মানচিত্রের ধারণা (concept of map)
পৃথিবী অথবা এর কোনো অংশের প্রতিকৃতি নির্দিষ্ট স্কেল অনুসারে অক্ষরেখা ও দ্রাঘিমারেখাসহ সমতল কাগজের ওপর আঁকা হলে তাকে মানচিত্র (map) বলে। তবে গোলকীয় পৃথিবীকে সমতল কাজে আঁকার জন্য আবার প্রয়োজন হয় অভিক্ষেপ (projection) পদ্ধতি। তাই, স্কেল ও অভিক্ষেপের সাহায্যেই মানচিত্র অঙ্কন করা হয় ও তার মধ্যে চিহ্নের সাহায্যে কোনো বন্ধুর বা বিষয়ের আগালিক বিন্যাস দেখানো হয়।
মানচিত্র ভৌগোলিকদের কাছে অতি প্রয়োজনীয় একটি উপকরণ (tool), যার সাহায্যে তারা পৃথিবীর যে-কোনো অঞ্চল সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারে। শুধু ভৌগোলিকরাই নন, যে-কোনো মানুষের কাছেই এটি অপরিহার্য। বিশেষত, পর্যটক, প্রশাসক, স্থপতি, ইঞ্জিনিয়ার, গবেষক প্রভৃতি পেশার মানুষেরা মানচিত্রকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে থাকে। এর প্রধান সুবিধা হল এর মাধ্যমে যে-কোনো দেশ, রাজ্য বা অঞ্চলের সকল প্রকারের তথ্য জানা যায়। অর্থাৎ মানচিত্র হল কোনো অঞ্চলের যথার্থ প্রতিবিম্ব, যাকে প্রতিফলিত করা হয় বিভিন্ন মাপের কাগজে।
মানচিত্রের অর্থ (meaning of map)
ইংরেজি map শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ মানচিত্র। বিশেষজ্ঞের বলেন ইংরেজিতে map শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ল্যাটিন বা লাতিন শব্দ মাল্লা (mappa) থেকে, যার অর্থ 'কাপড়' বা 'ন্যাপকিন'। 840 খ্রিস্টাব্দে সেন্ট রিকইয়ারের মঠবাসী সন্ন্যাসী মিকন (Micon) মধ্যযুগীয় পৃথিবীর মানচিত্রকে mappa mundi নামে অভিহিত করেন। রুমে শব্দটি অপভ্রংশ হয়ে ম্যাপ (map) শব্দে পরিণত হয়। সমগ্র পৃথিবী বা তার অংশকে কাগজে উপস্থাপিত করা হয় বলে সম্ভবত map নামটি এসেছে। প্রাচীনকালে কাপড়, তুলট কাগজ, চামড়া ইত্যাদির ওপর মানচিত্র আঁকা হতো। পৃথিবী এতবড়ো যে তাকে একসঙ্গো দেখা যায় না। কিন্তু মানচিত্রে সমগ্র পৃথিবীকে বা তার যে কোনো অংশকে সঠিকভাবে প্রকাশ করা যায়। অর্থাৎ মানচিত্র কথার অর্থ মান (পরিমাপ ও পরিমাণ) অনুসারে অঙ্কিত চিত্র।
বর্তমানে অবশ্য map শব্দটি নিখুঁত অর্থে ব্যবহৃত হয়। এককথায় বড়ো আকারের কোনো এলাকার প্রতিকৃতিকে মানচিত্র (map) বলে। সুতরাং মানচিত্র হল মান সম্বলিত চিত্র। এই মানকেই ভূগোলে স্কেল বা মানচিত্র স্কেল (map scale) বলে।
মানচিত্র ভূগোলের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করে। আর এই কারণেই অধ্যাপক হ্যালফোর্ড ম্যাকিনল্ডার বলেছেন "মানচিত্র হল ভৌগোলিকের হাতিয়ার" ("Maps are the tools of the geographer-Prof. Halfford)
মানচিত্রের সংজ্ঞা (definition of map)
(1) সমগ্র পৃথিবী অথবা এর কোনো অংশের প্রতিকৃতি সঠিক দিক অনুসারে নির্দিষ্ট স্কেলে সমতল কাগজের উপর সঠিক অভিক্ষেপের সাহায্যে উপস্থাপন করাকে মানচিত্র (map) বলে।
(2) মানচিত্র (map) হল সমতল কাগজের ওপর নির্দিষ্ট স্কেল ও সাংকেতিক চিহ্নের সাহায্যে অঙ্কিত ভূ-পৃষ্ঠের প্রতিচ্ছবি।
(3)মানচিত্র কথার সাধারণ অর্থ হল পরিমাপ বা স্কেল অনুসারে আঁকা ছবি। অন্যভাবে বলা যায়, ভূমিভাগের চিত্র পরিমাপ ও পরিমাণ অনুসারে যখন আঁকা হয় তখন তাকে মানচিত্র (map) বলে।
(4)"A map is a flat, symbolic representation of earth or a part of earth's surface according to a scale."
