মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি সংক্রান্ত তত্ত্বসমূহ (Theories regarding the origin of Monsoon)
আবহাওয়া বিদগণের কাছে মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি একটি প্রহেলিকা। এর উৎপত্তি সম্বন্ধে বহু তত্ত্বের অবতারণ হলেও কোনো তত্ত্বই সর্বতোভাবে গ্রহণীয় হয়নি। তবে আধুনিক কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান ও তথ্য মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি সংক্রান্ত জটিল সমস্যা সমাধানে সহায়ক হলেও আবহবিদ্যার বিশেষজ্ঞরা মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি, বিরুদ্ ও তার অনিশ্চিত আচরণ সম্পর্কে সহমত পোষণ করেন না। মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি সংক্রান্ত কিছু প্রচলিত তত্ত্ব নীচে আলোচনা করা হল -
1. প্রথাগত তাপীয় ধারণা (Classical thermal concept) :
ব্রিটিশ জলবায়ুবিদ এডমন্ড হ্যালি (Edmond Halley)* 1686 খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি সংক্রান্ত একটি তত্ত্ব লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি (Royal Society) নামক পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এই তত্ত্বটিকে তাপীয় ধারণা হিসেবে অভিহিত করা হয়।
এই ধারণা অনুযায়ী পৃথিবীতে জলভাগ ও স্থলভাগের অসম বণ্টন এবং আগত সৌর বিকিরণ গ্রহণে—এই দুই ধরনের ভূভাগের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে সৃষ্ট বৈষম্যমূলক উত্তাপ মৌসুমি বায়ু সৃষ্টির জন্য দায়ী। সাধারণত স্থলভাগ দ্রুত উত্তপ্ত ও শীতল হয়, অন্যদিকে জলভাগ ধীরে ধীরে উত্তপ্ত ও শীতল হয়। মধ্যে বায়ুচাপের এক বিরাট তারতম্য লক্ষ করা যায়, যা বায়ুচাপীয় ঢালের পরিবর্তন সূচীত করে। তাই ঋতুভেদে মহাদেশ ও মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্যদিকে জলভাগ ধীরে ধীরে উত্তপ্ত ও শীতল হয়। মধ্যে বায়ুচাপের এক বিরাট তারতম্য লক্ষ করা যায়, যা বায়ুচাপীয় ঢালের পরিবর্তন সূচীত করে।
শীতকালে এশিয়ার বিস্তীর্ণ স্থলভাগ দ্রুত তাপবিকিরণ করে শীতল হয়ে পড়ে। কিন্তু সংলগ্ন বিশাল জলভাগ তত দ্রুত হারে তাপবিকিরণে সক্ষম। না হওয়ায় স্থলভাগের তুলনায় জলভাগ অধিক উষ্ণতার অধিকারী হয়। এর ফলে স্থলভাগে উচ্চচ্চাপ এবং তৎসংলগ্ন সমুদ্রে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয় এবংস্থলভাগ থেকে জলভাগের দিকে বায়ুচাপীয় ঢালের উদ্ভব ঘটে। এই কারণে শীতকালে স্থলভাগ থেকে দক্ষিণের জলভাগের দিকে মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়। স্থলভাগের ওপর দিয়ে আসে বলে এই বায়ু অত্যন্ত শুষ্ক এ শীতল হয়। একেই শীতকালীন মৌসুমি বায়ু বলে।
গ্রীষ্মকালে ঠিক এর বিপরীত অবস্থার সৃষ্টি হয়। স্থলভাগ দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে গভীর নিম্নচাপের অবস্থার সৃষ্টি করে। কিন্তু তৎসংলগ্ন জলভাগ অত্যন্ত ধীরে উত্তপ্ত হয়। উপরন্তু উত্তরায়ণের ফলে আন্তঃক্রান্তীয় সম্মিলন বলয় (ITCZ) এশিয়ার সস্থূলভাগের ওপর অবস্থান করায় নিম্নচাপ আরও শক্তিশালী হয়। ফলে দক্ষিণের জলভাগ থেকে স্থলভাগের দিকে তীব্র বায়ুচাপীয় ঢালের সৃষ্টি হয়। এই ঢাল অনুসারে গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি বায়ুর আগমন ঘটে জলভাগের ওপর দিয়ে আসে বলে গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি বায়ু প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করে আনে এবং ভারত সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়।
সমালোচনা :
অ্যানগেট (Anget), হান (Hann), কোপেন (Koppen), বাভের (Baver), কিয়েল (Kiel), মিলার (Miller), স্ট্রলার (Strailer), বায়ার্স (Byers), ওয়াটস (Watts) প্রমুখ ভৌগোলিক ও আবহবিদগণ হ্যালি প্রদত্ত তাপীয় ধারণাটিকে সমর্থন করলেও বহু আবহবিদ ও ভৌগোলিকগণ তত্ত্বটিকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেন। তাঁদের মতে
(i) মহাদেশের ওপর সৃষ্ট নিম্নচাপ ক্ষেত্র সর্বদা স্থায়ী হয় না। এগুলি হঠাৎ স্থান পরিবর্তন করায় স্থায়ী তাপীয় নিম্নচাপ তৈরি হতে পারে না।
(ii) যদি জলভাগ ও স্থলভাগের বৈষম্যমূলক উত্তাপ প্রক্রিয়ায় মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি হয় তবে ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলে প্রতি-মৌসুমি বায়ু (Anti-monsoon) সংবহন থাকা আবশ্যিক। কিন্তু মৌসুমি বায়ু প্রভাবিত অঞ্চলের ঊর্ধ্ব ট্রপোস্ফিয়ারে এই ধরনের বিপরীতমুখী বায়ুপ্রবাহ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
2. গতিশীল ধারণা বা ফনের মতবাদ (Dynamic Concept of Flohn) :
হ্যালি প্রদত্ত তাপীয় ধারণার সীমাবদ্ধতার কারণে 1951 খ্রিস্টাব্দে জার্মান আবহাওয়া বিভাগের (German Weather Bureau) বিজ্ঞানী এইচ. ফন (H. Flohn) গতিশীল ধারণার উপস্থাপনা করেন। ফনের মতে, সূর্যের উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়নের সঙ্গে সঙ্গে তাপবিষুব রেখা (Heat equator) এবং আন্তঃক্রান্তীয় সম্মিলন বলয় (ITCZ)-এর স্থানান্তরের ফলে বায়ুচাপ ও বায়ুপ্রবাহ বলয়ের ঋতুভিত্তিক স্থানান্তরের কারণে মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি হয়।
ITCZ হল উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ুর সম্মিলন বলয়। এই বলয়টি নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ে অবস্থিত। এই নিম্নচাপ বলয়ের সর্বাপেক্ষা উন্নতম স্থানের সংযোগকারী সরলরেখা হল তাপবিষুব রেখা। সূর্যের উত্তরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে তাপবিষুব রেখাটি নিরক্ষরেখার উত্তরে এবং দক্ষিণায়নের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণে স্থানান্তরিত হয়। তাপবিষুব রোখার এরুপ স্থানান্তরের সঙ্গে সঙ্গে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়টিও স্থানান্তরিত হয়।
উত্তরায়ণের সময় তাপবিষুব রেখাটি নিরক্ষরেখার উত্তরে মোটামুটি 10° অক্ষরেখা বরাবর বিস্তৃত হয়। এর ফলে ITCZও উত্তরে স্থানান্তরিত হয়। অনেক সময় ITCZটি প্রায় 30° অক্ষরেখা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়।
