welcome to mygeo.in Indian no 1 geography based website in Bengali

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া কয়েকটি সুপার সাইক্লোন ও তাদের প্রভাব (Major Super Cyclones of Bay of Bengal and their effects)

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া কয়েকটি সুপার সাইক্লোন ও তাদের প্রভাব (Major Super Cyclones of Bay of Bengal and their effects) :

প্রায় প্রতি বছর ভারতের বঙ্গোপসাগরীয় উপকূলে গ্রীষ্মের শুরুতে অর্থাৎ প্রাক্-মৌসুমি ঋতুতে (Pre-mon- soon) এবং বর্ষার শেষে বা শরৎ-এর শুরুতে অর্থাৎ মৌসুমি-পরবর্তী (Post-monsoon) ঋতুতে সুপার সাইক্লোন সৃষ্টি হতে দেখা যায়। নীচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সুপার সাইক্লোন ও তার প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হল।



1. ওড়িশা সুপার সাইক্লোন (1999) :


1999 সালের 29 অক্টোবর সকাল ৪টা থেকে 11টার মধ্যে ভারতের ওড়িশা উপকূলে তৎকালীন সবচেয়ে - ভয়ঙ্করতম সুপার সাইক্লোনটি আঘাত হেনেছিল। সাইক্লোনটির কেন্দ্রবিন্দু ছিল পারাদ্বীপ, জগৎসিংহপুর ও কেন্দ্রপাড়ার ওপর। কেন্দ্রে বায়ুর চাপ ছিল 912 mb (মিলিবার)। ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় 260 কিমির বেশি। ঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে মুহূর্তের মধ্যে পারাদ্বীপ, বালেশ্বর ও জগৎসিংহপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়। এই ঝড়ের সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি ও তীব্র বায়ুপ্রবাহের ফলে উক্ত অঞ্চলগুলিসহ কটক, ভুবনেশ্বর, পুরী এবং প্রায় সমগ্র ওড়িশা রাজ্যের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এই সুপার সাইক্লোনটি 25 অক্টোবর বঙ্গোপসাগরের ওপর সৃষ্টি হয়, 29 অক্টোবর স্থলভাগে প্রবেশ করে এবং 1 নভেম্বর বিলুপ্ত হয়। সাইক্লোনের প্রভাব এতটাই বেড়ে যায় যে ভারত সরকার একে জাতীয় বিপর্যয় হিসেবে ঘোষণা করে। 

 ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ :


• সরকারি হিসাব অনুযায়ী এই সুপার সাইক্লোনের প্রভাবে প্রায় 10,000-এর বেশি মানুষের মৃত্যু হয় এবং 20 মিলিয়ন মানুষ গৃহচ্যুত হয়।

• প্রায় 7 লক্ষ গবাদি পশু ও অন্যান্য প্রাণীর মৃত্যু হয়।

• 90 মিলিয়ন গাছ মাটি থেকে উপড়ে যায়, প্রায় 12 মিলিয়ন হেক্টর জমির ফসল ও মাছ নষ্ট হয়।

• বিস্তীর্ণ অঞ্চল বন্যা প্লাবিত হয়ে জমির উর্বরতা নষ্ট করে এবং খাদ্য ও পানীয় জলের অভাব ঘটে।

• সমগ্র দেশের সঙ্গে সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

• জগৎসিংহপুর জেলার মহাকালপদা ব্লক এবং
পারাদ্বীপের অসংখ্য চিংড়ি খামারের কর্মী এবং সন্নিহিত গ্রামের অসংখ্য ধীবর পরিবার ও তাদের গবাদি পশু সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ জলবন্দি হয়ে পড়ে।

• বিপর্যয়ে মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করা হয় 1.5 বিলিয়ন ইউরো।




2. আয়লা (Aila), 2009:


