নদী অববাহিকার ভূ-রূপমিতি-র ধারণা (concept of river basin morphometry)
নদী অববাহিকার অবস্থা জানতে গেলে তার ভূ-রূপমিতি জানা একান্ত প্রয়োজন। ভূ-রূপমিতি বা morphometry কি জানা দরকার। উত্তর হল জ্যামিতিক আকৃতিবিশিষ্ট কোন ভূমিরূপের বিশ্লেষণের যে সব পদ্ধতি ব্যবহার কার হয় তাকে আকার ভূ-রূপমিতি বলে। ক্লার্ক-এর ভাষায় (J. I. Clark, 1970) "morphometry may be defined as the measurement and mathematical analysis of the configuration of the earth's surface and of the shape and dimensions of its landformed." বস্তুতঃপক্ষে ভূ-রূপমিতির কোনো এলাকার পরিমাণ বাচক বিশ্লেষণ, উচ্চতা, আয়তন, ঢাল, ভূমিরূপের শরক্ষুন্ন এবং কোনো এলাকা নদী অববাহিকার বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে। ভূ-রূপমিতির দুটি স্বতন্ত্র শাখা আছে। ।) বন্ধুরতা ভূ-রূপমিতি (relief morphometry) এবং ঘ) নদীগঠিত ভূ-রূপমিতি (fluvial morphometry)। প্রথমটির মধ্যে রয়েছে ভূমিরূপ বৈশিষ্ট্যের বিশ্লেষণ, যাতে আমরা হিসামোমেট্রিক কার্ড বা বক্ররেখা, ক্লাইনোক্রাফিক কার্ড, আয়তন-উচ্চতা লেখচিত্র, অন্টিমেট্রিভ ফ্রিকোয়েন্সি, হিস্টোগ্রাম লেখচিত্র, অধ্যারোপিক, প্রোজেক্টেড ও যুগ্ম প্রতিমূর্তি যা কোনো নদী অববাহিকার ভূমিরূপ বিশ্লেষণের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণে সাহায্য করে।
দ্বিতীয়টি নদী অববাহিকা রৈখিক, আয়তন ও বর্ণবয়স বিষয়টি বিশ্লেষণ করে। রৈখিক দিকের মধ্যে রয়েছে নদীত্রন নদী দৈর্ঘ্য, নদী সংখ্যার নিয়ম ইত্যাদি। আয়তনগত বৈশিষ্টের মধ্যে রয়েছে অববাহিকার আয়তন, অববাহিকার আকৃতি, নদীর পৌনঃপুনিকতা, নদী ঘনত্ব ইত্যাদি। বন্ধুরতা বিষয়ের মধে উচ্চতা নির্দেশক লেখচিত্র (হিপসোমেট্রিক), ক্লাইনেগ্রাফ ৭উন্নতি লেখচিত্র ছাড়া রয়েছে নিরপেক্ষ ও আপেক্ষিক বন্ধুরত গড় ঢাল, ব্যবচ্ছেদীকরণ সূচক ইত্যাদি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় যে পূর্বে নদী বিষয়ক সমীক্ষার জন্য বর্ণনামূলক পদ্ধতি (Descriptive approach) অবলম্বন করতে হয়। Horton সর্বপ্রথম 1932 সালে ও পরে 1945 সালে এই গতানুগতিক ধারার পরিবর্তন ঘটিয়ে সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ পদ্ধতি চালু করেন। হর্টন, সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে নদী অববাহিকা ও তার বিন্যাসের মধ্যে সম্পর স্থাপনে সচেষ্ট হন। 1947 সালে W. B. Langbein বিজ্ঞানের এই শাখার একটি পরিপূরক গবেষণা সম্পন্ন করেন। আর্থার এন. স্ট্রলার (Arther N. Strahler) 1958 সালে তার সহযোগীদের নিয়ে এই ক্ষেত্রে বিস্তারিত গবেষণা করেন ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে হর্টনের বিশ্লেষণের পরিবর্তন ঘটান।
নদী অববাহিকার ভূ-রূপমিতি নিয়ন্ত্রণকারী উপাদানসমূহ (controlling factors of river basin morphometry)
① অববাহিকার আকৃতি (basin shape):