তাই দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু যখন নিরক্ষরেখা অতিক্রম করে উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত ITCZ-এর দিকে ধাবিত হয়। তখন ফেরেলের সূত্রানুযায়ী ডানদিকে বেঁকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে বায়ু প্রবাহিত হয়। এই বায়ুকে নিরক্ষীয় পশ্চিন বায়ু (Equatorial Westerly) বলে। এই নিরক্ষীয় পশ্চিমা বায়ুকেই আবহবীদ ফন দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু রূপে অভিহিত করেছেন। ভারতে প্রবেশ করার পূর্বে এই বায়ু বিস্তীর্ণ সমুদ্রের ওপর দিয়ে আসে বলে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটাতে সক্ষম হয়। শীতকালে দক্ষিণায়নের সঙ্গে সঙ্গে তাপবিষুব রেখাটি দক্ষিণ গোলার্ধে 5°-10° দক্ষিণ অক্ষরেখায় স্থানান্তরিত হয় । ফলে সমগ্র ভারতবর্ষ উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ুর প্রভাবাধীন হয়। স্থলভাগের ওপর দিয়ে আসায় এই বায়ু শুষ্ক ও শীতল প্রকৃতির হয়। এই উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ুকেই ফন উত্তর পূর্ব মৌসুমি বায়ু রূপে অভিহিত করেছেন। অধিক শুষ্ক হওয়ায় এই বায়ুর প্রভাবে শীতকালে তেমন বৃষ্টিপাত হয় না।
সমালোচনা:
ফন প্রদত্ত গতিশীল ধারণাটি বহু আবহবিদদের কাছে সমালোচিত হয়েছে।
(i) অনেকে মনে করেন, ফন প্রদত্ত গতিশীল ধারণাটি অতি সরলীকৃত। মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি ও ঋতুভেদে বিপরীতমুখী প্রবাহের কারণ এতটাও সরল নয়। সম্প্রতি উপগ্রহ চিত্র পর্যবেক্ষণ করে ও বহু গবেষণার মাধ্যমে অনেকেই ফনের ধারণাটি বাতিল করেছেন।
(ii) অনেক আবহবিদ বলেন, যদি তাপবিষুব রেখার স্থানান্তরে ITCZ-এর স্থানান্তরের কারণে উদ্ভুত নিরক্ষীয় পশ্চিমা বায়ু মৌসুমি বায়ুকে সৃষ্টি করে তবে পৃথিবীর সর্বত্র মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ দেখা যায় না কেন? কেবলমাত্র ভারতবর্ষেই এই বায়ুপ্রবাহ সীমাবদ্ধ কেন?
(iii) বায়ুপ্রবাহের দিক পরিবর্তনের প্রধান কারণ কোরিওলিস বল। এটি নিরক্ষরেখার উভয় পার্শ্বে 5° অক্ষরোপ পর সক্রিয় হয়। ভারতের দক্ষিণে কেরালা শুরুই হয় 8°4' উঃ থেকে, তবে এত দ্রুত কীভাবে দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু দিক পরিবর্তন করে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুতে রূপান্তরিত হতে পারে।
3. তেজকির তত্ত্ব (Jeffry's theory) :
ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ ও ভূ-পদার্থবিদ জেফ্রি মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি সংক্রান্ত কোনো তত্ত্ব প্রদান করেননি। তিনি হ্যালি প্রদত্ত তাপীয় ধারণাকে স্বীকৃতি দেন মাত্র। জল ও স্থলের বৈষম্যমূলক উত্তাপ গ্রহণের ফলে মৌসুমি বায়ু সৃষ্টি হয় বলে মেনে নিয়ে এই তত্ত্বটির প্রধান দুর্বলতাটির সমাধান করার চেষ্টা করেন। তিনি গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে জলভাগ থেকে স্থলভাগের দিকে প্রবাহিত হওয়া মৌসুমি বায়ুর ঠিক ওপরের বায়ুস্তরে বিপরীত দিকে স্থলভাগ থেকে জলভাগের দিকে বায়ুপ্রবাহের অস্তিত্বকে প্রমাণ করেন।
