ্ধতি, ধরন এবং প্রকৃতি সর্বত্র সমান নয়। এর কারগুল নিম্নরূপ-
1. শিলার উপাদান ও গঠন (Composition and Structure of Rock): শিলার গঠন বলতে তার প্রাকৃতিক এবং রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যকে বোঝায়। যেমন শিলার গঠনকারী খনিজ, দারণ, ফাটল, স্তরায়ণ তল, ভাঁজ, চ্যুতি প্রভৃতি। শিলাস্তরে দারণ বেশি হলে আবহবিকার বেশি হয়। আবার শিলাস্তরে ফাটল দেখা দিলে তার মধ্যে জল প্রবেশ করে বরফে পরিণত হলে আবহবিকার সংঘটিত হয়। আবার ওই ফাটলের মধ্যে উদ্ভিদের শিকড় প্রবেশ করলে আবহবিকারের হার বেড়ে যায়। শিলায় সচ্ছিদ্রতা কম থাকলে কিংবা শস্ত প্রকৃতির হলে আবহবিকার খুব ধীরে ধীরে হয়। আবার মোটা দানা যুক্ত বেলেপাথরে জল সহজেই প্রবেশ করতে পারে বলে আবহবিকার দ্রুত হয়। শ্লেট শিলায় সম্ভেদ অবস্থান করায় আবহবিকারের ফলে শিলা পাতের ন্যায় উঠে আসে। সিস্টের মধ্যে অভ্র (mica)-এর পরিমাণ বেশি থাকলে আবহবিকার অধিক মাত্রায় হয় কিংবা চুনাপাথরে বৃষ্টির জল প্রবেশের ফলে রাসায়নিক আবহবিকার লক্ষ করা যায়।
কোনো স্থানে শিলার গঠন আবহবিকারকে নিয়ন্ত্রণ করে। শিলার গঠন সাধারণত শিলার স্থিতিস্থাপকতা যা শিলার মধ্যে দারণের উপস্থিতির উপর নির্ভর করে। শিলা গঠনকারী খনিজ পদার্থ যথা ক্যালসাইট, জিপসামের সঙ্গে জল মিশে গেলে দ্রবণ শুরু হয়। আবার ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম প্রভৃতিতে খনিজের পরিমাণ বেশি বলে জল ও বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাই-অক্সাইডের মিশ্রণে যে কার্বনিক অ্যাসিড গঠিত হয় তার প্রভাবে শিলা সহজে গলে যায়.
2. শিলার কাঠিন্য ও গ্রথন (Hardness and Texture of Rocks): শিলা গঠনকারী খনিজ পদার্থের কাঠিন্যের ওপর আবহবিকারের তীব্রতা এবং দ্রুততা নির্ভর করে। কোনো কোনো খনিজ খুবই কঠিন, যেমন হীরে, টোপাজ, কোয়ার্টজ যে সমস্ত শিলায় খনিজের কাঠিন্য মোহ স্কেল অনুযায়ী 7-এর বেশি সেই শিলাগুলি সহজে আবহবিকার দ্বারা প্রভাবিত হয় না। কিন্তু যে সমস্ত শিলায় খনিজের কাঠিন্য মোহ স্কেল অনুযায়ী 7-এর কম, যেমন-ট্যাল্ক, জিপসাম, ক্যালসাইট-এদের দ্বারা গঠিত শিলায় আবহবিকার বেশি লক্ষ করা যায়।
শিলার গ্রথন আবহবিকারকে প্রভাবিত করে। শিলায় অবস্থানরত খনিজের বিন্যাসের ওপর শিলার প্রথন নির্ভর করে। কিলার গ্রথন দুই প্রকার যথা- স্থূল বা সূক্ষ্ম । সূক্ষ্ম দানা দ্বারা গঠিত শিলার কেলাস গুলি পরস্পর ঘন সংঘবদ্ধভাবে থাকার আবহবিকার ধীরে ধীরে হয়। কিন্তু স্থূল গ্রথন যুক্তশিলার কণাগুলি দিড এবং সংবর্ধন ভাবে অবস্থান না করায় কনা গুলি সহজে নষ্ট হয়ে যায় যা আবহবিকার সহজে প্রতিহত করতে পারেনা।
3. জলবায়ু (Climate): আবহবিকারের মাত্রা ও প্রকৃতি জলবায়ু দ্বারা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত। জলবায়ুর প্রধান দুটি উপাদান হল তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত। পৃথিবীর সর্বত্র যান্ত্রিক আবহবিকারকে নিয়ন্ত্রণ করে জলবায়ু। মরু অঞ্চলে অত্যধিক উন্নতার জন্য কিংবা দিন-রাতের মধ্যে উন্নতার পার্থক্য বেশি হওয়ায় যান্ত্রিক আবহবিকার অধিক মাত্রায় হয়। উদ্বু অঞ্চলে দিনের বেলায় উদ্বুতা বৃদ্ধি পাওয়ায় শিলার উপরের স্তরের প্রসারণ এবং রাতে তাপমাত্রা হ্রাস পাওয়ায় শিলাস্তরের সংকোচন ঘটে। এইভাবে ক্রমাগত চলতে থাকলে শিলাস্তরে ফাটলের সৃষ্টি হয়ে যান্ত্রিক আবহবিকার ঘটে। ভু-বিজ্ঞানী গ্রিনফিল্ড (Greenfield) মনে করেন যে মরু অঞ্চলে অপ্রধান খনিজের অবস্থান মনে করিয়ে দেয় যে এখানে রাসায়নিক আবহবিকার হচ্ছে।
