ভূগোল শাস্ত্রের উৎপত্তি (Origin of Geography)
পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব হল মানুষ। মানবজাতির ইতিহাস লক্ষ করলে দেখা যায় যে জীবনযাপনের তাগিদেই সে প্রথম থেকে সংগ্রামে নিয়োজিত রয়েছে। প্রকৃতির ভয়াল ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে সে জীবনসংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। ফলে যে প্রকৃতি একসময় তার কাছে বিভীষিকা ছিল, কালক্রমে সে তাকে তার আয়ত্তে এনে তাতে ক্রমাগত পরিবর্তন করে চলেছে। অনুকূল পরিবেশের বদান্যতা নিয়ে মানুষ বন-জঙ্গল কেটে বসত বানিয়েছে। খেত-খামার গড়ে তুলেছে। যাতায়াতকে সহজসাধ্য করার জন্য রাস্তা-ঘাট বানিয়েছে। মানুষের এই সব কাণ্ডকারখানা প্রাকৃতিক ভূদৃশ্যকে (Natural Landscape) ক্রমশ সাংস্কৃতিক ভূদৃশ্যে (Cultural Landscape) পরিবর্তিত করে চলেছে। এখানে বলে রাখা ভালো যে বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ কখনো কখনো প্রকৃতির দানকে উদারভাবে গ্রহণ করেছে। কখনও সে তাকে নির্মমভাবে বুঝতে ও বিশ্লেষণ করতে চেয়েছে। আজ পর্যন্ত যত শাস্ত্রের উদ্ভব হয়েছে, তাদের মধ্যে ‘ভূগোল' সবার ওপরে রয়েছে। এই শাস্ত্রের উৎপত্তির সময় ও স্থান কোথায় তা আজ নিশ্চিত করে বলা না গেলেও Dicken and Pitts (1963) বলেছেন যে অতীতে মানুষ যেদিন তার সাথি বা সঙ্গীকে মাটিতে বা বালিতে দাগ কেটে নতুন শিকারক্ষেত্রের সম্ভাব্য অবস্থান সম্বন্ধে বুঝিয়েছিল, তখন থেকেই খুব সম্ভবত এই শাস্ত্রের সূচনা হয়েছিল। প্রথমদিকে সাধারণ বর্ণনামূলক বিষয় হিসেবে এর যাত্রা শুরু হলেও, পরবর্তীকালে এর কলেবর বহু ব্যাপক ও জটিল আকার ধারণ করে। বর্তমানের অনেকগুলি সুপ্রতিষ্ঠিত বিষয় আগে এই শাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল।ভূগোল শাস্ত্রকে শুধুমাত্র প্রকৃতি সম্পর্কিত অনুসন্ধিৎসা ও পঠন-বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করলে এর বিষয়বস্তু সম্বন্ধে সামান্যই বলা হয়। সেই সঙ্গে এর ঐতিহাসিক মূল্যবোধের প্রতিও অবজ্ঞা করা হবে।কারণ হল, এককভাবে আজ পর্যন্ত এই শাস্ত্রে যত তথ্য সংগৃহীত হয়েছে, অন্য কোনো শাস্ত্রে তা সম্ভব হয়নি (বাকি 1994) Wegner (1964) এই শাস্ত্রের ব্যাপকতা ও গভীরতা লক্ষ করে বলেছেন যে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে ভূগোল-বিষয় সবচেয়ে বেশি তথ্যসমৃদ্ধ। ব্যাপক অর্থে ভূগোল ও ইতিহাস শাস্ত্রের মধ্যে এক যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত থেকে সম্ভবত ইতিহাস রচিত হয়েছে। আরও বিস্তারিতভাবে বলতে ইচ্ছে করে যে বিভিন্ন ঘটনার পারস্পরিক সম্পর্ক বিচার করাই হচ্ছে ইতিহাসের প্রধান আলোচনার বিষয়। সিরাজুর চৌধুরী (1988) যথার্থই লিখেছেন যে ঠিক একইভাবে যদি গোটা বিশ্বজুড়ে একই ভূমিভাগ থাকত, যদি সর্বত্র একই ধরনের মানুষ বাস করত, আর তারা একই ধরনের জীবিকায় নিয়োজিত থাকত, তবে ভৌগোলিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন হত না। কিন্তু বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে ঐক্যের চেয়ে অনৈক্যই চোখে পড়ে। তাই ভূগোলবিদরা অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণে নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। ক্ষেত্রীয় বিভেদন (Areal differentiation) ও আঞ্চলিক সমধর্মিতা বিশ্লেষণ ভূগোলের প্রধান উপাদান হলেও এদের মধ্যে বিরাজমান কার্যকারণ সম্পর্ক অনুসন্ধানই হচ্ছে এই শাস্ত্রের প্রধান আলোচ্য বিষয়। আরও বিস্তারিতভাবে বলতে হয় যে ইতিহাস ছাড়া ভৌগোলিক অনুসন্ধান পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় না। কারণ, সবকিছুই সময়ের বিবর্তনে রূপান্তরিত হয়ে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে। তাই বর্তমানকে জানতে হলে অতীতকেও জানতে হবে। ভবিষ্যৎ অনুধাবন করতে অতীত ও বর্তমানের এক সমন্বয়ী উপলব্ধি চাই। তাই Perpillou (1966) মন্তব্য করেছেন যে ভূগোল-শাস্ত্ৰ সেইদিক দিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ইতিহাস অনুশীলনের অনুরূপ। দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় ইতিহাস ছাড়াও অন্যান্য বিষয় থেকে সংগৃহীত চিন্তাধারা এই শাস্ত্রের উৎকর্ষতা আরও বাড়িয়েছে। সেই সঙ্গে এই শাস্ত্র বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত হয়েছে। তবে, এই শাস্ত্র যখন প্রাকৃতিক (Physical) ও মানব (Human) শাখাহুর-এ বিভক্ত হল, তখন থেকে এর নতুন করে পথ চলা শুরু হল। প্রকৃতির মধ্যে মানুষের অবস্থান নির্ণয় করার মধ্যে দিয়ে মানব ভূগোলের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। ধীরে ধীরে ভূগোলের এই উপশাখার কলেবর আরও বাড়ল। এই উপশাখার বিভিন্ন বিষয়গুলি একে অপরের সঙ্গে এত ওতপ্রোতভাবে যুক্ত যে এগুলির মধ্যে অনেক সময় বিভাজনকারী সীমারেখা টানা সম্ভবপর হয় না। মানবীয় ভূগোলের এমনি এক গুরুত্বপূর্ণ শাখা হল 'জনসংখ্যা ভূগোল'। এই ভূগোলের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে যে মানুষ, সেই মানুষের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করে এই ভূগোল।
মনে রাখতে হবে জনসংখ্যা বিষয়ক অধ্যয়ন বহুদিন সমাজবিজ্ঞানে (ভৌগোলিক সহ) আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এর বিষয়সূচি ও পদ্ধতিগত সমস্যা অবশ্য ভিন্ন ভিন্নভাবে পাঠ করা হয়। ভূগোল শাস্ত্রে জনসংখ্যার বণ্টন বহুদিন যাবৎ সনাতন মানবীয় ভূগোলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও ঐতিহ্যগতভাবে ভূগোলকে প্রাকৃতিক ও মানবীয় ভূগোল এই দুই শাখায় ভাগ করা হয়, তবু ভূগোল শাস্ত্রে মানুষের স্থান নিয়েই ভৌগোলিকদের নিজেদের মধ্যেই বিষয়গত বিতর্ক (academic dispute) রয়ে গেছে (Clarke, 1965) ।
