এল নিনো এবং দক্ষিণী দোলনের সঙ্গে মৌসুমি বায়ুর সম্পর্ক (Relation of El-Nino and Southern Oscillation with Monsoon) :
এল নিনো (El Nino) :
নামকরণ :
পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে জলবায়ুগত বিপর্যয়ের মধ্যে অন্যতম ভয়ঙ্কর বিপর্যয় হল এল নিনো-র আবির্ভাব।'EL-Nino' একটি স্পেনীয় শব্দ, যার অর্থ শিশু খ্রিস্ট (child christ)। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে ওয়াকার সঞ্চালনের নিষ্ক্রিয় অবস্থায় ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে পেরু উপকূলে একটি উয় সমুদ্রস্রোতের আবির্ভাব হওয়ায় এরূপ নামকরণ করা হয়েছে।
উদ্ভাবক:
আজ থেকে প্রায় 10,000 বছর আগে এল নিনো বিপর্যয়ের প্রথম প্রমাণ মেলে। পেরুর সুপ্রাচীন ইনকা সভ্যতায় এল নিনোর উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে 1892 খ্রিস্টাব্দে ক্যাপটেন ক্যামিলো ক্যারিল্লো (Camilo Carrillo) পেরুর লিমায় অনুষ্ঠিত জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি কংগ্রেসে (Geographical Society Congress) প্রথম এল নিনো শব্দটি ব্যবহার করেন।
সংজ্ঞা:
এল নিনো একপ্রকার উয় সামুদ্রিক স্রোত। কোনো কোনো বছর ডিসেম্বর মাসে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম পেরু ও ইকুয়েডর উপকূল বরাবর উত্তরমুখী শীতল হামবোল্ড স্রোতের পরিবর্তে দক্ষিণমুখী উয় সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হয়। এই উয় স্রোতকেই এল নিনো বলে।
উৎপত্তি:
সাধারণত প্রতি 3-5 বছরে একবার এল নিনোর আবির্ভাব ঘটে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহবিদ জেকব বার্কনেস (Jacob Bjerkness) সর্বপ্রথম এল নিনো নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। পরবর্তীকালে অ্যাডাম (Adam), ম্যান (Mann), প্লাইমার (Plimar) প্রমুখ বিজ্ঞানীর গবেষণা থেকে এল নিনোর উৎপত্তি নিয়ে নানা রকমের ধারণা পাওয়া যায়। তবে সর্বাধিক যুক্তিসংগত তত্ত্বটি হল প্রশান্ত মহাসাগরে উয় জলরাশির স্থানান্তরকরণ প্রক্রিয়া।
বায়ুমণ্ডলে যেমন দ্রাঘিমারেখা বরাবর সঞ্চলন চক্র দেখা যায় তেমনি নিরক্ষরেখা বরাবরও সঞ্চলন চক্র লক্ষ করা যায়। একে ওয়াকার সঞ্চলন চক্র (Walker circulation) বলে।
এই ওয়াকার চক্রের স্বাভাবিক অবস্থায় নিরক্ষীয় অঞ্চল বরাবর সমুদ্রপৃষ্ঠের জলের উয়তা প্রায় 27° সেঃ থেকে 30° সেঃ পর্যন্ত হয়ে থাকে। প্রায় 100 মিটার গভীরতায় জলস্তরের ওপরের উয় জল (30° সেঃ) ও নীচে শীতল জলপুঞ্জের (20° সেঃ) মধ্যে একটি বিভেদতল লক্ষ করা যায়। এই তলটিকে থার্মোক্লাইন (thermocline) বলা হয়।
ওয়াকার চক্রের স্বাভাবিক অবস্থায়, নিরক্ষরেখা বরাবর প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলে হামবোল্ড স্রোতের শীতল জলরাশি দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু দ্বারা পশ্চিম দিকে সঞ্চালিত হয়। সমুদ্রের জল ক্রমশ পশ্চিম দিকে সরে যাওয়ায় সমুদ্রের নীচ থেকে শীতল জল, ওপরে উঠে আসে। পূর্ব উপকূলে এই ভারী ও শীতল জল আগত সূর্যরশ্মির দ্বারা খুব একটা উত্তপ্ত হতে পারে না। অর্থাৎ, জলের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উয়তা কম থাকে। কিন্তু এই জল বায়ুতাড়িত হয়ে যতই পশ্চিম দিকে যেতে থাকে ক্রমাগত সূর্যরশ্মি গ্রহণ করে তা ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হতে থাকে।