2009 সালের 27 মে ভারতের পূর্ব উপকূলে আছড়ে পড়ে আয়লা (Aila)। এটা ছিল অতীব ভয়ঙ্কর একটি সামুদ্রিক ঝড়। এই ঝড়ের গতিবেগ ছিল 110-120 কিমি/ঘঃ এবং সর্বোচ্চ ছিল 120 কিমি/ঘঃ। ঝড়ের কেন্দ্রে বায়ুচাপ ছিল 968 (mb) মিলিবার। এই বিধ্বংসী সামুদ্রিক ঝড়টি মূলত ভারত ও বাংলাদেশে আঘাত হানে। এর প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ 24 পরগনা জেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে সাগরদ্বীপ ও সংলগ্ন সুন্দরবন অঞ্চলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি। 21 মে কলকাতা থেকে 950 কিমি দূরে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে আয়লার উৎপত্তি হয়েছিল। এটি ক্রমশ উত্তরমুখী হয়ে শক্তিবৃদ্ধি করে 27 মে পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশের উপকূলে আছড়ে পড়ে।

ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ


• সরকারি হিসাব অনুযায়ী আয়লার প্রভাবে 149 জনের মৃত্যু ঘটে।

• ৪টি গ্রামের অন্তত 15,000-এর অধিক মানুষ সাইক্লোন সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যার প্রভাবে বাস্তুহারা হয়ে পড়ে।

• 177 কিমি সমুদ্র ও নদীবাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙে যায়।

• 601 কিমি বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

• এর প্রভাবে সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

• আয়লার প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান, উত্তর ও দক্ষিণ 24 পরগনা এবং কলকাতায় জনজীবন দুর্যোগের সম্মুখীন হয়।





3. লায়লা (Laila), 2010:


2010 সালের 20 মে দুপুরবেলায় অন্ধ্রপ্রদেশ উপকূলে মছলিপত্তনমের নিকট যে বিধ্বংসী সুপার সাইক্লোনটি আছড়ে পড়ে, তার নাম লায়লা। এই সুপার সাইক্লোনটির কেন্দ্রে বায়ুর চাপ হয় 986 mb (মিলিবার) এবং ঝড়ের গতিবেগ ছিল প্রতি ঘণ্টায় 100-120 কিমি। এই ঝড়ের প্রভাবে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ ও তামিলনাড়ু উপকূল এবং শ্রীলঙ্কা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 17 মে ঘূর্ণিঝড়টি বঙ্গোপসাগরের ওপর উৎপত্তি লাভ করে এবং 24 মে লায়লার অন্তর্ধান ঘটে।

ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ :


• এই ঝড়ের প্রভাবে অন্ধ্রপ্রদেশ ও তামিলনাড়ুতে যথাক্রমে 36 ও 9 জন মানুষের মৃত্যু ঘটে।

• চেন্নাই এবং তার প্রান্তবর্তী এলাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

100টি ট্রলার ও বহুমৎস্যজীবী এই ঝড়ের প্রভাবে সমুদ্রে হারিয়ে যায়।

অন্ধ্রপ্রদেশের কৃষ্ণা, গুন্টুর, বিশাখাপত্তনম ও প্রকাশম জেলা সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং 170-টির বেশি বাড়ি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।






4. থানে (Thane), 2011:


2011 সালের 30 ডিসেম্বর সকাল 6:30-এ পুডুচেরী ও কুড্ডালোরের মাঝে তামিলননাড়ু উপকূলে ঘূর্ণিঝড় থানে প্রথম আঘাত আনে। এরপর তামিলনাড়ু ও অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূলে ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় থানে ভয়ঙ্করভাবে ভেঙে পড়ে। এটি সম্পূর্ণ মৌসুমি বায়ুর পথ ধরে ভারতীয় উপকূলের দিকে এগিয়ে আসে। তামিলনাডুর কুড্ডালোর (Cuddalore), এবং পুডুচেরীতে (Pu- ducherry) সবচেয়ে বেশিমাত্রায় আঘাত হানে। এই ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ 120 কিমি থেকে 140 কিমি প্রতি ঘণ্টা এবং কেন্দ্রে বায়ুচাপ 969 (mb) মিলিবার। এই ঝড় 25 ঘটে এবং 26 ডিসেম্বর সকালে গভীর নিম্নচাপে এগোতে থাকে। অবশেষে 30 ডিসেম্বর ভূপৃষ্ঠে আছড়ে পড়ে ও 31 ডিসেম্বর তা বিলীন হয়ে যায়।

ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ :


• এই ঝড়ের প্রভাবে পুদুচেরীতে 7 জন এবং তামিলনাড়ুর কোড্ডালোর জেলায় 39 জনের মৃত্যু ঘটে। এই দুটি অঞ্চলই ঝড়ে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

তামিলনাড়ুর চেন্নাই, কাঞ্চিপুরাম, তিরুভালুরে বহু মৎস্যজীবী পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে।

• অন্ধ্রপ্রদেশের প্রায় 700 মৎস্যজীবী এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

• এর প্রভাবে দুটি রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশ ও তামিলনাড়ুর উপকূলভাগের জেলাগুলিতে বন্যার প্রাদুর্ভাব ঘটে এবং খাদ্য ও পানীয় জলের অভাব ঘটে।






5. নিলম (Nilam), 2012: 

2012 সালের 31 অক্টোবর বিকেল চটা নাগাদ দক্ষিণ চেন্নাই-এর মহাবলীপুরমের কাছে নিলম তামিলনাডু উপকূলে আছড়ে পড়ে। 28 অক্টোবর সকাল 11:30 নাগাদ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ থেকে নিলমের সৃষ্টি। নিলম 2010-এর জল নামক আরেকটি ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়টিরই অনুরূপ। দক্ষিণ ভারতে এর প্রভাব বেশি। এই ঝড়টির গতিবেগ 85 কিমি-100 কিমি/ঘঃ এবং এর নিম্নচাপ কেন্দ্রে বায়ুচাপ ছিল 990 (mb) মিলিবার। এই ঘূর্ণিবাতটি প্রধানত মহাবালপুরমে ভেঙে পড়ে এবং সমুদ্র সৈকতের বালুকারাশিকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। ওই সময় চেন্নাই মেরিনা বীচ-এ জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল প্রায় 100 মি (330 ফুট)। এই ঝড় 28 অক্টোবর উৎপত্তি লাভ করে এবং 31 অক্টোবর উপকূলে আছড়ে পড়ে ও 1 নভেম্বর এর বিলুপ্তি ঘটে। এর জন্য চেন্নাই শহরের স্কুল-কলেজ তিনদিনের জন্য বন্ধ রাখা হয়।


ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ :


• এই ঝড়ে তামিলনাড়ু ও অন্ধ্রপ্রদেশে যথাক্রমে 21 ও 44 জন মানুষের মৃত্যু ঘটে।

• ঝড়ের সময় 1,50,000 মানুষকে নেল্লোর জেলায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

• নিলম-এর বিলুপ্তির পর অন্ধ্রপ্রদেশের দক্ষিণাংশে প্রচণ্ড পরিমাণে বৃষ্টিপাতের ফলে বন্যা হয়।

• অন্ধ্রপ্রদেশের প্রায় 76,980 হেক্টর ফসলি জমি ও বেশির ভাগ ধানখেত নষ্ট হয়।






6. পিলিন (Phailin), 2013 : 

2013 সালের 12 অক্টোবর ওড়িশার গোপালপুরের উপকূলে ফিলিন প্রথম বিধ্বংসী রূপ নিয়ে আছড়ে পড়ে। এই প্রবল ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়টি প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরের ঘূর্ণবাতের অংশবিশেষ, যা ভারত, মায়ানমার ও থাইল্যান্ডকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। এই ঘূর্ণিঝড়টির সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় 215 কিমি। এর কেন্দ্রে বায়ুর চাপ ছিল 940 mb (মিলিবার)। এই ঘূর্ণিঝড়টিকে প্রথম ক্যাটাগরির হারিকেন (Cat- egory 1 hurricane)-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এই ঝড় 5 অক্টোবর সমুদ্রবক্ষে সৃষ্টি হয়, 11 অক্টোবর স্থলভাগে প্রবেশ করে, 14 অক্টোবর বিলুপ্ত হয়ে যায়। ভারতের ওড়িশা উপকূল ছাড়াও অন্ধ্রপ্রদেশ, আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জেও পিলিন তার বিশেষ প্রভাব ফেলে।

ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ :


• ওড়িশার বালেশ্বর, ভদ্রক, ময়ূরভঞ্জ, কেওনঝড়, ঢেনকানাল, জায়জপুর, কটক, জগৎসিংহপুর, কেন্দ্রাপাড়া, পুরী, খুড়দা, নায়াগড়, গঞ্জাম, গঞ্জপাতি প্রভৃতি জেলায় প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়।
• আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের মায়াবুন্দার এবং লং দ্বীপে ৪ থেকে 10 অক্টোবর অর্থাৎ দুদিনে যথাক্রমে 734 এবং 434 মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় এবং বহু ঘরবাড়ি ও সম্পত্তি নষ্ট হয়।

• ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার জন্য শুধুমাত্র অন্ধ্রপ্রদেশ এবং ওড়িশায় 4,40,000 মানুষকে অন্যত্র সরানো হয়।

• ওড়িশা উপকূলে 18 জন মৎস্যজীবী নিখোঁজ হয়ে যায়।

• অন্ধ্রপ্রদেশের প্রায় 25টি গ্রাম ঝড়ের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

• ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়।

• ওড়িশার পারাদ্বীপ ও গোপালপুরের বন্দরগুলি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

• প্রচুর গাছ ও ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ে, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

• বিভিন্ন দূরপাল্লার ট্রেন চলাচল বাতিল করা হয়।

• সর্বোপরি আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়








7. হুদহুদ (Hudhud), 2014 :


2014 সালের 12 অক্টোবর ঘটে যাওয়া ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় হুদহুদ বিধ্বংসী রূপ নিয়ে ভারতের পূর্ব উপকূলে আছড়ে পড়ে। এর গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় 185-215 কিমি ও এর কেন্দ্রে বায়ুর চাপ ছিল 950 মিলিবার। 6 অক্টোবর বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ কেন্দ্রটির সৃষ্টি হয় এবং তা ক্রমাগত শক্তিবৃদ্ধি করতে করতে (অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশের কিছু অংশ) স্থলভাগের দিকে এগিয়ে যায়। 12 অক্টোবর প্রবল রূপ ধারণ করে উপকূলীয় অংশে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়, 14 অক্টোবর এই প্রবল ঘূর্ণিঝড়টি ধ্বংস হয়ে যায়। এর প্রভাবে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ।

ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ :


• আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এমনকি ভূমিধসও দেখা দেয়।

• ঝড়ের প্রভাবে ও বন্যার কারণে অন্ধ্রপ্রদেশের ধান, আখ, চিনাবাদাম, দানাশস্য প্রভৃতি ফসল নষ্ট হয়ে যায়।

• দুর্যোগ কবলিত এলাকা থেকে 7,00,000 জন মানুষকে উদ্ধার করা হয়।

• এই ঝড়ের প্রভাবে ভারতে 81 জনের মৃত্যু হয় এবং বহু মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে।

• ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত অঞ্চলগুলি রেল ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

• এই ঝড়ের প্রভাবে দক্ষিণমধ্য রেলপথে 62টি ট্রেন বাতিল করা হয় ও 15টির পথ পরিবর্তন করা হয়।







৪. ফনী (Fani), 2019:


2019 সালের 3মে সকাল ৪টা 50 মিনিটে ঘণ্টায় 195 কিমি গতিবেগে বিধ্বংসী রূপে ফনী ওড়িশার পুরী উপকূলে আছড়ে পড়ে। 1999-এর সুপার সাইক্লোনের পর ওড়িশায় ঘটা এটি দ্বিতীয় বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়। ফনী ওড়িশা উপকূল হয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে 4 মে রাত 12:30 নাগাদ পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে। ফনীর উৎপত্তি হয় 26 এপ্রিল 2019 সালে সুমাত্রা দ্বীপের পশ্চিমে। এটি ক্রমশ উত্তরমুখী হয়ে 27 তারিখ মধ্যরাতে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়। ফনীর বায়ুর সর্বাধিক গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় 215 কিমি এবং ঘূর্ণবাতের চক্ষুতে সর্বনিম্ন বায়ুচাপ ছিল 932 মিলিবার। 6 মে বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর ফনী বিলুপ্ত হয়।

ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ:


• ফনীর তাণ্ডবে অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ওড়িশা। ফনীর প্রভাবে সারা ভারতে 72 জনের মৃত্যু হয়।

• ওড়িশায় ফনীর প্রভাবে অন্তত 64 জনের মৃত্যু ঘটে। ফনীর প্রভাবে ওড়িশায় 120 বিলিয়ন মূল্যের সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়। ওড়িশায় ফনীর তাণ্ডবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পুরী, গোপালপুর, ভুবনেশ্বর, কটক, বালাসোর, খুরদা, চাদিপুর এলাকা।

• অন্ধ্রপ্রদেশে শ্রীকুলাম জেলা ফনীর প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ফনীতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল 586-2 মিলিয়ন টাকা।

• পশ্চিমবঙ্গ ফনীর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য। দক্ষিণবঙ্গে পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূল সংলগ্ন দীঘা-শঙ্করপুর এলাকা, মন্দারমণি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায় ফনীর প্রভাবে তীব্র ঝোড়ো হওয়া ও প্রবল বৃষ্টিপাত হয়।

• ফনীর প্রভাবে বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে পুরীর জগন্নাথ মন্দির সহ পুরী ও গোপালপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা।

• ফনীর হাত থেকে রক্ষার্থে ওড়িশা সরকার 11 লক্ষ মানুষকে সরিয়ে এনে সাইক্লোন সেন্টারে আশ্রয় দিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে তাজপুর, শঙ্করপুর, দীঘা সহ পূর্ব মেদিনীপুরের বিভিন্ন উপকূলবর্তী নীচু এলাকা থেকে গ্রামবাসীদের রিলিফ সেন্টারে সরিয়ে আনা হয়েছিল। এছাড়া নামখানা, বকখালি, সন্দেশখালি থেকেও লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরানো হয়েছিল।

• ফনীর তাণ্ডবে দক্ষিণ-পূর্ব ও ইস্টকোস্ট রেল শাখায় মোট 147টি ট্রেন বাতিল করা হয়েছে এবং ভূবনেশ্বর ও কলিকাতা বিমানবন্দরে 3 ও 4 মে সমস্ত বিমান পরিষেবা বাতিল করা হয়েছে।

• ফনীর প্রভাবে উড়িশা উপকূলে ও পশ্চিমবঙ্গের শঙ্করপুরে সমুদ্রের জল উপচে গিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে ঢুকে পড়ে ব্যাপক প্লাবনের সৃষ্টি করেছে।

• ঝড়ের তাণ্ডবে বহু এলাকায় গাছ উপড়ে গেছে এবং ঘরবাড়ি ভেঙেছে।

• পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, দুই 24 পরগনা, হাওড়া, হুগলী, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম প্রভৃতি জেলায় ফনীর প্রভাবে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাত হয়।




 বুলবুল (Bulbul), 2019:


2019 সালের 9 নভেম্বর সন্ধে 6টা 30 মিনিট নাগাদ ঘণ্টায় 120 কিমি গতিবেগে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ 24 পরগনা জেলার সুন্দরবন সংলগ্ন ফ্রেজার গঞ্জ ও বকখালিতে অতি ভয়ঙ্কর ঘূর্ণবাত বুলবুল স্থলভাগে আছড়ে পড়ে। যদিও আছড়ে পড়ার আগে বুলবুল কিছুটা শক্তি ক্ষয় করে, তথাপি এর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ব্যাপক। এরপর বুলবুল উত্তর-পূর্বে অগ্রসর হয়ে সুন্দরবনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করার পর বাংলাদেশে খেপুপাড়ায় প্রবেশ করে। 28 অক্টোবর দক্ষিণ থাইল্যান্ডের সন্নিকটে বুলবুলের উৎপত্তি হয়। এরপর এটি ক্রমশ ভারত মহাসাগর


ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ :


• বুলবুলের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দক্ষিণবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জ, দুই সন্দেশখালি ব্লক, হাসনাবাদ ও বসিরহাট 1 ব্লক; দক্ষিণ 24 পরগনার বারুইপুর, ঝড়খালি, বকখালি,
সাগরদ্বীপ, পাথরপ্রতিমা সহ গোটা সুন্দরবন এলাকা; পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি, রামনগর, খেজুরী, নন্দীগ্রাম এলাকা।

• সরকারি ও বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী বুলবুলে মৃতের সংখ্যা ছিল মোট 11 জন। এর মধ্যে উত্তর 24 পরগনায় 5 জন, দক্ষিণ 24 পরগনায় 2, পূর্ব মেদিনীপুরে 3 এবং কলকাতায় 1 জন রয়েছে।

• বুলবুলের প্রভাবে মোট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে 4-65 লক্ষ মানুষ। এর মধ্যে 1.78 লক্ষ মানুষ প্রায় 471টি ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নেয়। বুলবুলে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির সংখ্যা প্রায় 60 হাজার।

• বুলবুলের প্রভাবে দুই 24 পরগনা, কলকাতা, পূর্ব মেদিনীপুরে ভারী ও হাওড়া, হুগলী ও নদীয়া জেলায় মাঝারি থেকে হাল্কা বৃষ্টিপাত হয়েছে।

• বুলবুলের প্রভাবে দক্ষিণ 24 পরগনার উপকূলবর্তী কৃষিজমি জলমগ্ন হয়ে চাষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

• ঝড়ের প্রভাবে শিয়ালদহের দক্ষিণ শাখায় সমস্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া হাওড়ার দক্ষিণ পূর্ব শাখারও কিছু ট্রেন বাতিল করা হয়।






10. উমপুন (Amphan), 2020:


2020 সালের 20 মে দুপুর 2:30 নাগাদ উমপুন পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ 24 পরগনা জেলার বকখালি ও সাগরদ্বীপের মাঝে 185 কিমি প্রতি ঘণ্টা বেগে আছড়ে পড়ে। বিকেল 4:30 নাগাদ ঘূর্ণবাতের চক্ষু উক্ত এলাকায় প্রবেশ করে। ঘূর্ণবাতের চক্ষুর ব্যাসার্ধ ছিল 10 কিমি এবং চক্ষুপ্রাচীরের ব্যাসার্ধ ছিল মোটামুটি 30 কিমি। ভূমিভাগে আছড়ে পড়ার পর উমপুনের গড় গতিবেগ মোটামুটি 155 থেকে 165 কিমি প্রতি ঘণ্টার মধ্যে থাকে। কলকাতায় এই ঝড়ের সর্বোচ্চ গতিবেগ নথিভুক্ত করা হয় 114 কিমি প্রতি ঘণ্টা এবং দমদম বিমানবন্দরে সর্বোচ্চ গতি সন্ধে 7:20-তে দাঁড়ায় 133 কিমি প্রতি ঘণ্টায়। 16 মে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে গভীর নিম্নচাপরূপে উমপুনের উৎপত্তি। এরপর 18 মে ছয়দফায় শক্তি বাড়িয়ে উমপুন সুপার সাইক্লোনে পরিণত হয়। বঙ্গোপসাগরে উমপুনে বায়ুর গতিবেগ ছিল 260 থেকে 275 কিমি প্রতি ঘণ্টায়। সাগরদ্বীপে আছড়ে পড়ার পর গতি কমে দাঁড়ায় 155 থেকে 165 কিমি প্রতি ঘণ্টা। হুগলী নদী ধরে উমপুন অগ্রসর হয়ে মুর্শিদাবাদ জেলা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। 22 মে উমপুন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়।

ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ:


• উমপুনের প্রকোপে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলি। উত্তর ও দক্ষিণ 24 পরগনা সহ পূর্ব মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলী, বর্ধমান, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদের মোট 384টি ব্লকের 21507 বর্গকিমি জুড়ে 1-36 কোটি মানুষ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

• উমপুনে সরাসরি ও বিপর্যয় পরবর্তী সময় মিলিয়ে সরকারি হিসাব অনুযায়ী মোট 86 জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে কলকাতায় 19 জন ও উত্তর 24 পরগনায় 21 জন মারা যায়। উমপুনের জেরে মৃত 86 জনের মধ্যে 27 জন গাছে চাপা পড়ে, 22 জন বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠ হয়ে, 21 জন দেওয়ালে চাপা পড়ে মারা যায়।

• উমপুনের জন্য 6-18 লক্ষ মানুষকে 5136টি ত্রাণশিবিরে সরানো হয়েছে। এরম মধ্যে দক্ষিণ 24 পরগনায় 2-50 লক্ষ, উত্তর 24 পরগনায় 60 হাজার, পূর্ব মেদিনীপুরে 60 হাজার, পশ্চিম মেদিনীপুরে 20 হাজার, হাওড়ায় 43 হাজার ও হুগলী জেলায় 29 হাজার মানুষকে ত্রাণ শিবিরে পাঠানো হয়।

• উমপুনের প্রভাবে ভারী বর্ষণে কলকাতা সহ দক্ষিণবঙ্গের বহু জেলা প্লাবিত হয়। কলকাতায় 20 তারিখ বৃষ্টিপাত নথিভুক্ত হয় 236-3 মিলিমিটার। যা বিগত কয়েক শতাব্দীতে সংগঠিত বৃষ্টিপাতের চেয়ে সর্বাধিক। প্রবল ঝড় ও ভারী বৃষ্টিপাতে দমদম বিমানবন্দরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিমানবন্দরের রানওয়ে সহ দুটি হ্যাঙার জলের তলায় চলে যায়। ফলে বিমান পরিসেবা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

• ঝড়ের দাপটে উত্তর ও দক্ষিণ 24 পরগনার বহু এলাকায় নদী বাঁধ ভেঙে পড়ে এবং বিস্তীর্ণ এলাকা ও চাষের জমি সমুদ্রের নোনাজলে প্লাবিত হয়ে পড়ে। সুন্দরবনে মোট 180 কিমি নদী
বাঁধ ঝড়ের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 28 কিমি বাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙে যায় ও 76 কিমি বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুই 24 পরগনা মিলিয়ে মোট 71টি এলাকায় নদী বাঁধ ভাঙার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে পাথরপ্রতিমা, বাসন্তী, সাগর, কুলতলী, গোসাবা ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকা রয়েছে।

• ঝড়ের দাপটে মিনাখা, হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালি, হাড়োয়া, হাসনাবাদ সহ উত্তর 24 পরগনার বিভিন্ন এলাকায় কমপক্ষে 5,200টি মাটির বাড়ি সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। দক্ষিণ 24 পরগনার নদীবাঁধ ভেঙে নোনাজল ঢুকে পড়ায় 2 লক্ষ হেক্টর বিঘা জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। ঝড় ও বৃষ্টির প্রভাবে পূর্ব বর্ধমানে 600 কোটি টাকার ধান চাষের ক্ষতি হয়েছে।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Middle post ad 01