welcome to mygeo.in Indian no 1 geography based website in Bengali

পরিবেশ পাঠের ভৌগোলিক দৃষ্টিভঙ্গি (Geographers' approach to environmental studies)

পরিবেশ পাঠে ভৌগোলিকগণ বিশেষভাবে পরিবেশের সুরক্ষা ও মানোন্নয়নে আগ্রহজনক চিন্তাপ্রসূত আলোচনা শুরু করেছেন। পরিবেশবিদদের সঙ্গে ভৌগোলিকদের আলোচনায়....

 পরিবেশ পাঠের ভৌগোলিক দৃষ্টিভঙ্গি (Geographers' approach to environmental studies)


ভূমিকা

পরিবেশ পাঠে ভৌগোলিকগণ বিশেষভাবে পরিবেশের সুরক্ষা ও মানোন্নয়নে আগ্রহজনক চিন্তাপ্রসূত আলোচনা শুরু করেছেন। পরিবেশবিদদের সঙ্গে ভৌগোলিকদের আলোচনায় সাদৃশ্য থাকলেও ভৌগোলিক দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বকিয়তা রয়েছে। নিম্নে পরিবেশ পাঠে ভৌগোলিক দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ সংক্ষেপে আলোচিত হ'ল।


. সমতার নীতি প্রসূত দৃষ্টিভঙ্গি(Uniformitarianism related approach) : 

পরিবেশ পাঠে ভৌগোলিক দৃষ্টিভঙ্গি শুরু হয় ইউনিফমিটারিয়ানিজম (Uniformitarianism) বা সমতার নীতি ধারণা দিয়ে, যার অর্থ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া সমূহ যা বর্তমানে ভূত্বকের পরিবর্তনে কার্যকরী তা অতীতেও একই মাত্রায় না হলেও কমবেশি কার্যকর ছিল এবং ভবিষ্যতেও কার্যকরী থাকবে।


ইউনিফমিটারিয়ানিজম প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে কার্যকরী ধরে নিলে এটিও মেনে নিতে হয় যে জীবকূলের বিকাশের পর থেকেই জৈব প্রক্রিয়া সমূহ (Biological Process) যে প্রকারে পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনের মধ্য দিয়ে উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনে কার্যকরী আছে বর্তমানে, তা অতীতেও ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।


ভৌগোলিকদের এখন বিশেষ চিন্তার বিষয় যে, তত্ত্বগতভাবে উক্ত জৈবিক প্রক্রিয়া ভবিষ্যতেও কতটা সুষ্ঠুভাবে কার্যকরী থাকবে, আদৌ পৃথিবীর জীবজগতের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত কি না, কারণ যেভাবে মানুষ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার উপর হস্তক্ষেপ করে চলেছে, তাদের জৈবিক প্রক্রিয়ায় ইতিমধ্যেই প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, বহু প্রাণী ও উদ্ভিদ পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এবং নিশ্চিহ্ন হয়ে চলেছে। ভৌগলিকগণ এখন বিশেষ মনোনিবেশ করেছেন, কীভাবে এই সংঘাত বন্ধ না হলেও হ্রাস করে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসা যায়।


২. নিয়ন্ত্রণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি (Deterministict Approach) 

১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ই. এস. সেম্পল তার আকর গ্রন্থ "Influence of environment on man'-এ মানুষের জীবনে ও কর্মকাণ্ডে প্রকৃতির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের স্বপক্ষে বলেছেন। ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, অরণ্য, মৃত্তিকার প্রকৃতি প্রভৃতি প্রাকৃতিক পরিবেশের অধীনে মানুষের জীবনচক্র সম্পন্ন হয়েছে বহুকাল, এ কথা সত্য। এই নিয়ন্ত্রণ পৃথিবীর পরিবেশের পক্ষে অনেক বেশি মঙ্গল দায়ী ছিল বলে নিয়ন্ত্রণবাদীরা মনে করেন। বর্তমানে পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে, প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণকে মেনে নিলে তা কখনোই হতো না। কিন্তু মানুষ চালে, কবি নজরুলের ভাষায় 'সৃষ্টি সুখের উল্লাসে'। এখানেই হয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশ আর মানবিক পরিবেশের সংঘাত। এই সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে ভৌগোলিকদের নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাবার সময় এসেছে বলে নিয়ন্ত্রণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি মনে করিয়ে দেয়। রবি ঠাকুরের 'দাও ফিরে সে অরণ্য। লও এ লৌহ নগর' যদি সম্ভব হত তবে প্রাকৃতিক পরিবেশের অবনমন হয়ত ঠেকানো যেত।


৩. সম্ভাবনাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি (Possibilistic Approach) :

 প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ নয়, প্রকৃতি বহুমুখী সম্ভাবনা উপস্থাপন করে, মানুষ সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধন করে নিজেদের জীবন ও জীবিকা সুনিশ্চিত করে এবং সভ্যতার বিকাশ ঘটায়। এক্ষেত্রে মানুষই নিজের ভাগ্য নিয়ন্তা, প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ অগ্রাহ্য হয়। ভিদেল দ্য লা ব্রাশ, জা রুনে, বাওমেন, কার্ল ও সয়্যার প্রমুখ সম্ভাবনাবাদের প্রবক্তা।