এই ধরনের প্রশ্নের পেছনে রয়েছে পূর্ববর্তী ভৌগোলিকদের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া। সাধারণভাবে ভূগোলকে দীর্ঘদিন যাবৎ ভূবিজ্ঞান হিসেবে গণ্য করা হয়। এখানে পৃথিবীর বাসিন্দাদের চেয়ে পৃথিবীর (ভূপৃষ্ঠের) বিশ্লেষণে বেশি দৃষ্টি দেওয়া হয়। যাই হোক, ভূগোল যে সমাজবিজ্ঞানের একটি বিষয় এই ধারণা বেশি করে আমাদের মনে বন্ধমূল হওয়ার পর ভৌগোলিকরা অনসংখ্যা ও তার সঙ্গে তার সমস্যাবলি প্রকাশনার ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়েছেন।
পরিবেশ অধ্যয়ন থেকে মনুষ্যকুলের দিকে ভৌগোলিকদের দৃষ্টিভঙ্গির এই যে পরিবর্তন তা ধীরে ধীরে হয়েছে। ফরাসি দেশে ভিদাল্-দি-লা ব্লাঁ, জিন ব্রুনস এবং ম্যাক্রিমিলেন সরি-র অবদান এ বিষয়ে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের আর্থার গেডেস ভৌগোলিদের মধ্যে জনসংখ্যা অধ্যয়নের গুরুত্ব সম্পর্কে প্রথম দৃষ্টিপাত করেন। যুক্তরাষ্ট্রে বার্কার (Barker), ম্যাককাটি (Maccarty) প্রভৃতি সমাজবিজ্ঞানীরা জনসংখ্যার অর্থনৈতিক বিষয়ে গুরুত্ব দিলেন। অরোসু (Aurouseau), জেফারসন (Jefferson) ভূগোলের এই শাখার প্রতি বেশি করে দৃষ্টি দেওয়ার জন্য কিছু প্রবন্ধও প্রকাশ করেছেন।
1953 সালকে ভূগোলের এই শাখার বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ বৎসর বলা যেতে পারে। এই বছরই Trewartha'Association of American Geographers'-র অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে ভূগোলশাস্ত্রের ‘জনসংখ্যা' নামক উপ-বিষয় খোলার জন্য বক্তব্য রাখলেন। ওই অধিবেশনে তিনি A Case for Popu lation Geography নামক প্রবন্ধে ভূগোলের একটি শাখা হিসাবে জনসংখ্যা ভূগোলের উন্নয়ন সাধনের জন্য চেষ্টা করেন। ভৌগোলিক এলাকার বিভিন্নতা এবং বৈশিষ্ট্যের আলোকে জনসংখ্যার স্বতন্ত্র পর্যালোচনা ভৌগোলিকদের মধ্যে জাগিয়ে তোলা ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। এই উদ্দেশ্যে তিনি তিন স্তর বিশিষ্ট মূল কাঠামোর প্রস্তাব করেন।
1. জনসংখ্যার অধ্যয়ন ভূগোলের একটি প্রাণবন্ত বিষয়। তাই জনসংখ্যার পর্যালোচনা করার সময় মানুষকে অন্যতম প্রধান শক্তি হিসাবে গণ্য করা উচিত, কারণ মানুষ প্রকৃতির বিভিন্ন জিনিসের রূপান্তর ঘটিয়ে উৎপাদন এবং ভোগ করে।
মানুষের ব্যবহারের জন্য প্রাকৃতিক জগৎ বিভিন্ন সম্পদের জোগান দেয় এবং
3. সংস্কৃতি হচ্ছে মূলত প্রাকৃতিক বস্তু থেকে মানুষের সৃষ্ট এক জগৎ।
উপরোন্ত ত্রিমুখী শ্রেণিবিন্যাসে তিনি জনসংখ্যাকে ঐক্যবদ্ধ ভৌগোলিক কাঠামোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এবং সুস্পষ্ট স্থান করে দেন। ইতিপূর্বে প্রচলিত ভূগোলের দ্বিমুখী শ্রেণিবিন্যাসে কেবলমাত্র প্রাকৃতিক • সাংস্কৃতিক উপাদানগুলির স্বীকৃতি ছিল (দে, 2004)।