পৃথিবী বিভিন্ন জলবায়ু অঞ্চলের আবহবিকার মাত্রা ও ধরন একই নয়।
1. নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চল (Equatorial Climatic Region ):অঞ্চল অর্থাৎ অতি উদ্বু ও আর্দ্র অঞ্চলে (নিরক্ষীয় রেখার উভয়দিকে 10° অবধি) যান্ত্রিক ও রাসায়নিক উভয় প্রকার আবহবিকার দেখা যায়। উদ্বুতা বেশি থাকায় যান্ত্রিক আবহবিকার দেখা দিলেও সারাবছর বৃষ্টিপাতের দরুন রাসায়নিক আবহবিকার খুব বেশি মাত্রায় ঘটে। তাছাড়া এই অঞ্চলে উদ্ভিদের আধিক্য বেশি। উদ্ভিদ থেকে ঝরা পাতা পচে হিউমিক অ্যাসিড তৈরি হয়। এই অ্যাসিড রাসায়নিক বিকারকে ত্বরান্বিত করে।
2. ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চল (Tropical Monsoon Climatic Region): মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলে (10°-30° উঃ ও দঃ) ক্রমান্বয়ে আর্দ্র ও শুদ্ধ ঋতু দেখা যায়। শুদ্ধ ঋতুতে যান্ত্রিক আবহবিকার এবং আর্দ্র ঋতুতে রাসায়নিক আবহবিকারের প্রাধান্য থাকে। আর্দ্র ঋতুতে ধৌত প্রক্রিয়ায় শিলাস্তরের উপরের দ্রবণশীল লবণ কণা নীচে নেমে যায়। 'আবার কৌশিক প্রক্রিয়ায় উপরে উঠে আসে। এভাবে রাসায়নিক বিকারে ল্যাটেরাইটের সৃষ্টি হয়।
3. মরু ও মরুপ্রায় জলবায়ু অঞ্চল (Desert and Semi-desert Climatic Region): মরু বা মরুপ্রায় অঞ্চলে দৈনিক ও বার্ষিক তাপমাত্রার প্রসর অধিক থাকে। ফলে শিলাস্তরের ক্রমান্বয়ে সংকোচন-প্রসারণে যান্ত্রিক আবহবিকার অধিক লক্ষ করা যায়। এখানে গরমে শিলার খনিজ পদার্থ কৌশিক প্রক্রিয়ার উপরে উঠে আসে এবং ডুরিক্রাস্ট (duricrust) গঠন করে।
4. নাতিশীতোয় জলবায়ু অঞ্চলে (Temperate Climatic Region): নাতিশীতোয় অঞ্চলে (30°-45° উঃ) যান্ত্রিক ও রাসায়নিক-উভয় প্রকার আবহবিকার লক্ষ করা যায়। তবে উয় নাতিশীতোয় অঞ্চলে রাসায়নিক ও শীতল নাতিশীতোয় অঞ্চলে যান্ত্রিক আবহবিকারের প্রাধান্য থাকে।
5. মেরু জলবায়ু অঞ্চল (Polar Climatic Region): বরফে ঢাকা মেরু অঞ্চলে সাধারণত আবহবিকার তেমন দেখা যায় না। তবে মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় অংশে যেখানে বছরের কিছুটা সময় বরফ গলে জলে পরিণত হয় সেখানে তুষার কেলাস খন্ডীকরণ (ice crystal shattering) যান্ত্রিক আবহবিকার দেখা যায়।
6. ভূমির ঢাল (Ground Slope): কোনো অঞ্চলের ভূমির ঢাল সেই অঞ্চলের আবহবিকারকে নিয়ন্ত্রিত করে। ভূমির ঢালের ওপর জলপ্রবাহের পরিমাণ, আবহবিকারের হার এবং আবহবিকারজাত পদার্থের অপসারণ প্রভৃতি বিষয়গুলি নির্ভর করে। রাসায়নিক আবহবিকারকে ত্বরান্বিত করার জন্য ভূমির উচ্চতা যেমন মাঝারি হওয়া প্রয়োজন, তেমনি ভূমির ঢাল মৃদু হওয়া প্রয়োজন। আবার ভূমির ঢাল বেশি হলে যান্ত্রিক আবহবিকারের ফলে বিচুর্ণীভূত প্রস্তরখণ্ড খাড়া ঢাল বরাবর অপসারিত হয়ে নীচে পড়ে যায় এবং পুনরায় আবহবিকারের জন্য উন্মুক্ত হয়। আবার কম ঢাল যুক্ত অঞ্চলে জল নিকাশি ব্যবস্থার জন্য জল মৃত্তিকার ভেতরে প্রবেশ করে রাসায়নিক আবহবিকার ঘটায়।