এভাবে দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোতের মাধ্যমে ক্রমাগত বিরামহীন উয় জলের সঞ্চয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম উপকূলে এক বিশাল অঞ্চল জুড়ে উয় জলক্ষেত্র (pool of warm water) সৃষ্টি হয়। জলরাশির ক্রমাগত পুঞ্জীভবনের ফলে পশ্চিম উপকূলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা পূর্ব উপকূল অপেক্ষা 1 মিটার বা তার বেশি হয়ে পড়ে। ঠিক এই অবস্থায় ওই অংশে (পশ্চিম উপকূল) থার্মোক্রাইনের গভীরতা যেখানে 200 মিটার হয় সেখানে পূর্ব উপকূলে প্রায় সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি অবস্থান করে। তাই হামবোল্ড স্রোতের শীতল জল সহজেই ওই পাতলা উয় জলের আবরণকে সরিয়ে ওপরে উঠে আসে।
এই অবস্থায় জলের সমোচ্চশীলতা ধর্মের জন্য প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম উপকূলের উয় জলরাশি কর্নওয়েল স্রোত (Cornwell cur- rent) অথবা নিরক্ষীয় প্রতিস্রোত রূপে পশ্চিম থেকে পূর্বে প্রবাহিত হতে থাকে। এই প্রক্রিয়া ততক্ষণ চলতে থাকে যতক্ষণ না সমুদ্রপৃষ্ঠের জলতলের উচ্চতা সমান হয়। পূর্ব উপকূলে উয় জলের আগমনে থার্মোক্লাইনের গভীরতা বৃদ্ধি পেলে হামবোল্ড স্রোতের শীতল জলরাশি উয় জলরাশির আবরণকে ঠেলে ওপরে উঠে আসতে পারে না (চিত্র: 14.8b)। এর ফলে পূর্ব উপকূলে জলের উয়তা বৃদ্ধি পেলে দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে বাধা পেয়ে উয় জলরাশি দক্ষিণমুখী হয় এবং হামবোল্ড স্রোতকে প্রতিস্থাপিত করে উপকূল, বরাবর প্রবাহিত হয়। এই উয় স্রোতকেই এল নিনো বলে।
উক্ত মতবাদটি সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য হলেও এল নিনোর উৎপত্তি প্রসঙ্গে আরও কিছু মতবাদ প্রচলিত রয়েছে, তবে এগুলির যথার্থতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এগুলি হল-
1. একদল ভূবিজ্ঞানী ও আবহবিদের মতে, পেরু-চিলি উপকূল বরাবর নাজকা পাতটি দক্ষিণ আমেরিকা পাতের নীচে প্রবেশ করায় অবরোধী চাপের প্রভাবে পাতসীমান্তে ফাটল সৃষ্টি হলে অনেকসময় লাভা বেরিয়ে আসে। এই উষু লাভার সংস্পর্শে এসে সমুদ্র জল উত্তপ্ত হয়ে উয় সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি করে। এই উয়স্রোেতই এল নিনো।
2. বিজ্ঞানী অ্যাডাম (Adam) এবং ম্যান (Mann) পুরাজলবায়ুগত তথ্যের (Paleoclimatological data) সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে আসেন যে, প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল বরাবর অবস্থিত আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্নুৎপাতের ফলে লাভা সমুদ্রজলে মিশে জলের উষ্ণতা বৃদ্ধি করে। এর ফলেই এল নিনোর সৃষ্টি হয়। 3. জেকব বার্কনেসের মতে, প্রশান্ত মহাসাগরে তৈরি হওয়া তপ্ত বিন্দু (Hot spot) প্রশান্ত