Trewartha-র পর জনসংখ্যা ভূগোলের ক্রমবিকাশের পথে এগিয়ে আসেন জেলেনস্কি (Zelinsky)। A Prologue to Population Geography-তে তিনি বলেছেন জনসংখ্যা ভূগোল প্রধানত বৃহত্তর ভূগোলের একটি শাখা। তাঁর মতে জনসংখ্যা ভূগোল নিজের পূর্ণতার জন্যই জনবিজ্ঞানের (Demography) বিভিন্ন বিষয়ের সহায়তা গ্রহণ করে। তিনি বলেছেন জনসংখ্যা ভূগোলের অধ্যয়ন তিনটি পদ্ধতিতে হতে পারে।
(ক) অঞ্চলভেদে মানুষের সংখ্যা ও বৈশিষ্ট্যসমূহের সাধারণ বর্ণনা।
(খ) মোট জনসংখ্যার সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও বাহ্যিক গঠনের বর্ণনা।
(গ) জনসংখ্যার অপরাপর আনুষঙ্গিক কারণের ভৌগোলিক বিশ্লেষণ।
জেলেনস্কি-এর মতে জনসংখ্যার বিভিন্ন নির্ধারকগুলি স্থান ও কাল ভেদে আলাদা হতে পারে। আবার কোনো অঞ্চলের মানুষের বৃদ্ধি চারিত্রিক নিয়মে গঠিত হয়। তিনি সুপারিশ করেন যে জনসংখ্যা ভূগোলবিদরা নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে জনসংখ্যার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য আলোচনার সময় জাতিসমূহের বিশ্লেষণাত্মক অভিজ্ঞতা প্রয়োজনে গ্রহণ করতে পারে।
জেলেনস্কি মানুষের বৈশিষ্ট্যকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা
(ক) প্রয়োজনীয় জৈবিক কার্যাবলি। (খ) আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যাবলি।
(গ) জনসংখ্যার পরিবর্তন ও গতিশীলতা।
মূলত ও Zelinsky-র আলোচনা এবং গবেষণার পথ ধরেই পরবর্তীতে ভৌগোলিকরা এগিয়ে আসেন এবং জনসংখ্যা একটি পৃথক ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত শাখা হিসাবে গড়ে তোলেন। এদের মধ্যে Beaujeu Garnier, Ackeman, Griffen-এর নাম করা যায়। Garnier তাঁর আলোচনায় জনসংখ্যার পৃথিবীব্যাপী বণ্টন, মনুষ্য সমাজের ক্রমবিকাশ ও মানুষের অর্জিত সাফল্যের মাত্রা ইত্যাদি বিষয়গুলি এই ভূগোলের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিকে সুপারিশ করেন। তাঁর মতে জনসংখ্যা ভৌগোলিক প্রদত্ত পরিবেশে বিভিন্ন জনতাত্ত্বিক উপাদানের নিয়ামক ও তাদের কার্যকারণের পর্যালোচনা পাশাপাশি মূল বৈশিষ্ট্য ও সম্ভাব্য পরিণতি বর্ণনা করবেন। পক্ষান্তরে, এ্যকারম্যান বিভিন্ন পর্যায়ে জনসংখ্যা ভূগোলের সমস্যাদির সীমা নির্দেশসহ ভূগোল শাস্ত্রে জনসংখ্যার গবেষণার ব্যাপারে সুস্পষ্ট সূচকের কথা বলেছেন। তিনি জনসংখ্য ভূগোলের পরিধি ও বিষয়বস্তু আরও বিস্তৃত করতে সক্রিয় চেষ্টা করেন। জনসংখ্যার ভূগোলে Griffen জনসংখ্যার পরিমাণগত ও গুণগত নিয়ামক সমূহ স্থান দিয়ে তাদের সংখ্যাতাত্ত্বিক ও পরিবেশগত বিশ্লেষণের ওপর গুরুত্ব দেন।
এইভাবে অনসংখ্যা ভূগোলের ক্রমবিকাশ ঘটেছে এবং বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই গোটা বিশ্বে ভূগোল শাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ আলানা শাখা হিসাবে এই উপবিষয় স্বীকৃতি লাভ করেছে।