তরঙ্গ বিযুক্তি(Wave Discontinuity)
সাধারণত ভূ-অভ্যন্তরের মধ্য দিয়ে যখন 'P' ও 'S' তরঙ্গোর প্রবাহ ঘটে তখন আলোক তরঙ্গের মতো প্রতিফলন ও প্রতিসরণ ঘটে। অর্থাৎ এক ঘনত্বের শিলাস্তর থেকে অন্য ঘনত্বের স্তরে প্রবাহের সময় 'P' ও 'S' তরঙ্গোর গতিপথ পরিবর্তিত হয়, একে তরঙ্গ বিযুক্তি (wave discontinuity) বলে। অন্যভাবে বলা যায় যে, বিভিন্ন উপাদানের তারতম্য অনুসারে ভূ-অভ্যন্তরের স্তর ভাগগুলি একে অপরের সঙ্গে সূক্ষ্ম সীমারেখায় মিলিত হয়েছে, যাতে দুটি ভরের মধ্যে সহজে পার্থক্য করা যায়। সেই কাল্পনিক সীমারেখাকে বিযুক্তি রেখা বলে। এই রেখাগুলি বিভিন্ন গভীরতায় অবস্থান করে। এই রেখাগুলির আপেক্ষিক ঘনত্বও বিভিন্ন প্রকারের হয়। এই বিযুক্তি তরঙ্গের গতির ওপর নির্ভর করে। তরঙ্গের গতি আবার পদার্থের ভৌত ধর্মের উপর নির্ভর করে। এভাবে প্রতিফলন ও প্রতিসরণের কোণের মান থেকে ভূ-অভ্যন্তরের পদার্থের বৈশিষ্ট্য জানা যায়। তাছাড়া ভু-কম্পন তরঙ্গঙ্গ বিভিন্ন স্তরের বিযুক্তিগুলির সীমারেখা চিনতে সাহায্য করে। নীচে কয়েকটি প্রধান বিযুক্তিতল বা রেখা সম্বন্ধে আলোচনা করা হল-
(i) কনরাড বিযুক্তি (Conrad Discontinuity)
ভূত্বকের সিয়াল (SIAL) এবং সিমা (SIMA) স্তরের সংযোগস্থলে এই বিযুক্তি অবস্থিত। অস্ট্রিয়ার বিজ্ঞানী ভি. কনরাড (V. Conrad) 1925 সালে এর পরিচিতি ঘটান এবং তাঁর নাম অনুসারে একে কনরাড বিযুক্তি (Conrad Discontinu-ity) বলা হয়। শিলাস্তরের উপরের অংশের গ্রানাইট জাতীয় শিলা এবং এর নীচে অংশের ব্যাসল্ট জাতীয় শিলা স্তরের মধ্যে একটি বিচ্ছেদ তল লক্ষ করা যায়। এটি কনরাড বিযুক্তি নামে পরিচিত। এই বিযুক্তি তল ভূত্বককে দুটি ভাগে ভাগ করেছে। যথা- (a) মহাদেশীয় ভূত্বক এবং (৮) মহাসাগরীয় ভূত্বক। এটি প্রকৃত পক্ষে হালকা গ্রানাইট এবং ভারী ব্যাসল্ট শিলার সীমারেখা। 'P' তরঙ্গের গতিবেগ এখানে হঠাৎ করে বেড়ে সেকেন্ডে 6 কিমি থেকে প্রায় 6.5 কিমিতে পরিণত হয়। মহাদেশে এই বিযুক্তিতলের অবস্থান 15-20 কিমির নীচে। কিন্তু সমুদ্রতলে এটি অনুপস্থিত। এই রেখা বরাবর ভূকম্প তরঙ্গের গতি-প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়।
(ii) মোহোরোভিসিক বিযুক্তি (Mohorovisic Discontinuity)
ভূত্বক ও গুরুমণ্ডলের মধ্যে একই বিযুক্তি অবস্থিত।
ভূ-কম্পীয় পদ্ধতির সাহায্যে জানা যায় যে, মহাদেশীয় ভূ-ভাগের তলদেশ ও মহাসাগরের তলদেশের মধ্যে বিভিন্ন দিক দিয়ে অনেক পার্থক্য রয়েছে। এই দুই তলদেশের মধ্যে গভীরতার পার্থক্য যথাক্রমে 32 ও 3. P তরঙ্গের গতিবেগের পার্থক্য যথাযথ 7 ও ৪ আবার তলে উপস্থিত পদার্থের যথাক্রমে কম ঘনত্বযুক্ত ও খুবই অল্প মাত্রায় ব্যাসল্ট এবং উভয় তলদেশের মধ্যে রাসায়নিক গঠনের পার্থক্য লক্ষ করা গেছে। এই ব্যাসল্ট স্তরের নীচের অংশই তার পরবর্তী ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ম্যান্টেল