মানচিত্রের প্রয়োজনীয়তা (necessity of map)
মানচিত্র হল ভূগোল চর্চার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার বা উপকরণ। বিজ্ঞানের অন্য কোনো শাখা মানচিত্রের উপর এতটা নির্ভরশীল নয়, তবে প্রয়োজনে তাঁদেরও মানচিত্র ব্যবহার করতে হয়।
(1)ঘরে বসে মানচিত্রে নজর বুলিয়ে আলাদা-আলাদা নানা তথ্য দেখে তাদের মধ্যে সম্পর্ক বুঝে নেওয়া যায়। অর্থাৎ মানচিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে কোনো বিষয় পড়লে একজন শিক্ষার্থী অতি সহজেই সব কিছুই বুঝতে পারে।
(2)মানচিত্রের সাহায্যে কোনো স্থানের সঠিক অবস্থান জানা যায়। এছাড়াও আপেক্ষিক অবস্থান এবং দূরত্ব নির্ণয় করা যায়।
(3)স্থানভেদে ভূ-প্রকৃতির বা জনবসতির কী কী আঞ্চলিক তারতম্য ঘটছে? কোথায় গ্রাম, আর কোথায় কোনো শহরের অবস্থান? -এসবই মানচিত্র দেখে ধারণা করে নেওয়া যায়।
(4)দূরবর্তী কোনো জায়গায় যেতে হলে মানচিত্রের সাহায্যে জায়গাটিকে খুঁজে বার করা যায়।
(5)বিশাল পৃথিবীর সব জায়গায় ঘুরে চাক্ষুস দেখা একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু টোপোগ্রাফিক্যাল মানচিত্রের মাধ্যমে যে-কোনো অঞ্চলের ভূমিরূপ, নদ-নদীর গতিপথ, জলাশয়, অরণ্যের অবস্থান, জনবসতি ও পরিবহন সম্বন্ধে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়।
(6)বড়ো এলাকার মানচিত্রের মাধ্যমে যেমন সেখানকার সামগ্রিক ধারণা পাওয়া যায়, তেমন ছোটো এলাকার মানচিত্র থেকে অনেক সূক্ষ্ম বিষয় জানা যায়, যেমন-মৌজা মানচিত্রের মাধ্যমে জমির অবস্থান, আয়তন, পারিপার্শ্বিক অবস্থা প্রভৃতি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।
সুতরাং, মানুষের সমাজ জীবনে মানচিত্রের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। মানচিত্র হল মূলতঃ রেখা, রং এবং বিশেষ নিয়মানুসারে বিশেষ বিশেষ সংকেতের দ্বারা অঙ্কিত এক ধরনের ভাষা, যা থেকে ভূগোলের অনেক বিষয় জানা যায়।
মানচিত্রের ব্যবহার (uses of map)
(1)কোনো স্থানের ভৌগোলিক তথ্য পাওয়ার জন্য মানচিত্রের ব্যবহার হয়।
(2)মানচিত্রের সাহায্যে বিভিন্ন স্থানের মধ্যেকার দূরত্ব নির্ণয় করে সহজে যাতায়াত করা যায়।
(3)কোনো অঞ্চলের গ্রাম, শহর, স্থলপথ, জলপথ, নদ-নদীর বিন্যাস, পাহাড়-পর্বত, মালভূমি, সমভূমি ইত্যাদির অবস্থান জানা যায় মানচিত্র পাঠের মাধ্যমে।
(4)আবহাওয়াজনিত দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রেও মানচিত্রের ব্যবহার জরুরি।
(5)আন্তর্জাতিক বা প্রশাসনিক সীমারেখার পরিবর্তন হলে তা মানচিত্রের মাধ্যমে দেখানো যায়।
(6)প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত কাজে মানচিত্রের ব্যবহার আবশ্যিক।
(7)জনসংখ্যা ও উৎপাদন সংক্রান্ত সময়ভিত্তিক মানচিত্র চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে আঞ্চলিক ও কালগত বৈষম্য বুঝতে সাহায্য করে। তাই মনে রাখতে হবে মানচিত্র কখনোই স্থান ও কাল নিরপেক্ষ নয়।
(8)শুধু ভূগোলবিদরাই নয়, বিভিন্ন পেশার মানুষ মানচিত্র ব্যবহার করে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ- বিমান, জাহাজ চালানো, পর্যটকদের ভ্রমণ, সামরিক কাজে বিশেষত সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে মানচিত্রের বিশেষ প্রয়োজন হয়।
(9)কৃত্রিম উপগ্রহের পাঠানো তথ্য মানচিত্রেই সন্নিবেশিত
(10)এছাড়া প্রশাসনিক কাজে, বিশেষত দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবহার বা কোনো অনুন্নত অঞ্চলের পরিকল্পনা গ্রহণের জন্যও মানচিত্রের দরকার হয়।
(11)পরিবহন মানচিত্রের সাহায্যে দ্রুত গন্তব্যস্থলে পৌছানেজ জন্য উপযুক্ত পরিবহনের মাধ্যমে বেছে নেওয়া যায়।
(12)আকাশের মানচিত্র থেকে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বৌজ যায়।