নদী অববাহিকার বিভিন্ন আকৃতি নদীতে জল সরবরাহের হারকে নিয়ন্ত্রণ করে। "the shape of the drainage basin mainly germs the rate of which water is supplied to the main stream at it proceeds alone its course from the source to the mouth" উদাহরণ- পাতার আকৃতি অববাহিকা (leaf shaped basin) কিংবা ফাঁদল (funnel) আকৃতির অববাহিকার তুলনায় বাঁধাকপি আকৃতির (cauliflower) অববাহিকায় জল নিষ্কাশন তাড়াতাড়ি হয়। এখন গঙ্গার উচ্চ গতিতে যদি বন্যা হয়, তবে ঐ জল পশ্চিমবঙ্গে নামতে কয়েকদিন লাগবে। সেই তুলনায় দার্জিলিং জেলার বালা সন নদী উচ্চ গতিতে যদি বন্যা হয় তবে তার জল মোটামুটি পরের দিনই শিলিগুড়িতে নামবে। কারণ বালাসন নদীর অববাহিকা অনেকটাই পাতার মতো।
এখন প্রশ্ন হল, নদী অববাহিকার বিভিন্ন আকৃতির গুরুত্ব কি? বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে অববাহিকার আকৃতির গুরুত্ব আছে। যেমন নদীর উচ্চ অববাহিকাতে বন্যা হলে নদীর নিম্ন অববাহিকায় বন্যা সম্বন্দ্বে আগাম সতর্ক করা যায়। প্রয়োজনে ড্যামের মাধ্যমে বন্যার জলকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আবার পাতা-আকৃতির অববাহিকার নদীর গতিপথ সাধারণত বন্ধুর হয়। তাই তা জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের পক্ষে উপযুক্ত। পক্ষান্তরে, বৃহৎ পত্ররূপ নদী অববাহিকার উচ্চ গতি উচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপযোগী। আবার নিম্নাঞ্চল জলসেচ ব্যবস্থার পক্ষে ভাল।
②উচ্চতা (উচ্চতা):
উচ্চতা নদী অববাহিকার জলের পরিমাপকে নিয়ন্ত্রণ করে। দাক্ষিণাত্যের মালভূমি ও হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের কথা ধরা যাক। দাক্ষিণাত্যের মালভূমির উচ্চতা কম। হিমালয়ের উচ্চতা অনেক অনেক বেশি বলে এখানে অনেক হিমবাহ রয়েছে; যা থেকে সারা বছর নদীতে জল পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে দাক্ষিণাত্যের নদীগুলি বৃষ্টির জলে পুষ্ট বলে নদীগুলিকে অ-নিত্যবাহী (non-perenial) বলে।
ঢাল (slope):
ভূ-অভ্যন্তরে জলের প্রবেশ, জলধারা প্রবাহ, মৃত্তিকার আর্দ্রতা, নদী প্রবাহে ভৌমজলের ভূমিকাতে ঢালের একটি ভূমিকা আছে। পাহাড়ী এলাকায় খাড়া ঢালের জন্য বৃষ্টির জল সরাসরি নিচে নেমে আসে। তাই ভূমিতে জল প্রবেশ করে কম।
পাহাড়ী এলাকায় ভৌমজলস্তর অনেক নিচে থাকে। পক্ষান্তরে, মোটামুটি সমতল জায়গায় ভূমিতে জল প্রবেশ করে অতি শীঘ্র। অবশ্য কাদামাটি বা বেলেমাটির ক্ষেত্রে কিছু পার্থক্য আছে। গ্রীষ্মকালে যখন নদীর জল শুকিয়ে আসে, তখন ভৌমজল নদীপ্রবাহ বজায় রাখতে সাহায্য করে।
④দিক (অভিযোজন):
নদী অববাহিকায় দিকের ভূমি যথা হিমালয়ের দক্ষিণমুখী ঢালের কিছু অংশ অধিক সূর্যালোক পায়, তাই সেদিকে বরফ গলে বেশি। উত্তরদিকে কম সূর্যালোক পাওয়ায় সেখানে বরফ সারা বছর জমে থাকে। আবার যে দিক সূর্যালোক বেশি পায়, সেদিকে বাষ্পীভবন ও প্রস্বেদন দুই-ই বেশি হয়। ফলে নদীতে জল সরবরাহ কম ঘটে।