মহাসাগরের পূর্ব ও পশ্চিম অংশে উন্নতার পার্থক্য ঘটায়। ফলে ওয়াকার চক্র ও আয়ন বায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে এবং উয় জলরাশি পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়। এর ফলে পূর্ব দিকে ক্রমশ উয় জলের বৃদ্ধি ঘটলে এল নিনোর সৃষ্টি হয় বলে মনে করা হয়।
4. অস্ট্রেলিয়ার ভূতত্ত্ববিদ ইয়ান প্লাইমার (Ian Plimar) তাঁর গবেষণায় উল্লেখ করেন যে, সামুদ্রিক শৈলশিরা অঞ্চলে ভূমিকম্প এবং অগ্নুৎপাতের ঘটনা ঘটলে সমুদ্রের জলের উন্নতা বৃদ্ধি পায় যা এল নিনো সৃষ্টির জন্য দায়ী।
তবে এসব মতবাদগুলির কোনো বাস্তবিক ভিত্তি নেই। কারণ পাত সঞ্চালন, অগ্ন্যুৎপাত, তপ্ত বিন্দুর উপস্থিতি- এগুলি সারাবছরই সমুদ্রের জলরাশিকে প্রভাবিত করে। এগুলি যদি সত্যিই প্রভাব ফেলত তাহলে বছরের যে-কোনো সময়ই এল নিনোর উৎপত্তি ঘটত। প্রকৃতপক্ষে প্রশান্ত মহাসাগরে উয় জলরাশির আদানপ্রদানেই এল নিনো নির্দিষ্ট কয়েক বছর অন্তর নির্দিষ্ট সময়ে আসে।
দক্ষিণী-দোলন এবং ENSO (Southern Oscillation and ENSO):
চক্রের স্বাভাবিক অবস্থায় দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোতের মাধ্যমে বাহিত উয় সমুদ্রজলের প্রভাবে প্রশান্ত মহা- সাগরের পশ্চিম উপকূল অধিকতর উয় হওয়ায় এখানে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে পেরু-চিলি উপকূল দিয়ে শীতল হামবোল্ড স্রোত উত্তর- মুখে প্রবাহিত হওয়ায় নিরক্ষরেখা সংলগ্ন পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল অধিক শীতল হয়ে পড়ে। তাই এখানে উচ্চচাপ সৃষ্টি হয়। এর ফলে ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন ওয়াকার সঞ্চালন চক্রের বায়ু পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হয় এবং দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ুও উত্তর-পূর্ব অস্ট্রেলিয়া সংলগ্ন প্রশান্ত মহাসাগরে ঘনীভূত নিম্নচাপের প্রভাবে সক্রিয় থাকে (চিত্র: 14.9a)। কিন্তু জলের সমোচ্চশীলতা ধর্ম রক্ষার জন্য কর্নওয়েল স্রোতরূপে উদ্বু জলপুঞ্জ পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর থেকে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে চলে এলে এল নিনো নামক উয় স্রোতের সৃষ্টি হয় যা দক্ষিণমুখী হয়ে হামবোল্ড স্রোতকে প্রতিস্থাপিত করে। এর ফলে পূর্ব প্রশান্ত মহাসগরে থার্মোক্লাইনের গভীরতা বাড়তে থাকায় পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর অপেক্ষা অধিক উন্ন হয়ে পড়ে। এর ফলে বায়ুচাপ কক্ষের আকস্মিক স্থান পরিবর্তন ঘটে। প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলে তখন নিম্নচাপ কক্ষ ও পশ্চিম উপকূলে উচ্চচাপ কক্ষ তৈরি হয়। এর ফলে ওয়াকার সঞ্চালন কোশ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে এবং দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ুও সক্রিয়তা হারায় (চিত্র: 14.9b)। এভাবে এল নিনোর
উৎপত্তিতে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে বায়ুচাপ কক্ষের আকস্মিক স্থান পরিবর্তনকেই গিলবার্ট ওয়াকার (Gilbert Walker) দক্ষিণী-দোলন (Southern Oscillation) বলে অভিহিত করেছেন। এল নিনোর প্রভাবে এই দক্ষিণী-দোলন ঘটার জন্য একে ENSO (El Nino Southern Oscillation) বলে।