7. জীবমণ্ডল (Organism): আবহবিকার নিয়ন্ত্রণে জীবমণ্ডলের গুরুত্ব অপরিসীম। বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণীর সংখ্যা এবং প্রকৃতি আবহবিকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদ্ভিদের শেকড় শিলার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে শিলাকে ফাটিয়ে দেয়। আবার গাছের পাতা পচে যে রস বের হয় তা শিলায় রাসায়নিক আবহবিকার ঘটাতে সাহায্য করে। ঠিক একইভাবে শিলার উপর অবস্থিত মস, লাইকেন, শৈবাল প্রভৃতি শিলার উপর জল ধরে রাখতে সাহায্য করে। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্ভিদগুলি পচে হিউমাস তৈরি করে। এই হিউমাসের উপর বৃষ্টির জল পড়লে জৈব অ্যাসিডের সৃষ্টি হয় যা পরবর্তী সময়ে ব্যাসল্ট, ম্যাগনেসিয়াম, ফেল্ডস্পার এবং সালফার যৌগ দ্বারা গঠিত শিলাকে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ত্বরান্বিত করে। উদ্ভিদ ছাড়াও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণী যেমন কেঁচো, ইঁদুর, খরগোশ, কুকুর সহ বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ শিলার ভেতর গর্ত করে আবহবিকারে সাহায্য করে।
৪. সময় (Time): সময়কে আবহবিকারের অন্যতম নিয়ন্ত্রক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কারণ কোনো শিলা কত সময় ধরে ভূপৃষ্ঠের উপর উন্মুক্ত অবস্থায় রয়েছে, কিংবা কত সময় ধরে ভূ-অভ্যন্তরে চাপা পড়ে রয়েছে তার ওপর নির্ভর করে আবহবিকারের পরিমাণ। শিলার উন্মুক্ততা যদি দীর্ঘ সময় ধরে সংঘটিত হয় তাহলে আবহবিকারের মাত্রা অধিক হবে। আবার কোনো শিলা যদি কম সময় ধরে ভূপৃষ্ঠে পড়ে থাকে তাহলে সেই শিলায় আবহবিকার ততটা সংঘটিত হবে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ক্রান্তীয় অঞ্চলে ভূমিভাগে পাললিক শিলা দীর্ঘদিন প্রকৃতিতে পড়ে থাকার পর লৌহ অক্সাইডের জারণের ফলে কঠিন হয়ে যায়।
9. শিলার বর্ণ (Rock Colour): শিলার রং আবহবিকারে পত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করে। যে সমস্ত শিলার রঙ হালকা বর্ণের সেই শিলাগুলি সূর্যরশ্মি গ্রহণ করতে ততটা সক্ষম নয়। তাই উত্তপ্ত হতে সময় লাগে। যেমন চক, মার্বেল, চুনাপাথর প্রভৃতি। আবার যে সমস্ত শিলার রং গাঢ় প্রকৃতির, সেই সমস্ত শিলাগুলির তাপ শোষণ করার ক্ষমতা বেশি বলে তাড়াতাড়ি উত্তপ্ত হয়ে যায়, এবং সেই সঙ্গে যান্ত্রিক আবহবিকার সংঘটিত হয়।
এই ভাবে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রকগুলি পৃথিবীর বিভিন্নস্থানে অবস্থানরত শিলার উপর আবহবিকার ঘটাতে সাহায্য করে.
10. উন্মুক্ত ভূপৃষ্ঠের আয়তন (Open surface volume): শিলা যত বেশি বায়ুতে উন্মুক্ত অবস্থায় থাকবে তত বেশি আবহবিকার ঘটার সম্ভাবনা থাকবে। এইজন্য বড়ো শিলার চাঁই-এর তুলনায় ছোটো আকৃতির শিলায় বেশি আবহবিকার হয়। কারণ ছোটো শিলার অনেকখানি অংশ বায়ুতে উন্মুক্ত থাকে। একই কারণে যে শিলায় ফাটল বেশি থাকে তাও আবহবিকারের বেশি শিকার হয়.