শিলাস্তরের (mantle rock) সাথে সুনির্দিষ্ট সীমানা নির্দেশ করে। এই পরিবর্তন প্রথম লক্ষ করেন যুগোস্লাভিয়ার বিখ্যাত ভূবিজ্ঞানী এ. মোহোরোভিসিক 1909 সালে। তাঁর নাম অনুসারে এই বিযুক্তিতলের নাম হয় মোহোরোভিসিক বিযুক্তিতল (Mohorovisic Discontinuity)। ভূ-অভ্যন্তরের এইরকম প্রথম বিচ্যুতি ধরা পড়ে মহাদেশে 35 কিমি এবং সমুদ্রতলে 5-10 কিমি গভীরতায়। এই পরিবর্তন বা বিযুক্তির কারণ ভূত্বক থেকে গুরুমণ্ডলের ঘনত্বের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। এই ভূত্বক ও গুরুমণ্ডলের সীমারেখা নির্দেশক। এখানে উভয় তরঙ্গের গতিবেগ কিছুটা বেড়ে যায়।
ii) গুটেনবার্গ বিযুক্তি (Gutenberg Discontinuity)
ভূ-অভ্যন্তরে মোহোরোভিসিক বিযুক্তি থেকে 2900 কিমি গভীরতায় গুরুমণ্ডল ও কেন্দ্রমণ্ডলের মধ্যে ইউশার্ট গুটেনবার্গ বিযুক্তি তল অবস্থিত। মোহোবিযুক্তি থেকে 410 কিমি গম্ভীরতা পর্যন্ত স্তরটি গুটেনবার্গ স্তর নামে পরিচিত। অর্থাৎ ভূকম্পের গতিতে অনুরূপ আর একটি বিযুক্তিতল লক্ষ করা যায় 2900 কিমির নীচে, যাকে সর্বপ্রথম জার্মান অধ্যাপক বিজ্ঞানী তথা ভুকম্পবিদ, গুটেনবার্গ 1897 সালে চিহ্নিত করেন বলে এর নাম অনুসারে গুটেনবার্গ বিযুক্তিতল (Guten-berg Discontinuity) বলা হয়। কিন্তু পরবর্তী সময় অর্থাৎ 1912 সালে প্রফেসর বেনো গুটেনবার্গ এই বিচ্ছেদ তল বৈজ্ঞানিক যুক্তি সহকারে ব্যাখ্যা করেন। বহিঃকেন্দ্রমণ্ডল ও নিম্ন গুরুমণ্ডলের মধ্যে এই বিযুক্তি রেখাটি অবস্থিত। এই অংশে 5 তরঙ্গোর প্রবাহ বিলুপ্ত হয়, এবং P তরঙ্গের গতিবেগ কমে যায়। এটি প্রকৃতপক্ষে গুরুমণ্ডল ও কেন্দ্রমণ্ডলের সীমানা নির্দেশক। ভূগর্ভে চাপে ও তাপে শিলার কিছু অংশ গলে গিয়ে স্তরটি সান্দ্র অবস্থায় পরিণত হয়। অর্থাৎ শিলার ঘনত্ব কমে যায়। তাই 'P' তরঙ্গের গতিবেগ কমে যায়। তাই এই স্তরকে স্বল্প গতিবেগ সম্পন্ন অঞ্চল বলা হয়। একে অনেকে ওল্ডহাম বিযুক্তি রেখাও বলে। এই স্তরের আপেক্ষিক ঘনত্ব 5.5-10 গ্রাম/ঘন সেমি।
(iv) র্যাপিটি বিযুক্তি (Rapiti Discontinuity)ed
গুরুমণ্ডল দুটি ভাগে বিভক্ত যথা ঊর্ধ্বগুরুমণ্ডল (ক্লোফেসিমা) ও নিম্ন গুরুমণ্ডল (নিফেসিমা)। এই ঊর্ধ্বগুরুমণ্ডল ও নিম্নগুরুমণ্ডলের মধ্যবর্তী সীমানায় উপস্থিত র্যাপিটি বিযুক্তি। ভূবিজ্ঞানী র্যাপিটি এই বিযুক্তি তলটি আবিষ্কার করেন। এই রেখাটি ভূপৃষ্ঠ থেকে 700 কিমি গভীরতায় অবস্থিত। এই স্তরের আপেক্ষিক ঘনত্ব 4.3 গ্রাম/ঘন সেমি।
(v) লেম্যান বিযুক্তি (Lehman Discontinuity)
এই বিচ্ছেদ তলটি কেন্দ্রমন্ডলের বহিঃ ও অন্তঃকেন্দ্রমন্ডলের মধ্যে অবস্থিত। এই তলটি 1936 সালে ডেনমার্কের ভূকম্পবিদ ইলো লেম্যান 5150 কিমি গভীরতায় সন্ধান পান যা লেম্যান বিযুক্তি নামে পরিচিত। এই স্তরটি সান্দ্র প্রকৃতির। এই তলে P তরঙ্গের গতিবেগ বাড়তে দেখা যায়। এই তলের আপেক্ষিক ঘনত্ব 12.3-13.3 গ্রা6rম/খন সেমি।