উক্ত সম্ভাবনাবাদী কার্যকলাপের ফলে পরিবেশে যে প্রভূত ক্ষতিসাধন হয় তা প্রবক্তাগণ তখন কল্পনাও করতে পারেননি। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষত শিল্প বিপ্লবের পর থেকে, উক্ত সম্ভাবনাসমূহকে কাজে লাগিয়ে প্রকৃতি হয়েছে সংহারের ক্ষেত্র, পৃথিবীর দিকে দিকে হয়ে চলেছে বর্ণসংহার, ভূপ্রকৃতি ও মৃত্তিকার অবক্ষয়, জলাভূ মির ক্ষতিসাধন, বিপন্ন হয়েছে মৎস্যচারণ ক্ষেত্র, দূষিত হয়েছে জল ও বায়ু।


সেই সুদূর অতীত থেকে ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ নিজেদের রাজনৈতিক সীমানা ছাড়িয়ে প্রভুত্ব বিস্তারে নেশায় ও সম্পদ সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে, দেশে দেশে, এমনকি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ সমূহ থেকে সম্পদ সংগ্রহের নেশায় প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি সাধন করেছে। ভৌগলিকগণ পরিবেশ আলোচনায়

এই সংহারের দুশ্চিন্তায়ই মগ্ন এবং এই সংহার থেকে পরিবেশকে বাঁচানোর ফলপ্রসূ চিন্তার জন্য গবেষণা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। জনগণকে সচেতন ও প্রশাসনকে এই কাজে দ্রুত অধিকতর উদ্যোগী হতে হবে।


৪. বাস্তুতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি (Ecological Approach) :

 বর্তমানে পরিবেশের পক্ষে অ-হিতকর প্রতিযোগিতায় ভৌগোলিকগণ বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। বাস্তুতন্ত্রের অজৈব ও জৈব উপকরণসমূহ সংরক্ষণের প্রয়োজন আছে; খাদ্য শৃংখল ও পুষ্টিচক্রে হস্তক্ষেপ থেকে মানুষকে বিরত হতে হবে। স্থলজ ও জলজ বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের কোনোটিকেই বিপন্ন হতে দেওয়া যাবে না। ইতিমধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়েছে এরূপ প্রাণী ও উদ্ভিদ ফিরিয়ে আনা সম্ভব না হলেও, যেগুলি বিপন্ন হয়েছে বা হতে চলেছে সেগুলিকে নিয়ে উপযুক্ত সংরক্ষণ সংক্রান্ত কর্মসূচি গ্রহণ ও রূপায়নে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। পৃথিবী থেকে যেভাবে দ্রুত অরণ্যভূমি নিশ্চিহ্ন হয়ে চলেছে, রাসায়নিক কীটনাশক দূষনে মৃত্তিকার অবক্ষয় ঘটে চলেছে, দূষিত হয়ে চলেছে জলভাগ, ভূপৃষ্ঠ স্থলভাগ তাকে বাঁচাতে বাস্তুতন্ত্রের অভাবনীয় ক্ষতিসাধন হয়ে চলেছে, পরিবেশের আলোচনায় ভৌগলিকগণ এবিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব প্রদানের জোরদার পক্ষপাতী।


৫. পরিবেশ দুর্যোগ ও বিপর্যয় রোধ প্রয়াসী দৃষ্টিভঙ্গি (Environmental hazard and disaster management approach) :

 প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় এবং তার মোকাবিলা নতুন বিষয় নয়, কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়ন, সমুদ্র জলস্তর বৃদ্ধি, ঘনঘন ঘুর্ণিঝড়ের আগমন প্রভৃতি মনুষ্য কর্মজনিত ফলশ্রুতি বলেই ভৌগোলিক ও পরিবেশবিদদের ধারণা। কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের উপর্যুপরি ব্যবহার, শিল্প কারখানার কঠিন ও তরল বর্জ্য, নদীগুলি বেঁধে জলাধার নির্মাণের ফলে জলস্তরের পরিবর্তনে বাস্তু সংস্থানের ক্ষতি, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও সন্ত্রাসবাদের শিকার প্রাকৃতিক ও মানবিক পরিবেশ। বিলুপ্ত হয়েছে বহু প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মানুষের স্বাস্থ্য, রয়েছে পরমাণু বোমার ভ্রুকুটি, উগ্রপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ, রাজনৈতিক উপনিবেশিকতা কমলেও তার স্থান নিয়েছে অর্থনৈতিক ঔপনিবেশিকতা। কখনো কখনো রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, এথনিক ক্লিনজিং প্রভৃতি সামাজিক পরিবেশেও ভয় ও ভীতির সঞ্চার করে। ভৌগোলিক চিন্তাভাবনায় পরিবেশ আলোচনায় এইদিকটিও বর্তমানে জায়গা করে নিয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Middle post ad 01