বায়ুচাপের নিয়ন্ত্রকসমূহ (Factors Controlling Atmospheric Pressure) :
বায়ু যেহেতু বিভিন্ন গ্যাসের মিশ্রণ, তাই বায়ু গ্যাসের সূত্র অনুসরণ করে চলে। তাই এই সূত্রগুলি অনুসরণ করলেই বোঝা যাবে বায়ুর চাপের প্রধান নিয়ন্ত্রকগুলি কী কী। গ্যাসের ধর্ম সংক্রান্ত দুটি সূত্র রয়েছে। যথা-চার্লসের সূত্র এবং বয়েলের সূত্র।
এই দুই সূত্র অনুযায়ী বায়ুচাপের তারতম্যের প্রধান কারণগুলি হল-
1. বায়ুর উষ্ণতা (Temperature of Air) :
চার্লসের সূত্রানুসারে বায়ুর উন্নতা বৃদ্ধি পেলে বায়ু প্রসারিত হয়। তাই বায়ু আয়তনে বাড়ে। আবার, বয়েলের সূত্রে বায়ুর আয়তনের সঙ্গে চাপের ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ, বায়ুর আয়তন বাড়লে চাপ কমে। কারণ বায়ু আয়তনে বাড়লে বায়ুর ঘনত্ব হ্রাস পায়। আবার, বায়ু শীতল হলে সঙ্কুচিত হয়ে আয়তনে হ্রাস পায়। ফলে ভারী হয় বলে চাপ বেশি হয়ে থাকে। এই কারণে বছরের বিভিন্ন সময় পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে
2. সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা (Altitude from the sea level) :
সমুদ্রপৃষ্ঠের ওপর বায়ুর চাপ সর্বাধিক অনুভূত হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা যত বৃদ্ধি পায় গ্যাসীয় পদার্থের পরিমাণ তত কমতে থাকে। এ ছাড়া অপেক্ষাকৃত অধিক ভর বিশিষ্ট গ্যাসীয় অণুগলি নীচের দিকে অবস্থান করে এবং উচ্চতা বৃদ্ধিতে তুলনামূলকভাবে কম আণবিক গুরুত্ব বিশিষ্ট গ্যাসীয় অণুগুলির অবস্থান লক্ষ করা যায়।
স্বাভাবিকভাবেই সমুদ্রের কাছাকাছি বায়ুস্তরের ঘনত্ব বেশি হওয়ায় অধিক চাপ অনুভূত হয় এবং ওপরের দিকে বায়ুস্তর ক্রমশ পাতলা হয় বলে বায়ুচাপ কমতে থাকে। দ্বিতীয়ত, নীচের বায়ুস্তরের ওপর ওপরের বায়ুস্তরের ভার এসে পড়ায় ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুর চাপ সবচেয়ে বেশি হয়। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ট্রপোস্ফিয়ারে প্রতি 270 মিটার উচ্চতা বৃদ্ধিতে 34 মিলিবার বা প্রতি 900 ফুট উচ্চতা বৃদ্ধিতে 1" হারে বায়ুচাপ হ্রাস পায়। উষ্ণতার পার্থক্য ঘটে বলে বায়ুচাপের পার্থক্য লক্ষ করা যায়।
3. পৃথিবীর আবর্তন (Rotation of the Earth) :
পৃথিবী যেহেতু নিজ অক্ষের ওপর পশ্চিম থেকে পূর্বে আবর্তিত হচ্ছে তাই আবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট কোরিওলিস বল, ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে ঘর্ষণজনিত বল (frictional force) এবং পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের ফলে সৃষ্ট কেন্দ্রাতিগ বল বায়ুচাপের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। সূর্যরশ্মি অতি তির্যকভাবে পড়ায় দুই মেরুবৃত্তীয় অঞ্চলে বায়ুর উয়তা সর্বদাই কম থাকে। তাই স্বাভাবিক নিয়মে সেখানে স্থায়ী উচ্চচাপ অবস্থান করার কথা কিন্তু আবর্তন গতির প্রভাবে মেরুবৃত্তীয় অঞ্চল থেকে বায়ু ছিটকে ক্রান্তীয় ও মেরু অঞ্চলের দিকে চলে আসে, ফলে মেরুবৃত্তীয় অঞ্চলে স্থায়ী নিম্নচাপ বিরাজ করে। আবার, ক্রান্তীয় অঞ্চলে যেখানে উয়তা অধিক সেখানে বায়ুর চাপ কম হওয়ার কথা কিন্তু মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় অঞ্চল ও নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে বায়ু এসে এই অঞ্চলে সঞ্চিত হয়ে স্থায়ী উচ্চচাপ বলয় সৃষ্টি করেছে।
4. বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ (Amount of Water Vapour):
জলীয় বাষ্প বিশুদ্ধ বায়ু অপেক্ষা হালকা। এই কারণে জলীয় বাষ্পপূর্ণ আর্দ্র বায়ু শুষ্ক বায়ু অপেক্ষা হালকা হয়। তাই বায়ুচাপও কম হয়। শুষ্ক বায়ু অধিক ভারী হওয়ায় চাপ বেশি হয়ে থাকে। আবার, জলীয় বাষ্পের ধারণক্ষমতা বায়ুর উয়তার ওপরও নির্ভর করে। কারণ উয়তা বাড়লে বায়ুর জলীয় বাষ্প ধারণক্ষমতাও বাড়ে। এই কারণে আমাদের দেশে শীতকালের তুলনায় বর্ষাকালে বায়ুর চাপ কম অনুভূত হয়।
5. বায়ুমণ্ডলের গভীরতা (Depth of Atmosphere):
ভূপৃষ্ঠের যেসকল স্থানে বায়ুর গভীরতা বেশি সেখানে বায়ুর ঘনত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় বায়ুর চাপও বেশি অনুভূত হয়। অনুরূপভাবে, যে স্থানে বায়ুমণ্ডলের গভীরতা কম সেখানে বায়ুর চাপও কম হয়ে থাকে। এই কারণে পার্বত্য অঞ্চলের মধ্যস্থিত উপত্যকাগুলিতে বায়ুর চাপ অধিক পরিলক্ষিত হয়।
6. স্থলভাগ ও জলভাগের বণ্টন (Distribution of land and water bodies):
স্থলভাগ সূর্যের তাপে যেমন দ্রুত উত্তপ্ত হয়, তেমনি তাপ বিকিরণ করে দ্রুত শীতল হয়। কিন্তু জলভাগ অত্যন্ত ধীরে ধীরে উত্তপ্ত ও শীতল হয়। বায়ু যেহেতু প্রত্যক্ষভাবে সৌরশক্তি গ্রহণ করতে পারে না, তাই পরোক্ষভাবে স্থলভাগ বা জলভাগ থেকে তাপ শোষণ করে বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয়। তাই দিনের বেলায় বা গ্রীষ্মকালে স্থলভাগ সংলগ্ন বায়ু অধিক উত্তপ্ত হওয়ায় স্থলভাগে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয় এবং রাতের বেলায় জলভাগ স্থলভাগের তুলনায় ধীরে শীতল হওয়ায় জলভাগ সংলগ্ন বায়ুও ধীরে ধীরে শীতল হয়, সেই কারণে জলভাগে রাতে বা শীতকালে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়।
7. স্বাভাবিক উদ্ভিদের বণ্টন (Vegetation coverage) :
সবুজ উদ্ভিদ প্রচুর পরিমাণে প্রস্বেদন ঘটায়, যা প্রত্যক্ষভাবে বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু সাধারণ বায়ুর তুলনায় হালকা হয়, তাই স্বাভাবিকভাবেই বায়ুচাপ কম অনুভূত হয়। নিরক্ষীয় বৃষ্টি অরণ্য অঞ্চলে এই কারণেও বায়ুচাপ তুলনামূলকভাবে কম হয়।
৪. অভিকর্ষজ বল (Gravitational force):
অভিকর্ষজ বল বায়ুচাপের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। স্থানভেদে অভিকর্ষজ বলের পরিবর্তন হয় বলে চাপেরও পরিবর্তন হতে থাকে। কোনো স্থানের অভিকর্ষজ বল পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে দূরত্বের উপর নির্ভর করে। কেন্দ্র থেকে বায়ুস্তূপের (air parcel) দূরত্ব বাড়লে অভিকর্ষজ বল কমে এবং দূরত্ব কমলে অভিকর্ষজ বলের প্রভাব বাড়ে। তাই নিরক্ষীয় অঞ্চলের দূরত্ব ভুকেন্দ্র থেকে বেশি হওয়ায় অভিকর্ষজ ত্বরণ কমে যাওয়ায় বায়ুচাপও কম হয়। আবার, মেরুবিন্দুর দূরত্ব ভূকেন্দ্র থেকে কম হওয়ায় বায়ুচাপ বেশি হয়।