জেফ্রি গাণিতিক প্রমাণের সাহায্যে দেখিয়েছেন বায়ুমণ্ডলে 2.1 কিমি ওপরে বায়ু ভূপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে প্রবাহিত সামুর বিপরীতমুখে প্রবাহিত হয়। তিনি বলেন যে, ট্রপোস্ফিয়ারে উচ্চতা অনুযায়ী বায়ুর চাপ হ্রাস পাওয়ায় বায়ুমণ্ডলের নিম্নস্তর দিয়ে যদি পশ্চিম দিক থেকে বায়ু প্রবাহিত হয় তাহলে 3 থেকে 6 কিমি ঊর্ধ্বে তা পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত হবে। মৌসুমি বায়ুর ক্ষেত্রেও এই ঘটনাটি ঘটে।
সমালোচনা :
জেফ্রির গাণিতিক বিশ্লেষণকে গ্রহণ করলে দুটি সমস্যা দেখা যায়
(i) নিম্ন অক্ষাংশে যেখানে মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি হয় সেখানে জিওস্ট্রফিক ভারসাম্যের (Geostrophic balance) অভাব পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু জেফ্রির মডেল মেনে নিলে জিওস্ট্রফিক ভারসাম্যকে অগ্রাহ্য করাতে হয়।
(ii) জেফ্রির মতবাদকে অনুসরণ করলে জল ও স্থলভাগের বৈষম্যমূলক উত্তাপের কারণেই মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি হয় তা মেনে নিতে হয়। কিন্তু মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি এতটা সরল নয়।
4. র্যাডন কেন্দ্রীভবন তত্ত্ব (Theory of Radon Concentration) :
60-এর দশকে মৌসুমি বায়ু উৎপত্তি প্রসঙ্গে একটি নতুন ধারণার উদ্ভাবন ঘটে। এই ধারণা অনুযায়ী মনে করা হয় ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম জাতীয় তেজস্ক্রিয় অণুর (radioactive nuclei) বিকিরণের প্রভাবে মৌসুমি বায়ুর উদ্ভব ঘটে। এই তেজস্ক্রিয় অণুগুলি ক্ষয়স্থায়ী। এগুলিকে ব্র্যাডন বলে। এই তত্ত্বে বলা হয় বায়ুস্তরে উচ্চ রাডনের মাত্রা মৌসুমি বায়ুর স্থলভাগে উৎপত্তিকে নির্দেশ করে।
1960-এর দশকে ওয়াই. এম. শোকালস্কি (Y. M. Shokalski) নামক সোভিয়েত জাহাজ থেকে 1960 সালের জুলাই মাসে অনেকগুলি সমীক্ষা চালিয়ে ও বিভিন্ন গবেষণা দ্বারা মনে করা হয়েছে যে মহাদেশীয় স্থলভাগই র্যাডনের (ধোরিয়াম) প্রধান উৎস। জলভাগ অপেক্ষা স্থলভাগে প্রায় দ্বিগুণ ব্র্যাডন উৎপন্ন হয়। এই সমীক্ষায় লক্ষ করা যায় যে স্থলভাগের নিকটবর্তীতার কারণে লোহিত সাগরে উচ্চ র্যাডনের মাত্রা লক্ষ করা যায়। পরবর্তীকালে উপগ্রহ চিত্রের মাধ্যমে রাডনের পরিমাণ দেখে একদল গবেষক সিদ্ধান্তে আসেন ঋতুভেদে ব্র্যাডনের মাত্রার তারতম্যের জন্য আরব ও মধ্যপ্রাচ্যই মৌসুমি বায়ুর সম্ভাব্য উৎপত্তিস্থল।
• সমালোচনা :
(i) র্যাডন তত্ত্ব অনুযায়ী মৌসুমি বায়ু যদি স্থলভাগ থেকেই উৎপন্ন হয় তবে এই বায়ুতে এতটা পরিমাণ জলীয় বাষ্পের আগমন কীভাবে হল? কারণ আরব সাগরে এত দ্রুত প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করা সম্ভবক রা সম্ভব নয়।